একটা গরিব লোক ছিল। গরিব মানে এক্কেবারে গরিব, যাকে বলে হতদরিদ্র। চাল-চুলো কিচ্ছু ছিল না। লোকটা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো আর টুকটাক কাজ করত। এই কারও বাড়িতে মিস্ত্রী লেগেছে ও লেগে যেতো বালি চালা অথবা ইঁট বওয়ার কাজে, কারও অনুষ্ঠান বাড়ি হচ্ছে, ও লেগে যেতো পাত পরিষ্কার করতে, যখন কিছুই জুটতো না তখন শাসকদলের মিছিলে পা মেলাতো, সেদিনের মতো রাতের খাওয়া দাওয়া তো জুটতোই, স্থানীয় নেতার মন ভালো থাকলে থাকলে কখনো সখনো বিশ পঞ্চাশ টাকা নগদও মিলে যেতো। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো। গরিব লোকটার কোনো দুঃখ ছিল না। মনে করতো এই বেশ ভালো আছি।
তা একদিন ওই গরিবটা এরকমই একটা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে গেলো এক বিশাল সভায়। দেখলো চারদিকে লোকে লোকারণ্য, ওর পাড়া থেকেও বহু মানুষ এসেছে এবং কাতারে কাতারে এসেই চলেছে। কোন দূর দেশ থেকে নাকি বিশাল বড় মাপের এক নেত্রী এসেছেন হেলিকপ্টারে চড়ে। তারই বক্তব্য শোনানোর জন্য সব পাড়া থেকে লোক নিয়ে আসা হয়েছে। সেই সকাল থেকে জমায়েত শুরু হয়েছে। দুপুর নাগাদ ওকে নগদ দুশো টাকা দিয়ে দিলেই ও ফেরার পথ ধরবে। পাড়ার নেতার সাথে সেরকমই কথা হয়ে আছে। বড় নেতা, মাঝারি নেতা, ছোটো নেতার বক্তব্য শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেলো। ভিড়ের মাঝে সেই পাড়ার নেতার দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। মঞ্চের সবাই চলে গেলে বিকেল নাগাদ দেখা মিললো নেতার। একগাল হেসে গরিবকে দুশোটা টাকা ধরিয়ে দিলো। ওর মতো আরও অনেকেই টাকা পাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। নেতা সবাইকে হেসে হেসে পয়সা দিতে থাকলো। গরিব টাকা নিয়ে ফেরার পথ ধরতেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলো ওদেরই পাড়ার একটা বৌয়ের সাথে পাড়ার নেতাটার একটা ঝগড়ামতো হচ্ছে। বৌটাকে গরিবটা চেনে। গেল বছর ওর বরটা রেলে কাটা পড়েছে, এখন দু তিনটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে খায়। বৌটা এসেছে ওর তিনটে মেয়েকে নিয়ে। তার মধ্যে একটা আবার কোলে, সেটা সমানে কেঁদেই চলেছে। আর বাকিদুটো এতোই ধুঁকছে, মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে। বৌটার অবস্থাও তেমনই। নেতা বলছে দুশো টাকার বেশি এক পয়সা দিতে পারব না। আর বৌটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে চলেছে, না বাবু আমরা তো চারজন আছি। কম করে তিনশোটা টাকা দাও। আস্তে আস্তে নেতার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। এতোগুলো লোককে পয়সা দিতে হবে, পাড়ার ক্লাবে রাতের ফিস্টের সব আয়োজন করতে হবে। আজ আবার ছেলেগুলো বাংলা ছেড়ে ইংলিশ খাবার বায়না ধরেছে। তার মধ্যে আবার এই। কাঁহাতক সহ্য হয়? বৌটাও নাছোড়বান্দা। নাকি সুরে একই কথা বারবার বলে চলেছে। নেতা আর পারলো না। হাতটা খানিক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একবার ওপরে উঠে আবার নীচে নেমে এলো। সপাটে একটা চড়। বৌটা বাচ্চা সমেত ধপ করে পড়ে গেলো। বাকি দুটো মেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নেতা একটু মুচকি হেসে নোটের গোছা হাতে পরেরজনের দিকে এগিয়ে গেলো। The show must go on.
কিন্তু না, শো টা চালু রইলো না। নেতা হঠাৎ মাথা চেপে বসে পড়লো। কোন ফাঁকে গরিবটা একগাছা ইঁট তুলে নেতার একেবারে ব্রম্ভতালুতে সজোরে বসিয়ে দিয়েছে। পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় আশেপাশের লোকজন খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারই মধ্যে নেতার চ্যালাদের একজন চিল চিৎকার করে উঠলো, 'মেরে ফেললো রে, পাগলাটা কেষ্টদাকে বোধহয় মেরেই ফেললো'। পুলিশ এলো। গরিবটা পালানোর চেষ্টা করলো না। পুলিশ টানতে টানতে ওকে জিপে তুললো। জিপে ওঠার থেকেই শুরু হলো অকথ্য মার। ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের নেতাকে 'attempt to murder' বলে কথা। খাঁকি নিজের প্রভুভক্তি প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করল না। চলল বুট, লাঠির যথেচ্ছ ব্যবহার। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে পুলিশগুলোর একজন বলে উঠলো, 'স্যার! একে খামোখা থানায় নিয়ে গিয়ে ফ্রির খাবার খাওয়ানোর কি মানে হয়? বলেন তো এখানেই ঠুকে দিই?' স্যারের কথাটা বেশ পছন্দ হলোনা। বললেন, 'আরে ধ্যাত! সারাজীবন রাজা উজির মেরে রিটায়ারমেন্টের আগে এসে কি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব? নিয়ে চল থানায়। রাতে পার্টির লোকজন এলে ওদের হাতেই তুলে দেবো। ওরাই যা পারে করুকগে যাক।' তাই হলো। রাতের অপেক্ষায় গরিবটা আধমরা অবস্থায় গারদে পড়ে রইলো। সন্ধ্যে পেরিয়ে একসময় রাত হলো। পার্টির লোকও এলো। বিলিতি মদের গন্ধে থানাটা ম ম করতে লাগলো। গারদ থেকে টেনে হিঁচড়ে গরিবটাকে বের করে নিয়ে আসা হলো। থানা থেকে বেরিয়ে সোজা যাওয়া হবে নেতার ফার্ম হাউসে। সেখানেই গরিবটাকে খালাস করা হবে। শালার বড্ড বাড় বেড়েছে। কিন্তু এ কি! এতো আওয়াজ কিসের? এতো আলোই বা আসছে কোথা থেকে? একটা হাবিলদার স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো, 'হুজুর লাল পার্টির লোক এসেছে। হাতে মশাল নিয়ে থানা ঘেরাও করে বসে আছে। বলছে ওরা নাকি গরিবটার নিঃশর্ত মুক্তি চায়।' গরিবটা মেঝেতে পড়ে পড়ে এসব শুনে অবাক হয়ে গেলো। ওকে বাঁচাতে এত্তো লোক এসেছে? এরা কারা? শুনতে শুনতে একসময় ও পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়লো। যেটুকু চেতনা ছিল তাতেই বুঝত পারলো পুলিশগুলো ওকে বের করে নিয়ে আসছে। চারদিক থেকে গগনভেদী কান ফাটানো আওয়াজ আসছে, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে ও দেখলো কয়েকজন ওর মতোই হতদরিদ্র মানুষ ওকে বুকে জাপটে জড়িয়ে ধরছে আর বলে চলেছে কয়েকটা অদ্ভুত শব্দ। 'লাল সেলাম, কমরেড'।