আপনি কি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চান?
প্রিন্স ফার্দিনান্দ
Nov. 21, 2024 | | views :282 | like:0 | share: 0 | comments :0
ওকে ফাইন, হে নবীন পথিক৷ মুক্তচিন্তার জগতে আপনাকে স্বাগতম। শুরুতেই বলে নিচ্ছি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হলে অর্থাৎ মুক্তচিন্তক বা মুক্তমনা হতে হলে আপনাকে অবশ্যই সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। মুক্তচিন্তা মুক্তমনা মানেই হল আপনার চিন্তার জগত, আপনার কল্পনা, আপনার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই হবে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। বদ্ধ সিস্টেমের ভেতরে থেকে এটা সম্ভব নয়।
চলেন বিষয়টি নিয়ে সায়েন্স ও ফিলোসোফির আলোকে একটু আলোচনা করি।
বিজ্ঞানের আলোকে আমরা জানি যে, ইউনিভার্সের কোন কিছুই সুশৃঙ্খলভাবে চলছে না। এখানের সবকিছুই বিশৃঙ্খল। তবে এই বিশৃঙ্খল জগতের সকল পদার্থ ও শক্তির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যায় যেসব বৈজ্ঞানিক সূত্র দিয়ে তা কখনো পরিবর্তন হবে না। এই যেমন শক্তির নিত্যতা সূত্র, থার্মোডাইনামিক্সের
সূত্রসমূহ এসব কখনও পরিবর্তন হবে না। এই সূত্রসমূহ যেকোনো সিস্টেমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন কোন সিস্টেম বা ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই ইউনিভার্সাল সূত্রসমূহের ব্যত্যয় ঘটবে। এই সিস্টেম হতে পারে আমাদের পুরো মহাবিশ্ব কিংবা একটি নক্ষত্র অথবা আমাদের পৃথিবী বা অন্য কোন গ্রহ। আবার এই সিস্টেম হতে পারে আমাদের পৃথিবীর অন্তর্গত যেকোন কিছু, পৃথিবীর সাগর মহাসাগর, নদ-নদী, খাল, বিল,পাহাড় পর্বত,বাতাস ইত্যাদি।
আপনার খাবার টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি, চুলোয় বসানো গরম পানিভর্তি পাতিল, পার্টিতে কিনে আনা এক বোতল মদ, কিংবা কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান সবই একেকটা সিস্টেমের আওতাধীন।
এতো গেল শুধু ম্যাক্রো লেভেলের উদাহরণ। এবার সিস্টেমের কিছু মাইক্রো লেভেলের উদাহরণ দেখে নেয়া যাক। পদার্থকে ভাঙলে যে অণু পরমাণু পাওয়া যায় সেগুলো ও একটা সিস্টেম। আবার পরমাণুকে আরও ভাঙতে থাকলে যে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন,ও অন্যান্য Particles পাওয়া যায় সেগুলোও একটা সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। আবার আরেকটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা, রাস্ট্র, সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান -মসজিদ,মন্দির,গীর্জা,প্যাগোডা, বিভিন্ন শিল্পকারখানা, যানবাহন, ক্রীড়া ও চিত্রজগত ইত্যাদির সবকিছুই কোন না সিস্টেমের অধীন। কাজেই এক কথায় বলা যায় ইউনিভার্সের সবকিছুই একটা সিস্টেমের আওতাধীন।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সিস্টেম আসলে কি? সিস্টেমের সংজ্ঞাই বা কি? ওকে ফাইন, উত্তরটা আমি জানিয়ে দিচ্ছি।
সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে “সিস্টেম হলো এমন একটি সজ্জিত নিয়ম বা পদ্ধতি বা গঠনতন্ত্র বা বস্তুর সন্নিবেশ যা একটি নির্দিষ্ট কৌশল বা পরস্পর আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ক এর অংশ হিসেবে কাজ করে। যেমনঃ রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে সিস্টেম, মোবাইল নেটওয়ার্ক সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম বা ইন্টারনেট, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি আবার পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় সিস্টেমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে -
পরীক্ষা নীরিক্ষা করার সময় জড়জগতের যে অংশ বিবেচনা করা হয় তাকে সিস্টেম বলে। এই সিস্টেম ৩ ধরনের হতে পারে। যথা- বদ্ধ সিস্টেম, মুক্ত সিস্টেম ও বিচ্ছিন্ন সিস্টেম। মুক্ত সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে পদার্থ ও শক্তির বিনিময় হয়। যেমন, গরম পানিযুক্ত উন্মুক্ত চায়ের কেটলি বা এক কাপ গরম চা বা কফি হল মুক্ত সিস্টেমের উদাহরণ। আবার বদ্ধ সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে শুধুমাত্র শক্তির বিনিময় হয় কিন্তু পদার্থ বা ভরের বিনিময় হয় না। যেমন, ঢাকনা দিয়ে আটকানো গরম পানি ধারণ কারী চায়ের কেটলি। অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে পদার্থ ও শক্তি কোনটারই বিনিময় হয় না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ইউনিভার্সের কোথাও কোন বিচ্ছিন্ন সিস্টেম বলে কিছুই নেই। এটা জাস্ট একটা কাল্পনিক ধারণা।
যাইহোক, এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে। কিন্তু আমার এই আলোচনায় আমি জাস্ট মূল থিমের আলোকে আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি এতক্ষণে আপনি সিস্টেম সম্পর্কে অনেকখানি অবগত হয়েছেন। আপনি যদি সিস্টেম সম্পর্কে বুঝেই থাকেন তাহলে আপনাকে এখন বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। প্রশ্নগুলো আসতে পারে কোন অল্পশিক্ষিত চতুর ধূর্ত মোল্লার কাছ থেকে। ধূর্ত মোল্লা আপনাকে বলতে পারে যে, "পুরো মহাবিশ্বই যেহেতু একটা সিস্টেম, তাহলে এই সিস্টেম তৈরি করলো কে? এই সিস্টেম নিশ্চয় 'ভুগিভুগি' তৈরি করেছেন এবং তিনিই ইহা চালাচ্ছেন তার নিজের খেয়ালে।”
ধূর্ত মোল্লার এমন প্রশ্ন ও উত্তর শুনে যদি আপনি এখানেই থেমে যান তাহলে আপনি কোনদিন গন্ডীর বাহিরে চিন্তা করতে পারবেন না। আপনি জগতের সৃষ্টি রহস্যের আগামাথা কিছুই জানতে পারবেন না। আপনার পক্ষে কখনো মুক্তচিন্তক ও প্রগতিশীল হওয়া সম্ভব না। কাজেই আপনাকে থেমে গেলে চলবে না। ওই পয়েন্টটাই আপনার মুক্তচিন্তক হয়ে উঠার পেছনে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে যদি আপনি তাকে পালটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে পারেন।
আপনি তাকে প্রশ্ন ছুড়ে মারুন যে পৃথিবীতে ৪০০০+ ধর্ম আছে। কোন ধর্মের কোন 'ভুগিভুগি' এই সিস্টেম তৈরি করেছেন?
এই সিস্টেম তিনি কেন তৈরি করেছেন, কিভাবে তৈরি করেছেন? ভুগিভুগির তৈরি করা সিস্টেমে কোন শৃঙ্খলা নেই কেন? কেন পৃথিবীতে এক প্রাণী খাচ্ছে আরেক প্রাণীকে?
কেন মহাবিশ্বে সবসময় মহা কুরুক্ষেত্র লেগেই আছে? কেন কোন কিছুই সুক্ষ্ণভাবে চলছে না? কেন নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠোকাঠুকি লাগে? কেন নক্ষত্র collapsed হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়ে সে Constellation এর সকল তারাগুলোকে গিলে ফেলে
কিংবা Neutron নক্ষত্র হয়ে মারাত্মক শক্তিশালী Gamma ray বিকিরণ করে আশেপাশের সব তারাকে ধংস করে দেয়? কেন বড় Galaxy ছোটো Glaxy কে গিলে খেয়ে আপন আকৃতিকে
বিশাল করে ফেলে? কেন মহাবিশ্বে এই অহরহ তান্ডবের লীলাখেলা চলছেই যার কোন নিয়ম কানুন নাই?
Why there is no plan or rule in the Cosmos? কেন যে যার খেয়ালে চলছে, ধ্বংস হচ্ছে আবার নতুন রূপে আবির্ভাব হচ্ছে? এভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে পারলে আপনি অতি দ্রুতই চিন্তায় ও মননে হাজারগুণে এগিয়ে যাবেন।
পরিশেষে বলি মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করতে হলে আপনাকে আগে সিস্টেমের বাহিরে আসতে হবে। সিস্টেমের ভেতরে থেকে আপনি কখনোই সিস্টেমকে জানতে বা বুঝতে পারবেন না। সিস্টেমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে সিস্টেমকে observe করতে হবে। একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে বুঝাই-
আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের কথাই ধরুন। এই কাওমি মাদ্রাসা হল একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমের ভেতরে যেসব ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে তারা সাধারণত বাহিরের জগত উন্নত বিশ্বের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আধুনিকতা সম্পর্কে অবগত থাকে না। তারা সিস্টেমের আওতাধীন হুজুরদের মুখে যা শুনে সেটাকেই মনে করে পুরো পৃথিবী। তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কেও অনেক পিছিয়ে থাকে। এর কারণ কওমি মাদ্রাসার সিস্টেম অনুযায়ী সেখানে তাদেরকে সাধারণত ধর্মীয় বই পুস্তকই বেশি বেশি পড়ানো হয়। তাদেরকে বিখ্যাত লেখকদের বই পড়ার সুযোগ দেয়া হয় না। উন্নত বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা খুব একটা ওয়াকিবহাল থাকে না। কাজেই কওমি সিস্টেমের ভেতরে থেকে পড়াশোনা করা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে মুক্তচিন্তক হয়ে উঠা খুবই কম সম্ভব।