বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম শিল্পস্বাধীনতা!
লোকনাথ
Nov. 23, 2024 | | views :285 | like:0 | share: 0 | comments :0
১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনী আইনে ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত হয় ১০টি নাগরিক মৌলিক কর্তব্য (পার্ট IV-A, আর্টিকল 51A) এবং পরবর্তীকালে আরো ১টি। এই মৌলিক কর্তব্য পালন আবশ্যক নয়, এই কর্তব্য পালনে নাগরিককে বাধ্য করার আইনি ক্ষমতার সংস্থান ভারতীয় সংবিধানে নেই। মৌলিক কর্তব্যগুলি মূলত নাগরিকের নৈতিক শিক্ষা এবং মননের গঠনের উদ্দেশ্যে সংযোজিত হয়েছে। এই মৌলিক কর্তব্যগুলির মধ্যে অষ্টম কর্তব্যটি হল "Develope Scientific temper, humanism and the spirit of inquiry and reform". ভারতবর্ষের মত ধর্মপ্রবল দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির লড়াই অত্যন্ত কঠিন। আর এই কঠিন লড়াই লড়ে চলেছেন বিভিন্ন মঞ্চ, সংস্থার সাথে যুক্ত বিজ্ঞানকর্মী এবং সমাজকর্মীরা। বছরের পর বছর ধরে তারা নিজেদের জীবন নিয়োজিত করেছেন সমাজে বিজ্ঞানচেতনা তৈরির কাজে। আর ঠিক এর বিপরীত চলেছে অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের চাষ। রাজনৈতিক, সামাজিক আধিপত্য অটুট রাখার জন্য কিছু ধান্দাবাজ, ক্ষমতালোভী মানুষ নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানবিমুখ প্রগতিশীলতা বিরোধী আন্দোলন। খুব স্পষ্ট উদাহরণ হিসাবে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর দিকে তাকানো যায়। কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাসের প্রচারে নির্মিত হয়ে চলেছে একের পর এক সিনেমা। এই প্রবণতা আরো বেড়েছে যখন আধুনিক VFX প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করে দিয়েছে এই ধরনের সিনেমাগুলোর দৃশ্যায়ন। ক্ষমতাসীন শক্তিগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বেশি এই ধরনের সিনেমা তৈরির উদ্যোগ বেড়েছে। দুঃখের বিষয় এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক আগ্রহকে আমরা এখনও সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করিনি।
পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞানকর্মীদের বহুবছরের আন্দোলনে কার্যত জল ঢেলে দিয়েছিল ১৯৭৭ সালে নির্মিত “বাবা তারকনাথ” সিনেমাটি।
সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে সাপ বিষ ফেরত নিচ্ছে(!), তাও আবার দৈবিক নির্দেশে! অপবিজ্ঞান, কুশিক্ষা, বিজ্ঞানবিমুখতার সর্বোচ্চস্তর এই সিনেমাটি। এই চুড়ান্ত মিথ্যে, ভ্রান্ত অপপ্রচার গ্রামবাংলার কত মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং কত মানুষের অকালমৃত্যুর কারন হয়েছে তার হিসেব কেউ জানে না।
এখনও আমরা সংবাদপত্রের পাতায় খবর দেখি যে, ওঝা বা গুনিনের কাছে নিয়ে যাওয়ার কারণে সাপের কামড়ে বিষ ছড়িয়ে মৃত্যু।
সাপের কামড়ের ১০০ মিনিট (প্রায় দেড়ঘণ্টা) সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু আটকানো যায়,
বিজ্ঞানের এই সাফল্যের উপকার থেকে লাভবান হতে পারেন না বহু অভাগা মানুষ ও পরিবার। কারন শিক্ষার অভাব এবং অপশিক্ষার প্রচার। সম্পূর্ন অবৈজ্ঞানিক প্রাণঘাতী এই ফালতু সিনেমাটি পরবর্তীকালে একাধিকবার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মুক্তি পায় বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং বহু মানুষের কাছে পৌঁছে তাদেরকে প্রভাবিত করে। সাধারণত দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তিগুলি এই ধরনের পশ্চাদপসারী অপশিক্ষা প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের সিনেমা তৈরি এবং রিলিজ হওয়া আটকানো যায়নি।
এই ধরনের অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারমূলক সিনেমার বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে তীব্র সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন ছিল, তা গড়ে ওঠেনি। প্রশাসনিকভাবে আটকানো সম্ভব না হওয়ার কারন সম্ভবত সংবিধানের আর্টিকেল ১৯ এবং ২৫। এই দুটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে প্রথমটি বাকস্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়টি যেকোনো ধর্মমত প্রচার, প্রসারের স্বাধীনতা। শিল্প এবং শিল্পীর স্বাধীনতার নামে সমাজকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়াকে আটকানোর জন্য কোনো আইনের সংস্থান ভারতীয় সংবিধানে নেই। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল সমাজগঠনের জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞানসচেতন মানুষের কাছে একমাত্র হাতিয়ার প্রচার আন্দোলন।
যতদিন পর্যন্ত এই ধরনের অপবিজ্ঞান কুশিক্ষার প্রচার রোধে সুসংবদ্ধ আইন তৈরি না হচ্ছে, দেশের বিজ্ঞানকর্মী এবং সমাজকর্মীদের কাছে এই লড়াই খুবই কঠিন এবং দীর্ঘ।
বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক স্বার্থে অপবিজ্ঞান প্রচারকে আটকানো না গেলে গণেশের দুধ খাওয়া, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা গণেশের ছবি টাকায় দিয়ে অর্থনীতি উদ্ধারের মত অপবিজ্ঞানবোধ আমাদের আরো কয়েকশত বছর পিছিয়ে দেবে।
লোকনাথ, Durgapur