গল্পের ফাঁকফোঁকর : কৃষ্ণের বিরুদ্ধে শিশুপালের সব অভিযোগই  কি মিথ্যে ছিল?

Guitar K Kanungo


Jan. 26, 2025 | | views :66 | like:1 | share: 0 | comments :0

কৃষ্ণ কেবলমাত্র কংসের নয় আরো একজনের মৃত্যুর কারণ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল। সম্পর্কে শিশুপাল আবার কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। শিশুপালের জন্মও কিছুটা অস্বাভাবিকই ছিল। তিনি তিনটি চোখ এবং তিনটি বাহু নিয়ে জন্মেছিলেন। ফলত তাঁর জন্মের পরপরই একটা দৈববাণী হয় যে যার হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তিনি তাঁকে স্পর্শ করলেই তাঁর এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়বে।

শিশুপাল যখন ছোট তখন কৃষ্ণ একবার তাকে কোলে নিতেই শিশুপালের এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়ে। শিশুপালের কদর্যতা ঘুঁচলেও আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হল - সবাই জেনে গেল কৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু হবে। কেউ যদি আগে থেকে জেনে যায় বিশেষ একজন মানুষের হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তাহলে সে যেটা করতে চাইবে সেটা হল সেই মানুষটাকে হত্যা করা। যে চেষ্টাটা মথুরার রাজা কংস করেছিলেন।

কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন ওঠে যদি কারো মৃত্যু এভাবেই নির্ধারিত হয়ে থাকে - দৈৱিকভাবে - তাহলে সেটা এড়ানো কি আদৌ সম্ভব? মৃত্যু একদিন সবারই হবে।  বেশিরভাগ মানুষ সেটা জানে ; তারা কেবল এটা জানে না সেই মৃত্যুটা কখন হবে, এবং কার হাতে হবে। শিশুপাল এবং কংসের দুর্ভাগ্য তারা সেটা আগে থেকে জানতেন।

কংস সব রকমের চেষ্ঠা করেছিলেন তার ভবিষ্যত হত্যাকারীকে তিনি নিজে খুন হয়ে যাবার আগে খুন করে ফেলতে। যে কোন ক্ষমতাবান মানুষ সেটাই করবে এবং কংস সেটাই করেছিলেন ; কিন্তু তিনি যে উপায়ে কাজটা করেছিলেন সেই কাজটা যথযথ ছিল না। একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলেই তিনি তার ভবিষ্যতকে বদলে দিতে পারতেন। দেবকী অরে বসুদেবকে কারাবন্দি করেছেন ভালো কথা কিন্তু তাদের একসঙ্গে থাকতে দিয়েই নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছেন। দেবকীকে রাজপ্রাসাদে রেখে বসুদেবকে কারাগারে আটকে রাখলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। তাহলে এই দম্পতির কোন সন্তানেরই জন্ম হত না, অষ্ঠম সন্তান তো অনেক পড়ের কথা।  


সেই দিক থেকে দেখলে শ্রুতশ্রবা বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। শ্রুতশ্রবা  সম্পর্কে শিশুপালের জননী, কৃষ্ণের পিসী। কৃষ্ণবর্ণের এই ভাইপোটার বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি আগাগোড়ায়  সচেতন ছিলেন। তিনি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন  করলেন।  তিনি জানতেন পুত্রের ভবিতব্যকে পরিবর্তন করার সাধ্য তাঁর নেই, কিন্তু চাইলে তিনি পুত্রের পরমায়ু বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন।  তিনি সেটাই করেছেন। কৃষ্ণকে দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন শিশুপালের অন্তত একশ অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করবেন।    

একশটি অপরাধ খুব একটা কম কথা নয়। এমন নয় যে শিশুপালের সঙ্গে কৃষ্ণের মাসে একবার করে দেখা হচ্ছে। এমনও হয়েছে বছরের পর বছর কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপালের হয়ত কোন রকম দেখাই হয়নি। দেখা না হলে অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা থাকে না। এইভাবে দেখলে পুত্র শিশুপালের জন্যে একটা দীর্ঘ জীবনের ব্যবস্থা শ্রুতশ্রবা করে রেখেছিলেন। কিন্তু মানুষ যত চেষ্টাই করুক নিয়তিকে খণ্ডনের উপায় নেই। শিশুপাল নিজেই ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।

একথা ঠিক কৃষ্ণ তাঁকে একদিন হত্যা করবে এই তথ্যটা জানার পর মামাতো ভাই হলেও শিশুপাল কৃষ্ণকে সহজভাবে নিতে পারে নি। নিতে না পারারই কথা; বয়ঃপ্রাপ্ত হতেই শিশুপাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে গিয়েই ভিড়ল। শুধু যে ভিড়ল তা নয় তাঁর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল বিদর্ভ রাজ্যের যুবরাজ রূক্ষ্মীর সঙ্গে এবং বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে  রূক্ষ্মীর বোন রুক্ষ্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল। বিধির বিধান! এদিকে রুক্মিণী কিন্তু ভালোবাসতেন শিশুপালের পরম শত্রু বাসুদেব কৃষ্ণকে। 

শেষ পর্যন্ত রুক্ষ্মিণীকে কৃষ্ণ অপহরণ করে নিয়ে গেলেন। বিদর্ভ রাজ্যের রাজা, কিংবা রাজকুমার অথবা সৈন্য সামন্তদের কিছুই করার থাকল না। কৃষ্ণের প্রতি শিশুপালের ঘৃণার পারদ কেবল আরেক দফা পারল। রাগে ক্ষোভে  শিশুপাল হয়ত বেশ কিছু গালাগাল দিয়ে ফেললেন কৃষ্ণকে - হতে পারে মনে মনে কিন্তু অপরাধ অপরাধই। কৃষ্ণ হিসাব রাখছেন কারণ তাঁর তরফে এটা একটা দায়িত্বও বটে।  তিনি কংস এবং কংসের সহযোগীদের দমন করার জন্যে এই ধরাধামে অবতীর্ন হয়েছেন। কংসও আত্মীয়, শিশুপালও আত্মীয় ; কিন্তু কৃষ্ণের উপায় নেই।    

মহাভারত আমাদের পরিষ্কার করে বলে নি শিশুপালের যে একশটা অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করেছেন সেই অপরাধ গুলো আসলে কী কী। আমরা শিশুপাল এবং কৃষ্ণকে একই আসরে উপস্থিত থাকতে দেখব যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। এর আগে অন্তত দুবার এই দুইজনের দেখা হয়েছিল। কৃষ্ণ যখন নরকাসুরকে বধ করতে যান তখন একবার কারণ সেই সময় শিশুপাল নরকসুরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন কৃষ্ণ রুক্মিনীকে অপহরণ করেন। আগেই বলা হয়েছে ওই বিয়ের আসরে শিশুপালই বর হয়ে এসেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে সমস্যাটা শুরু হয়েছিল যখন ওই যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে দেয়া উচিত সেই প্রসঙ্গ উঠল। মহামতি ভীষ্ম কৃষ্ণকেই যোগ্য ব্যাক্তি হিসাবে মনোনীত করতেই শিশুপাল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কৃষ্ণের ব্যাপারে তার এমনিতেই আক্রোশের শেষ নেই। তার উপর ভীষ্ম বলছেন সেই কৃষ্ণকেই সেই বিরল সম্মান দিতে যে সম্মানের যোগ্য কৃষ্ণ নন - অন্তত শিশুপাল সেটাই মনে করেন। এই নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় - এক পর্যায়ে শিশুপালের সমস্ত একশটি অপরাধ পূর্ণ হওয়া এবং কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে শিশুপালের দেহ থেকে মুন্ডু খসে যাওয়া।    

প্রশ্ন হচ্ছে শিশুপাল কী ভুল কিছু বলেছিলেন? ভীষ্ম কৃষ্ণকে যোগ্য মনে করেছেন অলৌকিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই কৃষ্ণ কোন অবতারই ছিলেন, তিনি আর দশ জনের মত একজন সাধারণ মানুষ। তখন পর্যন্ত তাঁর একমাত্র সাফল্য কংসকে বধ করা। অবশ্য ইতোমধ্যে তিনি সেই সময়কার সবচাইতে পরাক্রমশালী মগধের রাজা জরাসন্ধকেও বধ করেছিলেন - তাও নিজে নয় ভীমকে দিয়ে এবং সেটা অনেকটা ছল করেই।

এদিকে কংসকে হত্যা করলেই কৃষ্ণ নিজে কখনো কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না, শিশুপাল একথাটাও মিথ্যা বলেননি। কংসকে হত্যা করবার পর কংসের পিতা উগ্রসেনেকেই মথুরার সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। আবার একথাও তো ঠিক জরাসন্ধের ভয়ে কৃষ্ণকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল - মথুরা থেকে সরে দ্বারকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জরাসন্ধ বেঁচে থাকলে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা হয়ে উঠত না। জরাসন্ধ বিশেষ কোন কারণে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করার অনুমতি দিলেই সেই যজ্ঞের অর্ঘ্য জরাসন্ধকেই অর্পণ করতে হত।


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929