রামিজ মিঞা গ্রিল আর তারজালির ফাঁক দিয়ে মন দিয়ে টিকটিকিটা দেখছিল। কালো, গায়ে চৌকোনা ছোপ, সামনের দিকের বাঁ পা টা পেছন দিকে কেতরে ডান পা টায় ভর দিয়ে খানিক উঁচু হয়ে সামনের দোতলার ড্রেনপাইপটায় লেপ্টে ছিল। ভঙ্গীটা এমন যেন এগোবে কিন্তু এগোচ্ছিল না। রামিজ রোজ দেখে টিকটিকিটাকে। দেখতে দেখতে একটা অভ্যেসমতো হয়ে গিয়েছে। আজ অবধি ওটাকে একচুল নড়তে দেখেনি ও। তাই সারাদিন খেয়াল না থাকলেও দুপুর বেলার এই সময়টায় বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে পাইপটার দিকে চোখ চলেই যায়। এই সময়টায় শাকিনা রোজ ফোন দেয়। বাবুদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধোওয়ার পর শাকিনা খানিক বিশ্রামের সুযোগ পায়। তখনই রামিজের ফোন বেজে ওঠে। রামিজ বিরক্ত হয়। ও এটা ওটা বলে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে আবার মন দিয়ে টিকটিকি দেখতে থাকে। আজকাল রামিজের দিনগুলো বড় মন্থর গতিতে পেরোয়। গেলোবছর বর্ষায় কারখানার মেশিন চাপা পড়ে বাঁ হাতখানা বাদ পড়ার পর মালিক কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিয়ে দিয়েছে। শাকিনাকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। প্রথম প্রথম একা একা থাকতে ভীষণ খারাপ লাগতো। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই শাকিনার ফোন রামিজের রোজকার একাকীত্বে খানিক ছন্দপতনই ঘটায়। আর ছন্দপতন আসে যেকোনো সরকারি ছুটিতে দোতলা বাড়িটা থেকে ভেসে আসা মাতালটার অশ্রাব্য চিৎকারে। গোটা বস্তিতে এই একটাই দোতলা বাড়ি। রামিজ যখন কাজে যেত শাকিনা রোজ বলত মাতালটার কথা। ছুটির দিন হলেই মাতালটা সকাল থেকে গলা অবধি মদ গিলে এসে বৌটাকে সারাদিন ধরে পেটায় আর যাচ্ছেতাই গালি গালাজ করে। তখন রামিজ তেমন পাত্তা দেয়নি। আজ বুঝতে পারে এই নিঃঝুম দুপুরবেলায় ওই মাতালটার চিৎকার কতখানি অসহ্য লাগে। এখন আবার চিৎকারের যোগ্য সঙ্গত করছে মাতালের বৌয়ের অস্পষ্ট গোঙানি। নাঃ অসহ্য লাগছে। রামিজ উঠে পড়লো। বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে শাকিনার সেলাইয়ের কাঁচিটা তুলে নিলো। দরজার শিকল দিতে গিয়ে ড্রেন পাইপটার দিকে চোখ পড়লো ওর। সেই কুৎসিত টিকটিকিটা বেশ খানিকটা নেমে এসেছে। আর ওর মুখে একটা গোটা আরশোলা, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। চেষ্টা করছে বেরিয়ে যাওয়ার, উদ্ধার পাওয়ার। টিকটিকিটা একটুও নড়ছেনা। পরম নিশ্চিন্ত মুখ করে লেপ্টে আছে নোংরা শ্যাওলাধরা ড্রেন পাইপটায়। কালো পুঁতির মতো চোখগুলো নিশ্চল। রামিজ বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচিখানা শক্ত করে বাগিয়ে ধরলো......