মহাপ্লাবন: এক নির্মম রিসেটের গল্প
Guitar K Kanungo
May 27, 2025 | | views :23 | like:1 | share: 0 | comments :0
মহাপ্লাবন এবং নোয়ার একটা জাহাজ নির্মাণ করে সমগ্র প্রাণীজগৎকে রক্ষা করার ঘটনা আমরা সবাই জানি। বাইবেলে এই ঘটনার কথা বিশদভাবে বলা আছে। সম্প্রতি জুলিয়ান বার্নসের লেখা A History of the World in 10½ Chapters পড়লাম। সেখানে “The Stowaway” নামের একটি অধ্যায় আছে। এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বেশ মজার।
একটি ঘুণপোকা—যাকে নোয়া তাঁর জাহাজে তোলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেননি—সে নোয়ার অজান্তেই ওই জাহাজে উঠে পড়ে। জাহাজেই থেকে সেই ঘুণপোকা নোয়ার প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখার সেই বিশাল কর্মকাণ্ডের একটি ক্রিটিকাল এনালাইসিস দেয়ার চেষ্টা করে। এনালাইসিসটি ভাবনার খোরাক জোগানোর মতো।
ঘুণপোকাটির মতে, নোয়া ও তাঁর নৌকার কাহিনি মোটেও কোনো মহৎ ঈশ্বরীয় পরিকল্পনা ছিল না। বরং এটি ছিল এক ধরনের ষড়যন্ত্র। নোয়া নিজেই ছিলেন একজন কর্তৃত্বপরায়ণ, পক্ষপাতদুষ্ট নেতা। তিনি নিজের খেয়ালমতো প্রাণীদের নির্বাচন করেছিলেন এবং যাদের ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করেছেন, তাদের জাহাজে স্থান দেননি।
নোয়া কিছু প্রাণীকে নোংরা, ক্ষতিকর বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপবিত্র মনে করে তাদের বাদ দেন। কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—কারা ঠিক করবে কোন প্রাণী পবিত্র আর কোনটা নয়? সে নিজেকে এক উদাহরণ হিসেবে হাজির করে—নোয়ার চোখে সে অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সহস্র বছর ধরে কাঠের গঠন, ইতিহাস এবং সভ্যতার অংশ।
বাইবেলে নোয়ার নৌকা এক শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল রক্ষা কেন্দ্রের মতো চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু ঘুণপোকার কাছে নৌকার পরিবেশ মোটেই সেরকম মনে হয়নি। গোটা পরবিশটাকে তার কাছে বিশৃঙ্খল ও স্বৈরতান্ত্রিক মনে হয়েছিল—যেখানে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে হিংসা, খাদ্যসংকট এবং নিপীড়নের পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।
ঘুণপোকা আমাদের জানায়, অনেক প্রাণীকে বাধ্য করা হতো নীরব থাকার জন্য, যাতে নোয়া বা তাঁর পরিবার বিরক্ত না হয়। যারা আওয়াজ করত বা “দায়িত্ব পালন করত না,” তাদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেওয়া হতো বা ফেলে দেওয়া হতো। এটা ছিল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত সমাজ, যেখানে নোয়া ও তাঁর পরিবারই ছিল একমাত্র কর্তৃত্ব।
ঘুণপোকা বারবার প্রশ্ন তোলে: সত্যিই কি এটি ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিল? নাকি নোয়ার নিজস্ব সুবিধা ও ধারণা অনুসারে এটি পরিচালিত হচ্ছিল? নোয়া যেভাবে প্রাণীদের নির্বাচন করেন, সেটিকে ঘুণপোকা এক ধরনের “নোয়া-ব্র্যান্ডেড” নৈতিকতা হিসেবেই দেখে—যেখানে একমাত্র নোয়ার মূল্যবোধই বিচার্য।
ঘুণপোকার মনে প্রশ্ন জেগেছিল—ইউনিকর্ন বাদ পড়ল কেন? নৌকায় ঠাঁই না পাওয়ার পেছনে তার অপরাধটা কী ছিল? না কি শুধুই পৌরাণিক ভেবে তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল?
ঘুণপোকা একটি গভীর দার্শনিক তর্ক সামনে তুলে আনে। সে বলে, “ওই জাহাজে আমি এবং আমার মতো আরও অনেকেই ছিলাম, কিন্তু আমাদের গল্প কেউ বলেনি।” বাইবেলে নোয়ার গল্প অমর হয়ে আছে, কিন্তু ঘুণপোকা মতো প্রাণীদের কণ্ঠ হারিয়ে গেছে ইতিহাসের গহ্বরে।
কাঠপোকা একটি চরম সত্য তুলে ধরে: তারা নৌকায় ছিল, তারা প্লাবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিল, কিন্তু কখনও কেউ তাদের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তারাই সেই লুকিয়ে থাকা সত্য, যাদের কেউ দেখতে পায় না।
ঘুণপোকার কাছে মনে হয়েছিল, ওই মহাপ্লাবন ছিল একটি ক্রুয়েল রিসেট—এক নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, যেখানে নিরীহ প্রাণী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। নোয়া শুধুমাত্র মানুষ ও নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীকে বাঁচিয়ে একটি “নতুন পৃথিবী” গঠন করেন।
কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—ঈশ্বরের পরিকল্পনা যদি এতটাই ন্যায়সঙ্গত হতো, তবে হাজারো প্রাণী কেন মারা গেল? কেন একটি পুরো প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হলো শুধুমাত্র মানুষের জন্য?
ঘুণপোকার এই প্রশ্নটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একজন সাহিত্য সমালোচক বলছেন, “The Stowaway” অধ্যায়ে ঘুণপোকাটি শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং ইতিহাসের সেই বিস্মৃত কণ্ঠস্বর—যারা প্রশ্ন করে, স্মরণ করিয়ে দেয় এবং প্রচলিত বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
এটি লেখক বার্নসের উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিখুঁত প্রকাশ—যেখানে ‘সত্য’ আপেক্ষিক, এবং ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই একটি পক্ষপাতদুষ্ট নির্মাণ, যে ইতিহাস কেবল তারাই লেখে যারা বিজয়ী হয়।
ফিক্শন পড়ে আমি সবসময় আমি আনন্দ পাই, এমন কথা বলতে পারব না ; কিন্তু জুলিয়ান বার্নসের এই বইটি পড়ে বেশ আনন্দিত হয়েছি। মগজে নাড়া পড়েছে - মহাপ্লাবনের মত একটা ঘটনা, যেটা কেবল বাইবেলে বর্ণিত একটা কল্পকাহিনীই নয়, অনেক প্রত্নতাত্বিক বিশ্বাস করেন অতীতের কোন এক সময়ে পৃথিবী সত্যিই এক মহাপ্লাবনের মুখোমুখি হয়েছিল, সেটাকে নতুন আঙ্গিক থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
বেশ কয়েক বছর আগে জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম পড়ে মগজে এরকম একটা ধাক্কা লেগেছিল।