মৌমাছি সমাজে শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি
পঞ্চানন মন্ডল
May 19, 2025 | | views :4 | like:0 | share: 0 | comments :0
‘মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই…’
মৌমাছির জীবনে আছে অসম্ভব ব্যস্ততা। আমরা মানুষরাও কম ব্যস্ত নই। কিন্তু অনেক প্রকৃতি প্রেমিক, গবেষক, বিজ্ঞানী আছেন যারা দিনরাত এক করে মৌমাছির জীবন রহস্য সম্বন্ধে অনেক কিছু আমাদের কাছে উন্মোচিত করেছেন। তবে আমাদের অনেকের মৌমাছির কাছে যাওয়ারও সাহস হয় না তাদের হুলের কারণে। তারপরও রাস্তা ঘাটে মৌচাক দেখলে আমাদের অনেকের কেন যে ঢিল ছুঁড়তে ইচ্ছে করে, কে জানে! এমনিতে মৌমাছি কখনও বিনা কারণে কাউকে আক্রমণ করে না, এরা খুবই শান্তি-প্রিয় প্রতঙ্গ। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে কোন ছাড় নেই, তখন এরা এদের একমাত্র অস্ত্র হুল প্রয়োগ করতে এরা দেরি করে না।
মৌমাছি খুবই পরিশ্রমী, দলবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক সামাজিক প্রাণী। এদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে! এদের সমাজে সবার কাজ নির্দিষ্ট, চেইন অফ কমান্ড এর বিন্দুমাত্র নড়চড় হয় না কখনও; হয় না কোন বিদ্রোহ। এখানে দুর্বলের কোন স্থান নেই, অত্যাচারীও নেই এখানে। নিজ দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এরা পিছপা হয় না কখনই। কঠোর পরিশ্রমী, আত্ম-ত্যাগ ও নিষ্ঠাই এদের ৩০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছে।
মৌমাছির সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিংবা অসাধারণ গুণের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে মৌ নৃত্যর (bee dance) কথা। তবে এ নাচ তো শুধুই নাচ নয়, এ তাদের ভাষা। এই নাচের মাধ্যমেই মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে, খবরাখবর আদান প্রদান করে থাকে, তার সঙ্গে করে খাবারের সন্ধান। মৌমাছির এই অদ্ভুত কম্যুনিকেশনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ। তাঁর জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে পান নোবেল পুরস্কার।
তিনিই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে দেখান যে, মৌমাছি নাচ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে, খাবারের সন্ধান পায়।
খাদ্য সন্ধানকারী কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছিরা প্রধানত দুই ধরনের মৌ নৃত্য করে থাকে, বৃত্তাকার বা চক্রাকার নৃত্য ও ওয়াগল নৃত্য।
বৃত্তাকার বা চক্রাকার মৌ নৃত্য-
খাদ্যের উৎসের দূরত্বের উপর নির্ভর করে খাদ্য সন্ধানে শ্রমিক মৌমাছিরা এই নৃত্য প্রদর্শন করে। খাদ্যের উৎস কাছাকাছি মানে ১০০ মিটারের মধ্যে হলে এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শিত হয়। খাদ্য সন্ধানী মৌমাছিদের পিছনে সংগ্রাহক মৌমাছিরাও তখন ধাবিত হয় ও তারাও একই রকমভাবে নাচতে থাকে। চক্রাকার নৃত্য নিকটবর্তী স্থানে খাদ্যের উৎস সম্পর্কে অন্যকে জানাতে এবং পক্ষান্তরে সেই উৎস থেকে মৌমাছিকে খাদ্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।
ওয়াগল ডান্স বা ওয়াগল নৃত্য-
ইংরেজি ওয়াগল শব্দের অর্থ আন্দোলন বা কম্পন। খাদ্যের উৎস বেশি দূরে হলে মানে ১০০ মিটারের বেশি হলে কর্মী মৌমাছিরা এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শন করে। এই নৃত্য ইংরেজি 8 সংখ্যার মত আকৃতির মতো হয়। এরা একবার ডান দিকে ও একবার বাঁদিকে ফাঁস বা লুপ তৈরি করে এবং নাচের সময় লুপ এর মধ্যে সরলরৈখিক অংশে সন্ধানী মৌমাছি ওপর-নিচে নিজেকে আন্দোলিত করে আর খাদ্যের উৎসের দিকে ধাবমান হয়।
ওয়াগল বৃত্তের সমীকরণ এর মাত্রা থেকে খাদ্যের অবস্থানের দূরত্ব সম্পর্কে মৌমাছি জানতে পারে। সূর্যের সাপেক্ষে নৃত্যের কৌণিক অভিমুখ থেকে খাদ্যের উৎস এর দিক নির্ধারণ করে। ঊর্ধ্বমুখী নৃত্য থেকে বোঝা যায় যে খাবারের উৎস এর অবস্থান সূর্যের দিকে এবং নিম্নমুখী নৃত্য থেকে বোঝা যায় যে খাবারের অবস্থান সূর্যের বিপরীত দিকে।
অর্থাৎ মৌমাছির রয়েছে অসাধারন দিক জ্ঞান এবং নিখুঁত দূরত্ব মাপার ক্ষমতা। কোন মৌমাছি যখন খাবারের অথবা মধুর নির্যাসের(মানে মকরন্দ বা নেকটার) কোন উৎস (ফুল) খুঁজে পায় তখন সে মৌচাকে এসে নৃত্যের মাধ্যমে সকলকে খবর দেয়। সে শরীর দোলাতে থাকে এবং নাচতে থাকে এমন এক পথ ধরে যার মাধ্যমে সে উৎসের দিক বোঝাতে পারে। এরা এই দিক ঠিক করে সূর্যের সাপেক্ষে যাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক বোঝা যায়।
মৌমাছির নৃত্যের সময়ব্যাপ্তি এবং কম্পনের (দোলা) সংখ্যা দিয়ে সে বোঝায় ঠিক কত দূরে আছে ফুল এবং ফুলে কি পরিমাণ মধুর নির্যাস রয়েছে, যেমন ১ সেকেন্ডের দোলন বোঝায় উৎস রয়েছে ১ কিমি দূরে।
এসব তথ্য এবং সূর্যের গতিবিধি’র নিখুঁত হিসেব করে মৌমাছিরা ফুল/খাবার এর কাছে পৌঁছানোর নুন্যতম ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দূরত্ব বের করে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছির এই সকল হিসেবের দক্ষতা খুব বেশি এবং সময়ও লাগে কম। উল্লেখ্য মৌমাছি সূর্যের আলোর হিসেব করতে পারে এবং পৃথিবী গোল হওয়ায় যে বক্রতার একটা ব্যাপার আসবে তাও তাদের নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করে।
মৌমাছি সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে চলাফেরা করে।
তাই যখন আকাশ মেঘলা থাকে, সূর্য মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়, তখন এরা এদের বিশেষ আলোক-গ্রাহক (ফটো-রিসেপ্টর) ব্যবহার করে পোলারাইজড আলো কাজে লাগিয়ে সূর্যের সঠিক অবস্থান বের করে ফেলে। এজন্য অতিবেগুনী (আল্ট্রা-ভায়োলেট) আলোরও সাহায্য পড়ে, সে ক্ষমতাও আছে এদের। এছাড়াও সূর্য আবার সবসময়ে সব ঋতুতে আকাশের এক জায়গায় থাকে না! তাতেও সমস্যা নেই! কারণ, মৌমাছির মাথায় আছে প্রাকৃতিক ঘড়ি! যার মাধ্যমে এরা সূর্যের গতিবিধি সবই হিসেব করতে পারে।
মৌমাছিরা গাছের ডালে বা কার্নিশে বড়-বড় চাক তৈরি করে। প্রতি চাকে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মৌমাছি থাকতে পারে। এক-একটি চাকে এত-এত মৌমাছি থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে ঝুট ঝামেলা করতে বা মারামারি করতে দেখা যায় না। অবশ্য সময়ে অসময়ে এক চাকের মৌমাছি অন্য চাকের মৌমাছিগুলিকে আক্রমণ করে লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। মৌমাছিরা ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করে সমাজের স্বার্থে কাজ করে যায়। এমনকি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। মৌমাছিরা অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে তাদের দিনযাপন করে।
এরা শীতকালে তেমন কাজ করে না। সারা শীতকালটা এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর করে কাটায়। কিন্তু বসন্তের আগমনে এরা পুরোনো ছন্দে ফেরে। মধু আহরণ, চাক নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসার আবর্জনা পরিষ্কার বলুন আর শত্রুদের সামলানো বলুন যেভাবে অত্যন্ত শৃঙ্খলা ও তৎপরতার সাথে কাজ করে, তা দেখলে আপনি বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা, কেউ কারোর কাজে বাধা সৃষ্টি করে না। সবাই যেন নিজ নিজ কাজের প্রতি দায়বদ্ধ। যেন কিছুটা রোবটের মতো কাজ করে যাচ্ছে। দেহ মনে কোনও ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, অন্যের উপর দোষারোপ নেই।
একটি মৌচাকের মৌমাছিকে আমরা দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি – অত্যন্ত কর্মপটু শ্রমিক মৌমাছি আর ওপর দল সম্পূর্ণ কর্মবিমুখ রানি ও পুরুষ মৌমাছি। আগেই বলেছি শ্রমিকরা চাক নির্মাণ, মকরন্দ সংগ্রহ, মধু তৈরি, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসা রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শত্রুদমন সবই করে। পুরুষরা মৌমাছি প্রধানত আহার-বিহারেই মত্ত থাকে। আর রানী মৌমাছির বংশবৃদ্ধি ছাড়া কোনও কাজ নেই। পুরুষেরা প্রায়ই দিনের শেষভাগে উচ্চ শব্দ করে বাসা থেকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ প্রমোদ ভ্রমণ করে বাসায় ফিরে আসে। প্রত্যেক চাকে সাধারণত একটি মাত্র পরিণত বয়স্ক রানি মৌমাছি দেখা যায়। মৌমাছিদের সামাজিক কার্যকলাপ দেখলে মনে হবে – একটিমাত্র রানীকে ঘিরেই তাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে রানি বলে সে যে সবাইকে শাসনে রেখেছে এমনটি ভাববেন না। এদের মধ্যে রাজতন্ত্র বা রাণীতন্ত্র বলে কোনও কিছুই নেই। রানির একমাত্র কাজ প্রজনন। একটি মাত্র রানিই চাকের প্রায় অধিকাংশ মৌমাছির মাতা। ডিম পারা আর আর পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে বৈবাহিক উড্ডয়নরত অবস্থায় যৌন মিলন ছাড়া তার তেমন কোনও কাজ নেই। তাই শ্রমিক মৌমাছি আছে বলে মৌচাক আছে, মৌমাছির সমাজ টিকে আছে। মৌমাছি সমাজে রানি বা কোনও রাজা নয় শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি। আর তাদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে,কাজ করে আর নেচে গেয়ে।