ধ্বংসের বোপীত বীজ ও শেষের অপেক্ষা
রাহুল রায়
Nov. 26, 2024 | | views :900 | like:0 | share: 0 | comments :0
কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডস্থিত কেদারনাথ নিয়ে একটি লেখা পড়া হচ্ছিল। কেদারনাথ মন্দিরটি নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এতে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছিলেন। অবশ্য তাতে মন্দির কর্তৃপক্ষ কোনও সাড়া দেয়নি যেমন সে রাজ্যের সরকার সাড়া দেয়নি কেদারনাথ মন্দিরের সামনে ছোটোখাটো একটি জনপদ গড়ে তোলার বিরুদ্ধে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের আবেদনেও। কারণ একটাই, টাকা। গতবছর কেদারনাথ মন্দিরে রেকর্ড ভাঙা ভিড় হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটকরা আসছেন, সঙ্গে আনছেন খরচ করার জন্য টাকা। সেই টাকা থেকে রাজ্যের অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু কথা হল আজকে না হয় দুধ ভাতের পথ বের করা হল, কাল যদি এই মন্দিরটিই কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বলি হয়ে যায় তখন যে দুধ ভাত কি ফেন ভাতও কপালে জুটবে না। কেদারনাথের মতো মন্দির প্রাচীন ভারতের বিস্ময়কর স্থাপত্যের নিদর্শন। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে একে বিপর্যস্ত করে নেওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই সবার পক্ষে মুখ বুজে মেনে নেওয়াটা সম্ভব হয়নি।
প্রকৃতির নিয়মকে তোয়াক্কা না করলে চললে কি হয় প্রকৃতি উত্তরাখণ্ড রাজ্যেই কিছুদিন আগে তার একটি উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের চামোলী জেলার যোশীমঠ সম্পর্কিত ঘটনাক্রম জনমানসে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ হিমালয়ের ধ্বস সংক্রান্ত নানা দুঃসংবাদ সচেতন সব মানুষেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাহাড়বাসী সাধারণের জনজীবন যারপরনাই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যয় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুদীর্ঘ কাল যাবৎ বিপথগামী যাপনের ফল। সুউচ্চ তরুশ্রেণী দ্বারা আচ্ছাদিত হিমালয়ের পর্বত গাত্র। বরফ গলা নির্মল জল প্রাকৃতিক নিয়মেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ খুঁজে নেমে আসে তটভূমিতে। পুষ্ট করে নিম্নভূমির নদীর স্বাস্থ্যকে। ভঙ্গুর পাহাড়ের গায়ে অজস্র গাছ গাছালির শেকড়ের বাঁধন ভূমির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত পাহাড়ি গাছের কাঠ দিয়ে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করেন পাহাড়ি জনজাতির মানুষজন। তাদের তৈরী কাঠের বাড়ি যেমন পাহাড়ি শীত প্রতিরোধে সক্ষম, তেমনই ভার কম হওয়ার জন্য পাহাড়ের ঢালু ভঙ্গুর জমির ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভারও প্রযুক্ত হয় না। পাহাড়ের সহন ক্ষমতার মধ্যেই থাকে স্থানীয় গ্রামগুলি। গ্রামগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়ে যায় পাহাড়কে অক্ষুন্ন রেখেই।
সমস্যা হয়েছে মানুষের কুশিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায়, সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু যে শিক্ষা মানুষের বোধশক্তি রহিত করে দেয় তাকে কুশিক্ষা ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। উত্তরাখণ্ডের মানুষ পড়াশোনা করতে বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে বিলাসবহুল জীবন, আধুনিক নির্মাণশৈলী দেখছেন, বাড়ি এসে নিজের জীবনে, বাড়িঘরে সেটার প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। বড় বড় বাড়ি, হোটেল অহরহ হচ্ছে। শত-শত গাড়ি টন টন কার্বন নিঃসরণ করে প্রতিদিন যাওয়া আসা করছে। পাহাড় একদিকে সবুজহীন হচ্ছে অন্যদিকে কার্বন একে গরম করে তুলছে। অবশ্য সব দোষ যে মানুষের তাও নয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিত্য নতুন নিয়ম করে পাহাড়, জঙ্গল সাফ করে নানা রকম প্রকল্প হাতে নেওয়ার আইনতঃ ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কেদারনাথ মন্দিরের সামনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দিন ধ্যান করতেই পারেন, এতে অসুবিধা নেই, ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে থাকার অধিকার একজন ভারতীয় হিসাবে ওঁর আছে। ভারতের মতো দেশে সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে এতে মানুষের আবেগকে নিজের পাশে পাওয়াই যায় কিন্তু প্রকৃতির চিন্তাকে পাশে রেখে এনটিপিসির তপোবনের মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করলে প্রকৃতির কিন্তু তার রুদ্র রূপ নিতে পিছপা হবে না। আর সমস্যা হল এখানে ইডি, সিবিআই, পুলিশ, আদালত, আইটি সেল কেউই কিছু করতে পারবে না। রাজ্য সরকারেরও একই অবস্থা। পাহাড়ের মানুষ হয়েও এরা পাহাড় রক্ষার চিন্তা করছে না। পর্যটন ও রাজস্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা, জঙ্গল সাফ করে নগরায়ন হচ্ছে। রেলের জায়গা খালি করতে সাড়ম্বরে বুলডোজার চালিয়েছেন ভালো কথা, স্থানীয় মানুষের দাবী মেনে একই রকম ব্যবস্থা যদি পাহাড়ে সবুজ ফেরাতে করতেন তাহলে আজ অন্ততঃ এই দিন দেখতে হতো না। এতসবের মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের সামঞ্জস্য স্বাভাবিক ভাবেই নষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছেন না কেন। যোশীমঠের মানুষ করেছিলেন, মাসের পর মাস, বিশেষজ্ঞরা ১৯৭৬ সন থেকেই ততকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকার ও পরবর্তীতে উত্তরাখণ্ড সরকারকে সতর্ক করছেন, কেউ কর্ণপাত করেনি। তবে আজকাল আবার প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলতেও সমস্যা আছে। প্রকৃতি রক্ষার ব্যবস্থা না হোক, সরকারী নীতি রক্ষার্থে প্রতিবাদীদের বিদেশী রাষ্ট্রের টাকায় উন্নয়ন বিরোধী শহুরে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু পাকাপোক্ত করা হয়েছে।
পর্যটনের বিকাশের নামে বিপুল মানুষ বছরভর পাহাড়ে আসছেন। ফুলে ফেঁপে উঠছে ব্যবসা। মুনাফাপ্রেমী ওই এক শতাংশ মানুষের লোভী দৃষ্টি এসে পড়েছে পাহাড়, জঙ্গলে। পর্যটন বিস্তারের নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে পাহাড়ের ভঙ্গুর ঢালু গা বেয়ে গড়ে উঠছে চওড়া রাস্তা, সেতু কংক্রিটের মহোৎসব। সেই রাস্তার ওপর দিয়ে শ'য়ে শ'য়ে চলেছে পর্যটক ভর্তি গাড়ি। পর্যটকদের জন্য শত শত হোটেল খুলে রাখা মালিক, রিসর্ট মালিক, পর্যটকদের ব্যবহার করা গাড়ির মালিক হলেন ওই এক শতাংশ। এদের চাঁদায় নির্বাচন তরী পেরিয়ে আসা জনপ্রতিনিধিরা এদের বিরোধিতা না করে বরং নীরবে অংশীদারত্বের পথ নেন। তাঁরা বেমালুম ভুলে যান যে এই রাস্তার ভার, এই গাড়ির ভার, এত মানুষের ভার বহনে সক্ষম নয় হিমালয়ের ভঙ্গুর পাহাড়ের গা-গুলি। উপরন্তু রাস্তা, কংক্রিটের সেতু, হোটেল, রিসর্ট বানানোর সুপ্রশস্ত জায়গা পাওয়ার জন্য নির্বিচারে বলি হচ্ছে সুপ্রাচীন বৃক্ষ রাজি। শেকড়ের প্রাকৃতিক বাঁধন হারিয়ে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে কংক্রিটের ভারে নুয়ে পড়া পাহাড়ের ভূমি। ফল স্বরূপ ধ্বস ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। জীবনহানি, সম্পত্তিহানি, ওই বাকি নিরানব্বই শতাংশের। চকচকে পাহাড়ের চকচকে বিলাসবহুল শহরের প্রয়োজনে চাই ঝকঝকে আলো। আলোর প্রয়োজনে চাই বিদ্যুৎ। অতএব পাহাড়ি নদীর ওই দুর্দম গতিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ এর পরিকল্পনা। নদীর ওপর আবার কংক্রিট, বাঁধ নির্মাণ। বাঁধের জমে থাকা জলে পাহাড় গায়ের অসম ভার বৃদ্ধি। আবার পাহাড়ের ভারসাম্যের বিঘ্ন। প্রকৃতিকে শাসন করার এই ভ্রান্ত চর্চা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পৃথিবীর ধ্বংস প্রাপ্তি পর্যন্ত অবিরল গতিতে চলতেই থাকবে। আর ওই এক শতাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদে, মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার জায়গা। আরো একটি মুনাফার কারখানা। আমরা নিরানব্বই শতাংশ এই দুর্ভোগ নিয়ে অভিযোজন ঘটাতে ঘটাতে বেঁচে রয়েছি। উপযুক্ত চেতনার দ্বারা উপযুক্ত পথের সন্ধান করার প্রয়াসী না হলে বৃদ্ধি আর উন্নয়নের এই কালচক্র থেকে নিস্তার নেই আমাদের, ওই নিরানব্বই এর দলের লোকেদের। আজ যোশীমঠ, কাল উত্তরকাশী, নৈনিতাল একই ঘটনা ঘটতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই এই দুই জনবসতি নিয়ে সরকারকে গুরুতর সাবধানবার্তা দিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এরপর কি শেষ হয়ে যাবে এই ধ্বংস যজ্ঞ? না, হবে না। মানুষ ধ্বংসের বীজ চারিদিকে বোপন করে রেখেছে। তা সে কেদারনাথ মন্দির প্রাঙ্গণই হোক বা বাংলার দার্জিলিং, কালিম্পং বা মেঘালয়ের শিলং। বোপিত বীজ অঙ্কুরিত হতে সময় কম বেশ লাগতেই পারে, কিন্তু হবে যে সেটা নিশ্চিত।