দ্রুম, দ্রুম। দু’খানা গুলি। একটা মাথার পেছন দিক থেকে আর আরেকটা পড়ে যাওয়ার পর ডান চোখে। নরেন্দ্র দাভেলকারকে এইভাবেই গুলি করে হত্যা করেছিলেন হিন্দুত্ববাদীরা।
সমাজে বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরীর প্রক্রিয়ায় ডঃ নরেন্দ্র দাভেলকারের অদম্য সাহসী ভূমিকায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন মৌলবাদী শক্তি। বিজ্ঞান আন্দোলনের একজন অগ্রণী সৈনিককে খুন করে সমগ্র বিজ্ঞান আন্দোলনকে হারিয়ে দেওয়ার উগ্র বাসনায় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হিন্দুত্ববাদী ‘সনাতন প্রভাত’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। “one gets what one deserves.” অর্থাৎ, “তার যা পাওনা ছিল সেটাই তিনি পেয়েছেন।” এটাই ছিল পত্রিকা গোষ্ঠীর মনোভাব। ওরা জানেন না যে মস্তিষ্ককে কারাগারে বন্দী করে বা মস্তিষ্কে গুলি করে একটা মানুষকে আটকানো যেতে পারে কিন্তু তার চিন্তাধারাকে আটকানো যায় না। তা আরও ছড়িয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র শক্তি সর্বদা মানুষের চেতনা ও মানসিকতাকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত করতে অত্যন্ত সক্রিয়। একমাত্র শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ব্যাপকতা আর সক্রিয়তা পারে রাষ্ট্র শক্তির এই আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিহত করতে। সেই লক্ষ্যেই তিনি কুসংস্কার মুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক সমাজগড়ার জন্য বিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজে বহমান নানাবিধ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। তবে শুধু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হতেন না বরং মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতেন।
জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দলিতদের সমানাধিকারের পক্ষে, মারাঠা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকারের নামাঙ্কিত করতে যেমন দাভেলকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তেমনি প্রতিটি গ্রামে একটি করে পানীয় জলের কুপের দাবিতে, প্রান্তিক মানুষদের মদ্যপানের আসক্তি দূর করতে, সশক্তিকরণ ও আত্মমর্যাদা জাগ্রত করার লক্ষ্যে, জলদূষণ রুখতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ব্যক্তিজীবন বা সামাজিক জীবন সার্বিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়াস জারি রাখতে প্রকৃতি ও সমাজের প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা খুব জরুরী। আর এইজন্য চাই প্রশ্ন করার আর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার বৈজ্ঞানিক মেজাজ। ততটুকুই গ্রহণীয় যতটুকুর সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, এই বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরী করার কাজটা সুচারুভাবে করেছিলেন তিনি।
মানুষের সাথে বন্ধুর মত মিশে, মানুষের জীবনসংগ্রামের সাথী হয়ে, মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সামিল করার প্রয়াস প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাজ। আর এই কাজে ঔদ্ধত্য নয়, সাহসী এবং বিনয়ী হতে হবে। সেই বিনয় আর সাহস সঙ্গী করে দাভেলকার গড়ে তুলেছিলেন মহারাষ্ট্র অনিস অর্থাৎ মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি। ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনে আপাদমস্তক কুসংস্কার বর্জন করা মানুষটি সমাজ জীবনেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চালিয়ে গিয়েছিলেন আপোষহীন লড়াই। বেশ কয়েকজন কুসংস্কারের প্রচারক গুরুবাবাজিদের ভন্ডামি ফাঁস করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। চলমান বিজ্ঞান ভ্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসারের অনন্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সর্বোপরি তৈরী করেছিলেন কুসংস্কার ও জাদুবিদ্যা বিরোধী আইনের সেই ঐতিহাসিক খসড়া যা সারা ভারতে যুক্তিবাদী মানুষের সংগ্রামের পাথেয়।
যুগে যুগে কোনো যুক্তিশীল চিন্তাধারার মানুষদের কাজ কখনও সহজ হয়নি। ওনার কাছেও এই কাজ সহজ ছিল না। বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বক্তৃতা বন্ধের চক্রান্ত, ম্যাগাজিন বিক্রি না করার ফতোয়া এমনকি প্রাণনাশের হুমকি নিয়েই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অকুতোভয় মানুষটির পুলিশি সুরক্ষাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
যদিও শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা হয়নি। দাভেলকার এবং তারপরও আরও কয়েকজন যুক্তিবাদী প্রগতিশীল মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী থেকে সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক। বিজ্ঞানীরা সোচ্চারে বলেছিলেন, “we, scientists now join our voices to Theirs (the writers) to assert that the Indian people will not accept Such attacks on reason, science and our plural culture. we reject the destructive narrow view of India that seeks to dictate what people will wear, think, eat and who they will love. we appeal to all other sections of society to raise their voice against the assault on reasons and scientific temper we are witnessing in India today.”
ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি দাভেলকারদের এই ‘Scientific temper’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরির প্রক্রিয়া আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। তাই এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আমরা এই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।