আমরা জানি পৃথিবী এবং সভ্যতা বিগত ২০০,০০০ বছর ধরে এটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সময়ের সঙ্গে প্রচুর পরিবর্তন অনুভব করেছে। মানব প্রজাতি মহাবিশ্বের বিপুল ১৩.৭ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) বছর বয়সের মাত্র ০. ০০১৫ % সময় ধরে অস্তিত্বে আছে। মানবতা সেই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দূর্জয় কাজকে জয় করেছে। আমরা আগুনের ব্যবহার ও শিকার করা থেকে, পুরো গ্রহে উপনিবেশ গঠন এর মত কাজ করেছি যা তুলনামূলক ভাবে মহাজাগতিক স্তরের দিক থেকে দেখলে চোখের পলক পড়ার থেকেও কম সময়য়ে। এর মধ্যে কিছু মহান চিন্তাশীল মস্তিষ্ক আধুনিক সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং এমন কিছু লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেছেন যা একসময় অসম্ভব আমাদের কাছে পুরোপুরি অসম্ভব ছিল, অন্তত সেটাই মনে করা হতো।
কিন্তু, বিগত ১৫০ বছরে আমরা পৃথিবীর মাটিতে সীমাবদ্ধ থাকা থেকে আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশী চাঁদে পদার্পণের যোগ্যতা অর্জন করেছি। মানবতার সাফল্য যথেষ্ট প্রশংসনীয়, তবে সেটা শুধুমাত্র আমাদের নিরিখে। বাস্তবে মহাজাগতিক পর্যায়ে আমাদের প্রযুক্তির থেকে উন্নত কোনো এলিয়েন প্রজাতির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হলে কী ঘটবে তা আমাদের কল্পনার অতীত।
১৯৬৪ সালে সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ 'নিকোলাই কারদাশেভ', অনুমানমূলক একটি লগারিদমিক স্কেলের ধারণা দেন যা কোনো সভ্যতা মোট যে পরিমাণ শক্তি উত্পাদন করতে পারে তার উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি সম্ভাব্য সভ্যতার স্তর পরিমাপ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই স্কেলটি থেকে ভবিষ্যৎ সভ্যতা কিরকম হবে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী 'করদাসেভ' তাঁর স্কেলটি তে তিনটি প্রকারের সভ্যতার কথা বলেন -
টাইপ ১
টাইপ ২
টাইপ ৩
তবে পরবর্তীকালে কিছু সম্প্রসারণ ও পরিবর্তন প্রস্তাবিত হয়েছে।
'কারদাসেভ' শক্তির উপর ভিত্তি করে সভ্যতার তিনটি স্তরকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
টাইপ ১: এই প্রকার সভ্যতাকে একটি গ্রহ সভ্যতাও বলা হয়। বলা বাহুল্য এটি আমাদের বর্তমান সভ্যতার মতো নয়।
এই সভ্যতা, তাদের গ্রহটিকে তার হোস্ট স্টার (আমাদের ক্ষেত্রে সূর্য) থেকে পৌঁছানো সমস্ত শক্তি সঞ্চয় এবং ব্যবহার করতে সক্ষম। এই বিপুল শক্তির পরিমাণ প্রায় 1.74 x 10¹⁷ ওয়াট হবে। পৃথিবীতে আধুনিক সভ্যতাকে টাইপ ১ সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করলে মানুষ উন্নত সভ্যতার সর্বনিম্ন স্তরেও স্থান পাবে না। আধুনিক মানব সভ্যতাকে স্কেল অনুযাই পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞানীরা 'কারদাসেভ স্কেলে' এক ধরণের বর্ধিত শূন্যের লাইনের সৃষ্টি করেছেন। যখন এই স্কেলটি প্রস্তাবিত হয়েছিল বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, 'ন্যাশভিলের' পদার্থবিদ 'কার্ল সাগান', কারদাসেভ স্কেল অনুযাই একটি সভ্যতার অবস্থান এবং সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য একটি গাণিতিক সূত্র তৈরি করেন। সূত্রটি হলো,
"K=(log₁₀ p-6/10)"
যেখানে 'K' একটি সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং 'P', ওই সভ্যতা যতটা পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে তার পরিমাণ নির্দেশ করে।
২০১৮ সালে বিশ্বের মোট শক্তি খরচের পরিমাণ ছিলো ১৮.৪০ টেরাওয়াট, এখন এই সংখ্যাটিকে 'P' তে যুক্ত করলে কারদাশেভ স্কেলে আমাদের সভ্যতার রেটিং হবে প্রায় ০.৭৩।
যদিও আমাদের গ্রহটির কয়েক বিলিয়ন মানুষ নিয়ে একটি সভ্যতা রয়েছে,আমরা পৃথিবীর কক্ষপথে সফল ভাবে স্যাটেলাইট স্থাপন করেছি, মহাকাশযানে চড়ে চাঁদে অভিযান করেছি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন তৈরি করেছি, কয়েকশো মিলিয়ন(১ মিলিয়ন=১০লক্ষ্য) কিলোমিটার ব্যায় করে অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলকে উপনিবেশ করার দাবি করেও আমরা এখনও কারদাশেভ স্কেলে '১' ও স্কোর করতে পারিনি।
'কার্ল সাগান' অনুসারে মানবতা, সভ্যতার সবে প্রযুক্তিগত কৈশোরের ধাপ পেরিয়েছে।
জাপানের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী 'মিচিও কাকু'র দাবি অনুযায়ী মানুষ যদি প্রতি বছর গড়ে ৩% হারে শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে যায় তাহলে পরবর্তী ১০০ থেকে ২০০ বছরে 'টাইপ ১' স্ট্যাটাস, কয়েক হাজার বছর পরে 'টাইপ ২' স্ট্যাটাস এবং ১০০,০০০ থেকে ১ মিলিয়ন বছরে 'টাইপ ৩' স্ট্যাটাস পেতে পারে।
আমরা পরের দু'শো বছরে 'টাইপ ১' সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং এটি মানবতার পক্ষে এক বিশাল পদক্ষেপ। 'কার্দাসেভ' অনুযাই এই ধরণের সভ্যতায়(টাইপ-১) আমাদের নিজস্ব গ্রহের উপর আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, সম্ভবত আমরা আবহাওয়ার পরিবর্তনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। অর্থাৎ weather control করতে সক্ষম হব। আমাদের নিজস্ব গ্রহের ভূতাত্ত্বিক মেকআপ নিয়ন্ত্রণ এবং আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম হব। যদিও পরবর্তী টাইপ সভ্যতার তুলনায় এই পরিমাণ ক্ষমতার পরিমাণও সামান্য।
টাইপ ২: এই প্রকার সভ্যতাগুলিকে একটি উজ্জ্বল সভ্যতা হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, এই সভ্যতা তাদের হোস্ট স্টার এর মোট শক্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে সক্ষম। নক্ষত্রের পুরো শক্তির আউটপুটকে একত্রিত করে ব্যবহার করার জন্য একটি জনপ্রিয় তাত্ত্বিক (theoretical) যন্ত্র (device/machine) হলো 'ডাইসন স্ট্রাকচার' বা 'ডাইসন স্ফিয়ার'। অনেক জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান কাহিনী ও সিনেমাতে এই ডিভাইস আগেও দেখে থাকতে পারেন।
১৯৬০ সালে আমিরিকান পদার্থবিদ 'ফ্রিম্যান ডাইসন' এই স্ট্রাকচারের ধারণা দেন। মূলত এটি নক্ষত্রের চারপাশে নির্মিত বিশাল আকারের একটি উন্মুক্ত ফাঁপা গোলক যা নক্ষত্র থেকে নির্গত বিপুল শক্তি কে সম্পূর্ণভাবে সংগ্রহ করবে। টাইপ ২ সভ্যতার শক্তির আরেকটি উৎস হলো নিকটবর্তী 'ব্ল্যাক হোল'- এর 'অ্যাক্রেশন ডিস্ক' থেকে নির্গত ফোটন সংগ্রহ করা। এখন, কোনও সভ্যতা কীভাবে, কোন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকহোলের অ্যাক্রেশন ডিস্ক থেকে শক্তি সংগ্রহ করবে আমাদের চিন্তাভাবনার বাইরে। যাইহোক, একটি টাইপ ২ সভ্যতা কেবল এই রকম অবিশ্বাস্য আকৃতির স্ট্রাকচার তৈরি করবে তা নয়, তারা তাদের সৌরজগতের যেকোনো গ্রহে ইচ্ছেমত উপনিবেশ গঠন করবে এবং গ্রহোগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, গ্রহাণুগুলিকে খনন করবে,বিভিন্ন গ্রহে ভ্রমণ বানিজ্যিক স্তরে নিয়ে যাবে, এক কথাই তাদের সৌরজগতের অভ্যন্তরে তারা যা ইচ্ছে তাই করবে।
বলা বাহুল্য যেমন আমাদের বর্তমান সভ্যতার সাথে কোনও টাইপ ২ সভ্যতার তুলনা চলে না তেমনি টাইপ ১ সভ্যতার সাথে কোনো টাইপ ৩ সভ্যতার তুলনা করার মত কিছুই নেই।
টাইপ ৩: একটি টাইপ 3 সভ্যতা যা গ্যালাকটিক সভ্যতা হিসাবেও পরিচিত, এই সভ্যতা তাদের সম্পূর্ণ হোস্ট গ্যালাক্সির (ছায়াপথের) মোট শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই সভ্যতা যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করবে তা সত্যই ভীতিজনক (অন্তত আমাদের কাছে), যা শুনতে অনেকটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার মত।
তারা টাইপ ২ সভ্যতার মতোই চূড়ান্তভাবে কাজ করবে, গ্রহ এবং গ্রহাণু মাইনিং (খনন) করবে, ডাইসন স্ফিয়ার বা তারথেকেও অ্যাডভান্স টেকনোলজি ব্যবহার করে নক্ষত্রের শক্তি সংগ্রহ করবে। এবং শক্তি সংগ্রহের জন্য তারা কেবলমাত্র একটি নক্ষত্র নয়, কোটি কোটি নক্ষত্র ব্যবহার করবে।
এই রকম শক্তিসমপন্ন একটি সভ্যতা পুরো গ্যালাক্সিতে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে। ছায়াপথ আপাতদৃষ্টিতে তাদের খেলার মাঠে পরিণত হবে। এইভাবে ধীরে ধীরে যখন শক্তির চাহিদা আরও বাড়বে তখন তারা প্রথমে নিকটবর্তী ব্ল্যাকহোলের শক্তি তারপর যখন চাহিদা আরো বাড়বে তখন তাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র অবস্থিত ‘সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল’ থেকে তারা শক্তি সংগ্রহ করবে। (যেমন, আমাদের আকাশগঙ্গা বা milkey Way গ্যালাক্সির কেন্দ্রে 'সাজেটেরিয়াস-A' নামক super massive back hole অবস্থান করছে, যার অতীব মাধ্যর্ষণ বলের প্রভাবে পুরো গ্যালাক্সি তার চারিদিকে ঘূর্ণয়মান)।
তবে তাদের (টাইপ 3 সিভিলাইজেসন এর জীব দের) শক্তির চাহিদার স্থায়ী সমাধান হতে পারে যদি তারা মহাজগতের সবথেকে ভয়ংকর, রহস্যময় এবং বিষ্ময়কর বস্তুসমূহের একটি ‘কোইজার’ অথবা ‘কোয়াসার’ (কোয়াসি স্টেলার অবজেক্ট) এর শক্তি সংগ্রহ করতে পারে।