বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও আদালতের বিতর্কিত রায় – ফিরে দেখা
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 25, 2024 | | views :881 | like:0 | share: 0 | comments :0
“যুদ্ধক্ষেত্রের পরে আদালতের কক্ষই হলো সেই স্থান যেখানে ইতিহাসের সবথেকে জঘন্য অন্যায়গুলোর মধ্যে কিছু ঘটেছে।” - মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ১৯২২ সালের ২৪-এ জানুয়ারী আদালতে দেওয়া বিবৃতি।
“সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়”। দেশের একেবারে সামনের সারির এক গবেষণা সংস্থা CSIR গত ২১-এ নভেম্বর গর্বের সাথে ট্যুইট করে জানিয়েছে যে একদল বিজ্ঞানী প্রদর্শনী করে দেখিয়েছেন কিভাবে ২০২৪ সালের রামনবমীর দিন অযোধ্যার রামমন্দিরে রামলালার মূর্তির উপরে সূর্যের আলো এসে পড়বে। এই খবরটায় যাঁরা ভীষণ অবাক হয়েছেন, দুই বছর আগের এই খবরটা হয়তো তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল যে – প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী ‘শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্ট’ এমনভাবে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি করবে যাতে প্রতি বছর রামনবমীর দিন রামলালার মূর্তির উপর সূর্য রশ্মি এসে আছড়ে পড়ে (টাইম্স অফ ইন্ডিয়া, ১৭ নভেম্বর ২০২০)। তারপর থেকেই সেই ট্রাস্ট এই ব্যাপারে CSIR-এর সাহায্য নিয়ে চলেছে। আরও এক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক।
৯ নভেম্বর ২০১৯ – বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়ে রায় জানালো সুপ্রিম কোর্ট। ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইত্যাদির মুখে কালি মাখিয়ে অবসান হলো কয়েক দশক পুরোনো এক বিতর্কের। আরও অতীতে যাওয়ার আগে বরং এই বিতর্কিত রায় নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক।
রায়ের শেষে একটা সংযোজনে স্পষ্টই জানানো হয়েছে যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দুদের “বিশ্বাস”-এর উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দুরা যেহেতু “বিশ্বাস” করেন যে বাবরি মসজিদের ঐ নির্দ্দিষ্ট অক্ষ্যাংশ-দ্রাঘিমাংশেই রামলালা-র জন্ম সেহেতু ভগবান শ্রী রাম ঐখানেই জন্মেছেন, এবং তাই “মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে”। মন্দির ভাঙ্গার আগে RSS-BJP ঠিক এটাই বলে এসেছে। যেমন, ৫ জুন ১৯৮৯-এ একটা চিঠিতে বাজপেয়ী লিখেছিলেন, “রাম ঠিক কোনখানে জন্মেছিলেন সেটা নির্দ্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়”; লালকৃষ্ণ আডবানী ১ অক্টোবর ১৯৯০-এ বলেছিলেন, “এটা যে শ্রী রামের জন্মস্থান সেটা কেউই প্রমাণ করতে পারবেন না”, কারণ এটা বিশ্বাস, আর বিশ্বাসকে কি প্রমাণ করা যায়! RSS-সুপ্রিমো এম.ডি.দেওরাস তো ১১ জুন ১৯৮৯-এ লিখেইছিলেন যে, “এটা এমন বিষয়ই নয় যেখানে আইনব্যবস্থা নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে পারে।” কিন্তু তিরিশ বছর পরে তাঁদেরকেও হয়ত অবাক করে দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদালত! কারণ, “... হ্যায় তো মুম্কিন হ্যায়”। তাই সর্বোচ্চ আদালত এই রায়ের মূল্যায়নে জানিয়েছে, “মসজিদ নির্মাণের আগে থেকে এবং পরবর্তীকালে হিন্দুদের সর্বদাই বিশ্বাস ছিল যে, ভগবান রামের জন্মস্থান হলো সেই স্থান যেখানে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এবং এই বিশ্বাসের পক্ষে লেখ্য ও মৌখিক প্রমাণও আছে।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice]। এখানে লেখ্য প্রমাণ বলতে কিছু ধর্মীয় পুঁথির কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে RSS-এর পোষা ঐতিহাসিকরা বাদ দিয়ে বাকি সকলেই সন্দিহান, এবং মৌখিক প্রমাণ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই “বিশ্বাস”-কে। তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হল, সাধারণত প্রথা অনুযায়ী একটা রায়ের শুরুতে রায়দাতাদের নাম উল্লেখ করা থাকে; এক্ষেত্রে যেটা নেই। রায়ের নিচে পাঁচ বিচারপতির সই থাকলেও, রায়ের সংযোজনে যেখানে “বিশ্বাস”-এর উপর জোর দিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে সেখানে কারও সই নেই! [দেখুন – Secularism at stake ]। প্রশ্ন থেকেই যায় যে তাহলে কি রায়দাতারা কি নিজেরাই নিজেদের এই রায়কে “বিশ্বাস” করেন না?
সবটাই যখন “বিশ্বাস”-এর ভিত্তিতে তখন মামলার খুঁটিনাটি নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় করে লাভ নেই। কিন্তু তাও কিছু কথা না বললেই নয়। যেমন, এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল ১৮৮৫ সালে। বাবরি মসজিদের চৌহদ্দির ভিতরে ১৮৫৫ সালে একটা চবুতরা নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং প্রার্থনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিমদের বিবাদ বন্ধ করার জন্য চবুতরা আর মসজিদের মধ্যে প্রাচীরও তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকে সেই প্রাচীরের ভিতরে মসজিদে মুসলিমরা প্রার্থনা করেন, এবং বাইরে রাম-চবুতরাতে হিন্দুরা প্রার্থনা করেন। সেই রাম-চবুতরাকে রাম জন্মভূমি হিসাবে দেখিয়ে মন্দির নির্মাণের প্রথম আর্জি শুরু হয় ১৮৮৫-৮৬ সাল নাগাদ। এই সংক্রান্ত সেই সময়ের প্রতিটা মামলায় রাম জন্মভূমি হিসাবে চবুতরাটাকেই বিবেচনা করা হয়েছে, একবারের জন্যও বাবরি মসজিদ এই বিতর্কের মধ্যে আসেনি। হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রথম দিককার পথিকৃৎ – সাভারকার, বালগঙ্গাধর তিলক, মদন মোহন মালব্য, বা লালা লাজপত রাই – কাউকেই কখনও শোনা যায়নি বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণের দাবি জানাতে। [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়েছিল – এই আখ্যানও আসলে সাম্প্রতিক; ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোর লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসকদের মদতে রচিত বিকৃত ইতিহাসের একটা অংশ। বাবরি মসজিদ তৈরি হয় ১৫২৮ সালে। যদিও, ‘বাবরনামা’-তে মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি হয়েছে বা রাম-জন্মভূমিতে মসজিদ তৈরি হয়েছে – এমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। সপ্তম শতাব্দীর হিউয়েন সাং-ই হোক, বা একাদশ শতকের আলবেরুনী – কারো রচনাতেই অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করতে দেখা যায় না। তবে সেইসব বাদ দিন! হিন্দু রাষ্ট্রের জনতা ম্লেচ্ছদের লেখা ইতিহাসে বিশ্বাস করবেনই বা কেন! কিন্তু বাবরি মসজিদ যদি সত্যিই মন্দির ভেঙে তৈরি হত তাহলে অন্তত ১৫৭৪ সালে তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিতমানস’-এ তার কিছু উল্লেখ বা আভাস নিশ্চই থাকত! তা না হলে যে বলতেই হয় তুলসীদাস ‘সাচ্চা হিন্দু’ ছিলেন না! যাইহোক, সেই আমলের বিভিন্ন সংস্কৃত পুঁথিতে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে অযোধ্যার উল্লেখ থাকলেও সেটাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করার নিদর্শন পাওয়া যায় না। যে ‘স্কন্দ পুরাণ’ নিয়ে এতো হৈচৈ সেখানেও অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি বললেও নির্দ্দিষ্ট করে অযোধ্যার ঠিক কোনখানে রামলালা জন্মেছিলেন সেই কথা বলা নেই। [দেখুন – ASI's archaeological findings in Ayodhya: Short shrift to facts]। ‘স্কন্দ পুরাণ’-এর রচনা আনুমানিক ১৬০০ সালে। তাহলে ১৫২৮ সালে সত্যিই যদি মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হতো তাহলে কি সেই কথা বড় বড় অক্ষরে ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ লেখা থাকতো না? “আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে”!
এমনকি একটা আরও মজার প্রশ্ন হল অযোধ্যার রাম-জন্মভূমিতে ঠিক কোন রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন? এ.কে. রামানুজন-এর বিখ্যাত গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণ্স’ থেকে জানা যায় যে বীর নায়ক রাম-কে ঘিরে ৩০০-টারও বেশি ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান ভারত ও এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মূল রামায়ণ বলে কিছু হয় না, এবং বাল্মীকির রামায়ণ হিসাবে যেটা জনপ্রিয় সেটাও আসলে এই ভিন্ন ভিন্ন আখ্যানগুলোর মধ্যে একটা। উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ জাতক কাহিনী দশরথ জাতক-এর কথা বলা যেতে পারে। এই আখ্যান অনুযায়ী রাম আর সীতা ভাই-বোন, এবং নির্বাসিত জীবনের পর রাম নিজের বোন সীতাকে বিয়ে করেন। এই আখ্যান উপজাতীয় সমাজের একটা আদিম পর্যায়কে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে যেখানে একই প্রজন্মের একই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক একটা ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরনের গবেষণামূলক প্রবন্ধ RSS-BJP-র পছন্দ নয়। কারণ, এই জাতীয় তথ্য RSS-BJP-র রাম-কেন্দ্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। RSS-BJP-র ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রাম তাঁদের মতোই বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী। অন্য রাম-এর উপস্থিতি তাঁদের রাম-এর কাছে অস্তিত্বের সংকট হয়ে ওঠে। সেই কারণে হিন্দুত্ব বাহিনীর ক্রোধের সম্মুখীন হওয়ার পরে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে এই প্রবন্ধকে বাদ দেওয়া হয়।
এছাড়া, RSS-BJP-র দাবির উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ সাল থেকে অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। আজ পর্যন্ত মন্দির ধ্বংসের কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ নিজেদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই প্রতিবেদনগুলির সমালোচনা করে সেগুলোকে খণ্ডন করেছেন। যদিও সেই ‘বিশেষজ্ঞদের’ কাছ থেকে পাল্টা কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এমনকি এই লজ্জাজনক বিষয়টাও উল্লেখ না করলেই নয় যে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই
‘বিশেষজ্ঞ’ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কয়েকজন মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির নির্মাণের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন!
২০০৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) দ্বারা নতুন করে খনন করার নির্দেশ দেয়, যেটা সেই সময়ে সম্পূর্ণরূপে BJP-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। যাইহোক, এমনকি ASI রিপোর্টেও কোন মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে নিজের প্রভুদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ASI ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মসজিদের ধ্বংসাবশেষের নিচে একটা বিশাল কাঠামোর উপস্থিতির কথা জানিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। খননের সময় ASI-এর আচরণ এবং তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটা ‘আলিগড় হিস্টোরিয়ান সোসাইটি’ সমেত অনেকের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক শিরিন রত্নাগর যথার্থই বলেছেন যে, “পরিস্থিতি, মন্দির নির্মাণের পক্ষে যুক্তির বিষয়বস্তু এবং যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এগুলো গড়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই যে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে পূরণ করার জন্য কিছু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন।” [দেখুন – Archaeology at the Heart of a Political Confrontation, pp. 243]।
সুতরাং, বলাই বাহুল্য যে মসজিদ ভেঙে রাম মন্দিরের নির্মাণের দাবি নোংরা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়, যার সূত্রপাতও এক ডিসেম্বর মাসে, ১৯৪৯ সালের ২২-এ ডিসেম্বর। ফৈজাবাদ-এর তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ২৫ এপ্রিল ১৯৫০-এ নিজের লিখিত বয়ানে আদালতকে জানান যে, “মামলার সম্পত্তিটা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত, এবং এটা দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের উপাসনার উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা শ্রী রাম চন্দ্রজীর মন্দির হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি। বরং ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এর রাতে, শ্রী রামচন্দ্রজীর মূর্তিগুলি গোপনে এবং অন্যায়ভাবে এর ভিতরে স্থাপন করা হয়েছিল।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। এই রাজনৈতিক নোংরামোর ধারাবাহিকতাই পরিণতি পায় ১৯৮০-র দশকে, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’-এর (VHP) হাত ধরে। আর তখন শুধু বাবরি মসজিদ-ই নয়, সাথে মথুরা ও বারাণসী-র দুটো মসজিদ ধ্বংসের ডাক দেওয়া হয়। এই রাম মন্দির নির্মাণের দাবি যে নিখাদ রাজনীতি সেকথা RSS-BJP-র নেতাদের কথাতেও একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছে।
১১-ই জুন, ১৯৮৯-এ আডবাণী বলেন, “আমি নিশ্চিত যে এসবের কারণে অনেক ভোট পাওয়া যাবে।” ১৮-ই জুন ১৯৯১-এ তিনি স্পষ্টই জানান যে, “আমি যদি রামের তাসটা ঠিকঠাকভাবে না খেলতাম, তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে নিউ দিল্লী নির্বাচনী এলাকা থেকে হারতাম।” নিজের আত্মজীবনী ‘মাই কান্ট্রি মাই লাইফ’-এও তিনি এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম আগ্রাসনের ইতিহাসের আলোকে অযোধ্যাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং তারপর এর সাথে সমান্তরালভাবে মন্দির আন্দোলনের বৈধতা খোঁজা।” এমনকি সুষ্মা স্বরাজ পর্যন্ত ১৪-ই এপ্রিল, ২০০০-এ স্বীকার করেন যে রাম-জন্মভূমি আন্দোলন ছিল “নিখাদ রাজনৈতিক এবং এর সাথে ধর্মের কোনো যোগ ছিল না।” [দেখুন – How a Mosque Became a Temple ]।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দশ দিন পর ভারত সরকার কর্তৃক যে ‘লিবারহান কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল সেই কমিশনের রিপোর্টেই এই নোংরা রাজনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল, “[মসজিদ ধ্বংসের] প্রস্তুতিটা অসাধারণ রকমের গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছিল, এবং ধারাবাহিকতা ও নিশ্চিত ফলাফল সমেত সেটা ছিল প্রযুক্তিগতভাবে ত্রুটিহীন। ... মূল বিষয় ছিল ক্ষমতা। গোপন উদ্দেশ্যের সমর্থনে তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল এই ক্ষমতা। নেতারা জানেন কিভাবে আবেগকে জাগ্রত করা হয় এবং কিভাবে সেটা প্রতিরোধ করা হয়; দেশের জন্য কোনটা ভালো হতো সেটার বদলে বরং তাঁরা সর্বদা এটাই দেখেন যে তাঁদের নিজেদের জন্য কোনটা ভালো হবে। অযোধ্যাতেও সেটাই হয়েছে।” [পাতা ৩৭৬ (৬১.৩০, ৬১.৩১); অথবা, দেখুন – There Stood a Mosque in Ayodhya, and it was Demolished ]। ২৭ বছর পর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যে বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে এই দীর্ঘ মন্দির-মসজিদ সমস্যার সমাধান ঘটানো হলো সেই রায় প্রসঙ্গেও একই কথা বলা চলে। দেশের জন্য যেটা ভালো হতো সেকথা না ভেবে শাসকশ্রেণীর অন্যায্য দাবির কাছে, ক্ষমতার কাছে মাথা নত করল ন্যায়বিচার।
মসজিদ ধ্বংসের জঘন্য ঘটনা এবং এই সর্বোচ্চ আদালতের এই বিতর্কিত রায় – দুটোরই যে নিন্দা জানানো প্রয়োজন তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বোঝা প্রয়োজন যে ঠিক কোন বৃহত্তর অদৃশ্য ক্ষমতা এই ঘটনাক্রমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ১৯৯০-এর অর্থনৈতিক সংকট, IMF-এর হস্তক্ষেপ, তারপর সেই তথাকথিত ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’-এর মাধ্যমে বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে বিদেশী লগ্নির জন্য ভারতের বাজারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক শোষণের পথ প্রস্তুত করা, এবং সেইসব থেকে ভারতের মেহনতী জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্ম আর বিশ্বাসের নামে তাঁদেরকে বিভক্ত করে দেওয়া, যার চূড়ান্ত পরিণাম RSS-BJP-র নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী বাহিনী কর্তৃক বাবরি মসজিদ ধ্বংস – এই ঘটনা গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। সেই সময় কেন্দ্রের গদিতে বসে থাকা কংগ্রেস সরকারের ভূমিকাকেও সামনে আনা প্রয়োজন। প্রথমে শাহ্-বানো মামলায় বিতর্কিত রায় ও বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে একটা অশান্তির প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া এবং তারপর নিজের সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ১৯৯২ সালের ৬-ই ডিসেম্বর মসজিদ ধ্বংসের নারকীয় উল্লাসকে চুপটি করে উপভোগ করা – কংগ্রেস সরকারও নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। অরুন্ধতী রায় যথার্থই বলেছেন, “৯০-এর দশকের শুরুর দিকে দুটো তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল – একটা বাবরি মসজিদের এবং আরেকটা বাজারের [অর্থনীতির উদারীকরণ]। এই দুটো তালা খুলে দিয়ে তাঁরা দুই ধরণের মৌলবাদকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন – একটা ধর্মীয়, আরেকটা অর্থনৈতিক।” [দেখুন – Attempt to Destroy Gujarat Riots Legal Trail]। জনগণের উপর নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির আক্রমণ আজকে আরও তীব্র হয়েছে, এবং শাসক শ্রেণী আজকের দিনেও হিজাব-হালাল ইত্যাদি কু-তর্কের চিৎকারে জনগণের ন্যায্য দাবির আওয়াজকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এই দুই মৌলবাদকে আবার তালাবন্দী না করতে পারলে তাদের অশুভ আঁতাত থেকে জনগণের মুক্তি নেই।