গল্পের ফাঁকফোঁকর: সদ্যজাত কৃষ্ণের যমুনা অতিক্রম।

Guitar K Kanungo


Dec. 20, 2024 | | views :69 | like:16 | share: 3 | comments :0

বাসুদেব কৃষ্ণ হিন্দুদের পরম আরাধ্য। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। বলা হয়, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য তাঁর এই অবতীর্ণ হওয়া। শ্রাবণ মাসের অষ্টমী তিথিতে এক প্রবল বর্ষণের রাতে তাঁর জন্ম হয়েছিল মথুরার এক কারাগারে। তাঁর জন্মের কয়েক বছর আগে দৈববাণী হয়েছিল, তাঁর মায়ের অষ্টম সন্তানের হাতে সেই সময়কার মথুরার দুরাচারী রাজা কংসের মৃত্যু হবে। ফলত তাঁর জনক বসুদেব এবং জননী দেবকীকে কারারুদ্ধ করা হয়, এবং কৃষ্ণের জন্মের আগেই এই দম্পতির যেসব সন্তান জন্মেছিল, তাদের সবাইকে দুরাচারী কংস জন্মের পরপরই হত্যা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি কংস দেবকী এবং বসুদেবের এতগুলো সন্তানকে হত্যা করেছিল? এই দৈববাণী যখন হয়েছিল, তখন দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়েটা সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। এই সময় দেবকী অথবা বসুদেব, দুজনের একজনকে হত্যা করলেই এই দৈববাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করা যেত। কেউ কেউ বলবে দেবকী উগ্রসেনের কন্যা; কংস ইতোমধ্যে উগ্রসেনকে সরিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছে এবং সম্পর্কে দেবকী কংসের বোন - এরকম অবস্থায় দেবকীকে হত্যা করা বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। একই কথা বসুদেবের ক্ষেত্রেও খাটে; বসুদেব ছিলেন সংঘমুখ্যদের একজন, তাঁকে হত্যা করাটাও সহজ ছিল না।

ভালো কথা, কিন্তু এদের দুজন অথবা দুজনের যেকোনো একজনকে হত্যা করার মধ্যে ঝুঁকি ছিল। তবে এদের দুজনের কাউকে হত্যা না করেও কংস তাঁর জীবনের উপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, সেটা 'নিউট্রালাইজ' করতে পারতেন। বসুদেবকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেই সমস্ত ল্যাঠা চুকে যেত। দেবকীর গর্ভধারণের সুযোগ তৈরি না হলেই তো কংসের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তিনি এই সহজ কাজটা না করে যে কাজটা করলেন, তাতে কংস নিজেই নিজের মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত করলেন। তিনি দুজনকেই কারারুদ্ধ করলেন। শুধু তাই নয়, দুজনকে একই সঙ্গে বসবাস করতে দিলেন। দেবকী একের পর এক গর্ভধারণ করলেন এবং কংস শিশু হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করে গেল বছরের পর বছর।

এই বুদ্ধিটা কংসের মাথায় কেন এলো না, সেটা কংসই ভালো বলতে পারবেন। এদিকে যথাসময়ে দেবকী গর্ভধারণ করলেন। কৃষ্ণের জন্ম হলো; আগেই বলেছি, তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার। কংসের হাতে মরবার জন্যে তিনি জন্মাননি, কংসকে হত্যা করবার জন্যেই তিনি জন্মেছেন। নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করলেন। কারারক্ষীদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই ফাঁকে পিতা বসুদেব নবজাত কৃষ্ণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার জন্য যাতে পরদিন সকালে এসে কংস এই সন্তানকেও হত্যা করতে না পারে। বসুদেব ঝড়ের রাতে যমুনা নদী পেরিয়ে ওপারের বৃন্দাবনে পৌঁছালেন, যেখানে তাঁর বন্ধু নন্দরাজ থাকতেন।

বৃন্দাবন যাবার পথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটবে। বর্ষা মৌসুম থাকার কারণে যমুনার জল অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বসুদেবের পক্ষে হেঁটে যমুনা পার হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু যমুনার জলে কৃষ্ণের পায়ের ছোঁয়া লাগতেই যমুনার জল অনেকটাই কমে গেল। এতটাই কমে গেল যে এবার বসুদেব পায়ে হেঁটে পার হতে পারছিলেন। কিন্তু সমস্যা আরও ছিল। প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছিল। একটি ঝাঁকার মধ্যে সদ্যজাত শিশু কৃষ্ণকে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা করার জন্য এবার নাগরাজ বাসুকী এগিয়ে এলেন। তিনি পেছন থেকে ফণা তুলে ধরলেন যাতে কৃষ্ণের গায়ে জলের ছিটা না লাগে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের এইসব ঘটনা বড় ভালো লাগে। এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, ঘটার কোনো সম্ভাবনা ছিল কিনা, সেসব নিয়ে তারা ভাবতে রাজি নয়। তারা বিশ্বাস করে এরকমটাই ঘটেছিল।

অনেকেই বিশ্বাস করেন বাসুদেব কৃষ্ণ কেবলমাত্র একটা পৌরাণিক চরিত্র নয় ; তিনি সত্যিই জন্মেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষ্ণকে যদি যেভাবে বিশ্বাস করা হয়, অর্থাৎ একজন অবতার হিসাবে দেখি তাহলে যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হল সেসব ঘটতেই পারে। কিন্তু যদি তিনি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে তো যমুনার পানি কমে যাওয়া কিংবা বাসুকীর বৃষ্টির ছাট থেকে সদ্যজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করা, এসব অলৌকিক ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। সঙ্গত কারণেই যুক্তিবাদী মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেনা। তারা যমুনা পারাপার করার সময় এই ঘটনাগুলো আদৈ ঘটেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ প্ৰকাশ করে। 

সবচাইতে বিস্ময়কর যে কথাটা তারা বলছে, সেটা হলো বসুদেবকে আসলে যমুনা নদী পারাপার করতেই হয়নি, কারণ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যেতে যমুনা পারাপার করতে হয় না। বৃন্দাবন আসলে যমুনার এইপাড়ে, যে পাড়ে মথুরা অবস্থিত। বসুদেব হয়তো কিছুটা পথ যমুনার পাড়ের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নদী পার হয়ে অন্য পারে যেতে হয়নি। এই তথ্যটা হজম করা আমার জন্য বেশ কঠিন কাজ ছিল, কারণ যমুনার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের একটা গভীর সম্পর্ক বজায় থাকবে, অন্তত যতদিন তিনি বৃন্দাবনে ছিলেন, এবং সেই সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল তাঁর জন্মের ঠিক পর থেকেই। অথচ এখন শুনছি বসুদেবকে যমুনা পাড়ি দিতেই হয়নি।

এখন চাইলেই গুগল ম্যাপ খুলে এই জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কোন পথে যেতে হবে এবং যেতে কতটা সময় লাগবে, সেটা ঝট করে দেখে নেওয়া যায়। আমিও তাই করলাম। গুগল ম্যাপ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যাবার দুটো রাস্তার কথা বলছে, কিন্তু এর কোনটাই যমুনা নদীকে অতিক্রম করে নয়। আমি গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, দেখলাম এক বিশাল গহ্বর আবিষ্কার করে বসে আছি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929