বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি নিয়ে আজও প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা হিন্দুদের
রূপায়ণ ভট্টাচার্য
Nov. 20, 2024 | | views :813 | like:0 | share: 0 | comments :0
সন্ধ্যেয় মাথার ওপর মশারা গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করা না পর্যন্ত খেলা চলত আমাদের। দুই ক্লাসমেট হাসানুল্লা আর তফিকুল ফুটবল ম্যাচে এক টিমে থাকলে বড় ভরসা ছিল। বাবা স্টেশন যাতায়াত করত পাশের মুসলমান পাড়ার খয়রুল বা গোলাপের রিক্সায়। পাশের বাড়িতে কাজ করত মকবুল। ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে উঠলে ঘুরে বেড়াতাম হাটে, বাগানে। যতদূর মনে পড়ে, মকবুলের বিয়ে হয়েছিল আমাদের প্রাইমারি স্কুলের এক ক্লাসমেটের সঙ্গে। আমার কলেজ পড়ুয়া দিদি ছুটিতে গ্রামে এলে তাঁকে পড়াতে আসতেন শের মহম্মদ মাস্টারমশাই।
ছোটবেলায় শোনা সবচেয়ে খারাপ কথাটি ছিল, ‘ও কি বাঙালি, না মুসলমান?’ নজরুলের জন্মদিনের সপ্তাহে নজরুল পক্ষে এসে খেয়াল করি, সেই খারাপ কথাটির মৃত্যু ঘটেনি। এখনও সেই আজব কথা বলার মতো শিক্ষিত লোক অনেক। এখনও অনেকে সবিস্ময় হাততালি দিতে থাকে, বাঙালি মুসলিম পরিবারে রবীন্দ্র চর্চা হয় শুনে। এখনও যেন ওই আমলে পড়ে রয়েছি। যেখানে শৈশবের মতো হ্যাজাক-লণ্ঠন-ল্যাম্পই জ্বলে। মাঝে মাঝে আলো চলে যায়। অনেকে চেঁচিযে বলে, ‘জ্যোতিবাবু গেলেন।’
কে এঁদের বোঝাবে, হিন্দুদের মতো বাঙালি মুসলমানও কিশলয়-বর্ণপরিচয় পড়ে বড় হয়েছে। তারাও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক। পাড়ায় বীরপুরুষ বা লিচু চোর আবৃত্তি করেছে। স্কুলে অমল বা দইওযালা সেজেছে ডাকঘর নাটকে। বড়দের বিসর্জন, কালমৃগয়া দেখে শুনে নাটক বা গীতিনাট্য মুখস্থ করেছে। পঁচিশে বৈশাখে প্রভাতফেরিতে গলা মিলিয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে। আমাদের স্কুলে আবার শুক্রবার টিফিন ছিল এক ঘণ্টার--নমাজ পরার জন্য। অক্সফোর্ডের গবেষক, কালিয়াচকের ছেলে শাহনওয়াজ আলি রায়হান সেদিন লন্ডন থেকে ফোনে হাসল, ‘তুই বাঙালি না মুসলমান, প্রশ্নটা মালদা-মুর্শিদাবাদে কোনওদিন শুনতে হয়নি। শুনেছি বড় হযে কলকাতা গিয়ে।’
সেই কলকাতা---রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর এলাকায় উর্দুভাষী মুসলিম অনেক বেশি। বিহার, উত্তরপ্রদেশের মুসলিমরা বেশি সেখানে। তাই কলকাত্তাইয়াদের বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ধারণা কম। কলকাতা আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতির চাবুক হাতে ঘুরে বেড়ায়, জেলা শহরগুলো বিদ্রোহ না করে তার হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে রাখে কেন? তাই ‘সংস্কৃতিবান’ কলকাতা থেকে ভুল ধারণা ছড়াতে থাকে বাঙালি মুসলিম-হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে। সব পার্টির নেতারাও দায়িত্ব নেন। বরং জেলাগুলোয় এই সমস্যা কম। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়ে, একই ক্লাবে খেলে পরস্পরের জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা স্পষ্ট। শাহনওয়াজের স্ত্রী ইংল্যান্ডে ডাক্তারি করেন। তাঁরা ছোটবেলায় ছুটিতে হুগলি থেকে দল বেঁধে যেতেন শান্তিনিকেতন ঘুরতে। তাই মুসলিম ছেলের মুখে রবি ঠাকুর আবৃত্তি শুনলে জেলার হিন্দুরা বিস্মযে হাঁ হয়ে যায় না। অনেক মুসলিম শিক্ষক বাংলা পড়ান স্কুলে-কলেজে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, জীবনানন্দ তো তাঁদের বুকের মধ্যে গাঁথা। এপারে পত্রিকায় ঈদ সংখ্যা হয় না বলে, তীব্র অভিমান আছে। তবু পুজো সংখ্যা নিযে টানাটানি করেন। পুরোনো পুজোর গানে আজও ঘোর।
বাঙালির মৃতপ্রায় ঐতিহ্য ফুটবল আইসিইউতে অক্সিজেন পাচ্ছে বাঙালি মুসলিমদের সৌজন্যে। মইদুল-নাসির-নাজিমুল থেকে মেহতাব-নবি, রফিক-রহিম আলি-ফারদিন আলি মোল্লা। ঘাটালের দাশপুরের ছেলে মইদুল প্রথম বাঙালি মুসলিম তারকা ফুটবলার। তাঁর বাড়িতেই অনেক হিন্দু-মুসলিম বিযে হয়েছে। স্ত্রীও হিন্দু। মইদুল সহাস্য, ‘আমরা তো ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের মধ্যে বড় হয়েছি। এক পাড়ায় বাড়ি ছিল। ওদের বাড়িতে গিয়ে খেতাম।’ অথচ আজ, কলকাতায় এখনও বাঙালি মুসলিমের ঘর ভাড়া পাওয়া কঠিন। শিলিগুড়িতেও।
গ্রামবাংলায় বড় হওয়া বাঙালি মুসলিমরা বিরিযানির কথা শোনেননি অনেকদিন। ফিরনির কথাও। হালিম এখনও অপরিচিত খাবার উত্তরবঙ্গে। শাহি টুকরাও। তাঁরা তো একেবারে হিন্দুদের মতোই মাছ-ভাত-ডাল-তরকারি-ছ্যাঁচড়া-দই-বোঁদে-রসগোল্লা খেযে বড় হয়েছেন। বিযোড়িতে হত ঘি ভাত, লোকে বলত পোলাও। সংস্কৃতি থেকে জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস থেকে পোশাক-সব ব্যাপারেই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম এক। ব্যাপারটা বুঝতে আজও অনেকের ভুল হয়। মালদার দিকে এখনও শের শাহের সৈন্যদের বংশধররা রয়েছেন, শের শাহ বাদিযা বলে তাঁদের। মুর্শিদাবাদে পাবেন মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সঙ্গে আসা আফগান সেনার উত্তরসূরিদের। দুপক্ষেরই বাংলা সংস্কৃতিতে বড় হওযা। মালদার সুলতাননগরে মুসলিম গ্রামে এখনও রয়েছে শিবনাথ শাস্ত্রীর নামে লাইব্রেরি।
বসিরহাট ও একবালপুরে বড় হওয়া, বিশিষ্ট গায়ক কাজি কামাল নাসের গান বেঁধেছিলেন, ‘যে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, আজও সেখানেই দাঁড়িযে আছি/ প্রতিবেশী হযে দুজন কেন এলাম না কাছাকাছি।’ মেদিনীপুরের মইদুল, মালদার শাহনওযাজের মতো তাঁরও এক অভিজ্ঞতা। জেলার তুলনায় কলকাতাতেই এই বিভেদমূলক কথাবার্তা বেশি। এখনও একটা স্মৃতি ভোলেননি কামাল। বাসে যাচ্ছেন ববি হাকিম কলকাতার মেয়র হওযার দিন। এক সহযাত্রী আরেকজনকে বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত মুসলমানকে কলকাতার মেয়র করে দিল।’ ডালহৌসীর অফিসে পাশের সহকর্মী কাগজে পাকিস্তানের খারাপ খবর বেরোলেই গোল দাগ দিয়ে আড়চোখে তাকাতেন কামালের দিকে।
এপার বাংলার হিন্দু-মুসলিমদের আর একটা বড় মিল দেখতে পাই পড়শি বাংলাদেশের দিকে তাকালে। কোথাও কি আমরা দুপক্ষই একটু ঘরকুনো, নিজস্ব বৃত্তে স্বচ্ছন্দ, বেহিসেবি ছক ভাঙায় অবিশ্বাসী মানুষ? একটু ভীরু, একটু নরম ও কম পরিশ্রমী?
বাংলাদেশিরা ক্রমাগত বিদেশ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। বেআইনি পথে, আইনি পথে। সমুদ্রে জাহাজের খোলে লুকিযে ইউরোপ যেতে গিযে অনেকে যেমন চিরকালের জন্য হারিযে গিয়েছেন, তেমনই পর্তুগাল-স্পেনের এক একটা জায়গায় বিশাল সম্পত্তি কিনে ওপারের বাঙালিরা বানিয়ে ফেলছেন ছোটখাটো উপনিবেশ। লন্ডন-নিউ ইয়র্কের বাজার তাঁদের জন্যই ভরে উঠেছে বাঙালি খাবারে। বিশ্বে এমন ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা, অজস্র বিদেশি মুদ্রা আসছে দেশে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতি পৌঁছে যাচ্ছে অন্য উচ্চতায়। ১৯৯০-৯১ সালে বছরে ৭৬৩.৯১ মিলিয়ন ডলার অর্থ এসেছিল সে দেশে। ২০১৯-২০ সালে অঙ্কটা ১৮২০৫.০১ মিলিয়ন।
পদ্মাপারের বাঙালি কোনও দেশে আস্তানা পেলে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে চেনা আত্মীয় বন্ধুদের। যা মনে করায় মালযালি, তামিল বা পাঞ্জাবিদের। কেরল যেমন আরবের সোনায় ফুলে ফেঁপে উঠছে, বাংলাদেশও তাই। সৌদি আরব ও আমিরশাহি থেকে সবচেযে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে ঢাকায়। তারপর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কাতার থেকে। আমাদের এখানে বাঙালি মুসলিমরাও ঘর ছাড়েন চাকরির খোঁজে। গন্তব্য ভিনরাজ্য। অধিকাংশই শ্রমিকের কাজ। এখনও কিন্তু তাঁদের মাথায় বিদেশ নেই। কী জানি, মনে হয়, গঙ্গা পারের তুলনায় পদ্মাপারের হাওযায় সাহস শব্দটা বেশি ওড়ে। হয়তো যুদ্ধ এবং নতুন দেশের প্রাথমিক চরম দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা ওপারের বাঙালি মুসলিমের মনের মরিযা ভাবকে আরও আগুন দিয়েছে।
দক্ষিণবঙ্গে বড় হযে উত্তরবঙ্গে কাজে আসা এক বাঙালি মুসলিম তরুণ বলছিলেন, ‘পাড়ায় বড় হওযা আর মহল্লায় বড় হওযার মধ্যে মনোভাবের ফারাক হয়।’ কথাটা নির্মম সত্যি। পাড়ায় সবার সঙ্গে বড় হলে উদারতা জন্মায় সব পক্ষেরই। প্রত্যেক গোষ্ঠীর আলাদা মহল্লা হলে বিচ্ছিন্নতার দড়িটা বেড়ে যেতে থাকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে। উত্তরবঙ্গেই একটা সময় জাঁদরেল মুসলিম নেতা ছিলেন, যাঁরা পুরো বঙ্গে পরিচিত। মালদায় গণি খান, দিনাজপুরে জয়নাল আবেদিন, কোচবিহারে ফজলে হক। গঙ্গা পেরোলে মুর্শিদাবাদে আবদুস সাত্তার। তাঁরা হিন্দু না মুসলিম, গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বাঙালি পরিচয়ই ছিল আসল। ফজলে ছাড়া সবাই প্রযাত। ছয় বছর আগে বাংলার মুসলিমদের সামগ্রিক দুরবস্থার যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন অমর্ত্য সেন, তা এই নেতাদের লজ্জায় ফেলার মতো। তথ্য বলছিল, বাংলায় যেখানে এক লাখ লোক পিছু ১০. ৬ পিছু মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, সেখানে মুসলমান প্রধান মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরে এই হার ৭.২, ৮.৫, ৬.২।
এখন শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সাধারণ মুসলিম য়খন বাংলা পড়াতে মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠান, অনেক নেতা তখন সন্তানদের পাঠান মাদ্রাসায়। জেনে মাথায় ঘোরে আর একটা তথ্য। ওপারের বাঙালি মুসলিম এখনও অক্সফোর্ডে পড়তে গেলেও নিজেরা বাংলায় কথা বলে, বাংলাভাষা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। এ পারের বাঙালির কোনও পক্ষই সেটা করে না। এখানে হিন্দু-মুসলিম, কলকাতা-জেলার খুব মিল।
আমাদের স্কুলে পণ্ডিত মশাই ছিলেন, ছিলেন মৌলভী মাস্টার মশাইও। সংস্কৃত পড়াতেন একজন, অন্যজন আরবি। স্কুল ছুটির পর শুধু উড়নি গায়ে পণ্ডিত মশাই বাড়ি ফিরতেন হাঁটতে হাঁটতে। পাশে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর যেতেন পাজামা, ফেজ টুপি পরা মৌলভী মাস্টারমশাই। শুধু বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান জানাতে। সেই দৃশ্যটা আজও চোখে ভাসে। যাবতীয় সব যন্ত্রণা মুছে যায় তখন।"