রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সুষম সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন ব্যতীত মানুষের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁর এই বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা পাই শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠায়।
শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশবান্ধব শিক্ষার একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে শিক্ষার্থীরা কেবল পঠনপাঠনেই নয়, বরং তাদের নৈতিক ও সৃজনশীল বিকাশেও অগ্রগামী হবে। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীরা মুক্ত আকাশের নীচে প্রকৃতির কোলে পাঠ গ্রহণ করত। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করলে শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তারা জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
শ্রীনিকেতন
শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ জীবনের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন, কৃষি আধুনিকীকরণ, এবং স্বনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। কৃষকদের জীবনের মানোন্নয়নে তিনি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও পদ্ধতির প্রচলন ঘটান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গ্রামগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, যাতে তারা শহরের উপর নির্ভরশীল না হয়।
বৃক্ষরোপণ উৎসব ও পরিবেশ সচেতনতা
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেন। এই উৎসবের মাধ্যমে তিনি মানুষকে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করেন। বৃক্ষরোপণ শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের উপায়ই নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মজবুত করার একটি প্রতীকী পদক্ষেপ।
লেখনীতে পরিবেশ ভাবনা
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য ও বক্তৃতার মাধ্যমে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি শহরের অতি-বাণিজ্যিকীকরণ এবং প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ জাপান যাত্রীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, "পৃথিবীর শহরগুলো প্রকৃতি ও মমতার মিলনে তৈরি হওয়া উচিত। কিন্তু বাণিজ্যিক চাহিদার কারণে শহরগুলো মানবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে।"
আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান পরিবেশ সংকটের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের ফলে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় তাঁর দর্শন আমাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে মানুষ সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পরিবেশ ভাবনা কেবল তাঁর সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সর্বজনীন এবং চিরন্তন। তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও পরিবেশ সচেতনতা আজও আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস ।
তথ্যসূত্র:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবেশ ভাবনা