বিভেদের বীজ ও স্থাপত্য ধ্বংস: বিজেপি ও বিবেকানন্দ
তন্ময়
Nov. 27, 2024 | | views :1013 | like:0 | share: 0 | comments :0
কিছুদিন আগে 'রাজপুত উত্তম সভা' আয়োজিত দশেরার অনুষ্ঠানে মিরাটের সারতানা বিধানসভার দুবারের প্রাক্তন বিধায়ক হিন্দু কট্টরপন্থী সঙ্গীত সোম বলেন,শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এটি বন্ধ করতে ভবিষ্যতে রাজপুত সম্প্রদায়কে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এই দাবি অবশ্য নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানিয়েছেন।
'গণবাণী'তে প্রকাশিত 'হিন্দু মুসলমান' নামক একটি প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,"..ন্যাজ যাদেরই গজায় তা ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক তারাই হয়ে ওঠে পশু।...মানুষ আর পশুতে পরিণত হয়েছে,তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে।...মনে হল পশুর ন্যাজ খসছে আর মানুষের গজাচ্ছে।"
বহুবছর আগে বিদ্রোহী কবি এই উক্তি করলেও তা আজও প্রাসঙ্গিক। চতুর্দিকে এই ন্যাজ গজানো রামভক্তের দল বিভেদের আগুনে মনুষ্যত্বের চিরন্তন আত্মীয়তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে চলেছে।
বিবেকানন্দ বলেছিলেন," মুসলমানগন যখন ভারতবর্ষে প্রথমে আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল আর তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে। ইহার কোনো প্রতিকার না হইলে হিন্দু দিন দিন আরো কমিয়া যাইবে। শেষে আর কেউ হিন্দু থাকিবে না।...... অতএব ওঠো, জাগো, পৃথিবীর আধ্যাত্মিকতা রক্ষা করিবার জন্য বাহু প্রসারিত কর।"
বিজেপির তাত্ত্বিকেরাও একই ধারণা পোষণ করেন। তারা মনে করেন খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
তাই জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে মৌলবাদ বিরোধী সাধারণ মানুষের চতুর্দিকে রচিত হল পরাধীনতার দেওয়াল। ক্ষমতার সার্চলাইট নিয়ম করে ঘুরতে শুরু করল। আমরা সকলেই নজরবন্দী হলাম।
ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতে,আধুনিক মানুষ আইনের নিশ্ছিদ্র বেড়ার ভেতর জন্মগ্রহণ করে। মানুষের দেহ ও মন দুটোই সর্বক্ষণিক নজরদারি মধ্যে আইনি নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
আমরা অবরুদ্ধ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার সব অবরুদ্ধ। কারণ ওরা সর্বক্ষণ নজর রাখছে।
ফুকো মনে করেন, ক্ষমতাতন্ত্রে বিচিত্রবিধি উপবিধি সন্দেহপ্রবণ পরিদর্শনের আওতায় স্কুল ব্যারাক হাসপাতাল ওয়ার্কশপ এর অবয়বে নজরদারির মধ্যে চলে আসে ব্যক্তির জীবন।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমজীবী জনতা নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত এতো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। পাশাপাশি এটাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে পুঁজিবাদ যখন ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হয় তখন চিন্তার জগতে অধ্যাত্মবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা, উগ্র জাতীয়তাবাদের স্টিমরোলার চালানো হয়। আর এই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে নজরদারি। চলে আক্রমণ।
লেনিন আর স্তালিন এর দর্শন থেকে আমরা শিখি, পুঁজিবাদ তার প্রথম যুগে গণতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদী স্তরে এসে সেই পুঁজিবাদ এখন গণতন্ত্রকে,ব্যক্তি স্বাধীনতার গলা টিপে ধরছে। মিলিটারি এবং বুরোক্রেসির উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার ঝান্ডা প্রতি মূহুর্তে পদদলিত কর্দমাক্ত করছে।
ফুকো বলেছেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে ওপর নজর রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ ও রাজনৈতিক সমস্ত আচরণের কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয় সেই মাপকাঠি লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়।
গো-রক্ষা সমিতি, হিন্দু বহেন বেটি বাঁচাও সংঘর্ষ কমিটির মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তীব্র নজরদারি চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর। মাপকাঠি লঙ্ঘন হলে নেমে আসছে শাস্তির খাড়া।
হিন্দু সমাজের ধর্মান্তকরণে আশঙ্কিত হয়ে স্বামীজি বলেছেন “এই দেখ না, হিন্দুদের সহানুভূতি না পেয়ে মাদ্রাজে হাজার হাজার পেরিয়া খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। মনে করিসনি কেবল পেটের দায়ে খ্রিস্টান হয়, হয় আমাদের সহানুভূতি পায় না বলে। অনাথ মেয়ে হাতে পড়লে তাদের আগে নিতে হবে। নইলে খ্রিস্টানরা সেগুলিকে নিয়ে যাবে।”
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন,...আর কোনও লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করলে সমাজে শুধু একটি লোক কম পড়ে তা নয় একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়।
শত্রু বৃদ্ধি কি কেউ কখনও চায়? হিন্দুত্ববাদীরাও চায়নি। তাই শুরু হল শত্রুদের ওপর আক্রমণ এবং প্রয়োজনে হত্যা।
হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ করে খ্রিস্টান করা হচ্ছে শুধুমাত্র এই সন্দেহে হিন্দু মৌলবাদী শক্তি বজরঙ দল পুড়িয়ে মারে গ্রাহাম স্টেইন্স এবং তার ৬ আর ১০ বছরের দুই পুত্রকে। মুসলমান ছেলেরা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে সন্দেহে খোলা হয় একটি হেল্পলাইন। একটি ফোন নাম্বার দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসা হয় এমন ঘটনা ঘটলেই যেন হেল্পলাইনে জানানো হয়। আরএসএস ফয়সালা করবে।
সংবিধানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেয়েদের মনে ভীতির সৃষ্টি করা হল। নিজে পছন্দ মত বিয়ে নৈব নৈব চ। চলল কড়া নজরদারি।
ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে মহম্মদ আখলাখকে বাড়িতে ঢুকে পিটিয়ে মারা হল। গুরুতর আহত হলেন তার মা ও সন্তান। শ্রমিক মোহাম্মদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে খুন, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানের মৃত্যু, হরিয়ানায় কিশোর জুনেইদ খানকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, ট্রাকে করে গোমাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে জম্বু কাশ্মীরে উধমপুরে ট্রাক ড্রাইভার জাহিদ রসুলকে নৃশংস নিধন করা হল। হিমাচল প্রদেশ,হরিয়ানা সহ প্রায় সারা দেশে বিশেষ করে ভাজপা যেসকল রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেইসকল রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ধ্বংস হতে শুরু হল মনুষ্যত্ব, মানবতা।
ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান এর মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বিবিসি বাংলাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ প্রধান মীরন বোরওয়ানকার।
তিনি বলেছিলেন,"ইদানিং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে তা এদেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটাই তো দেখা যাচ্ছে। তাদের উপর হামলা হচ্ছে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না।
“ইয়ে তো স্রেফ ঝাঁকি হ্যায়,কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।” সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য কায়েমের উদ্দ্যেশ্যে ক্ষমতার আস্ফালনে উন্মত্ত করসেবকদের দ্বারা বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীদের নগ্ন উল্লাস।
কাশ্মীর ভ্রমণকালে ক্ষীর ভবানী মন্দির দর্শনের পর স্বামীজী তার মনের ভাব যে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শিষ্যার কাছে প্রকাশ করেছিলেন সেটা হল -"মা ভবানী এখানে সত্যই কতকাল ধরিয়া প্রকাশিত রহিয়াছেন। পুরাকালে যবনেরা আসিয়া তাহার মন্দির ধ্বংস করিয়া যাইল অথচ এখানকার লোকগুলো কিছু করিল না। তাই আমি যদি থাকিতাম তবে কখনো উহা চুপ করিয়া দেখিতে পারিতাম না।”
চুপ করে বসে ছিলেন না হিন্দুত্ববাদীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠল যে ষোড়শ শতাব্দীতে বাবরের আমলে যেখানে মসজিদ গড়া হয়েছে সেই অযোধ্যায় বহুকাল পূর্বে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামের মন্দির ছিল। তাই মসজিদ ভেঙে রামের মন্দির গড়ার সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার আগে থেকেই। শুধু অপেক্ষা করছিলেন অনুকূল সময়ের।
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ধর্মরক্ষার তাগিদে স্বামীজি বলেছিলেন "তোমরা যে শত শতাব্দীর অত্যাচার সহ্য করিয়া এখনও অক্ষতভাবে দাঁড়াইয়া আছো, তাহার কারণ তোমরা সযত্নে এই ধর্মরক্ষা করিয়াছো। এই ধর্মরক্ষার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষগণ সাহস পূর্বক সকলই সহ্য করিয়াছিলেন এমনকি মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন। বৈদেশিক বিজেতাগণ আসিয়া মন্দিরের পর মন্দির ভাঙিয়াছে কিন্তু এই অত্যাচার স্রোত যেই একটু বন্ধ হইয়াছে আবার সেখানে মন্দিরের চূড়া উঠিয়াছে।"
স্বামীজী আরও বলিয়াছেন,"অনেক গ্রন্থপাঠের যাহা না শিখিতে পারো, সোমনাথ মন্দিরের মত দাক্ষিনাত্যের অনেক প্রাচীন মন্দির তোমাদিগকে অধিকতর শিক্ষা দিতে পারে, তোমাদের জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে গভীরতায় অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। লক্ষ্য করিয়া দেখো, ওই মন্দির শতশত আক্রমণের ও শতশত পুনরুত্থানের চিহ্ন ধারণ করিয়া আছে, বারবার নষ্ট হইতেছে, আবার সেই ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হইয়া নূতন জীবন লাভ করিয়া পূর্বের মতো অচল অটলভাবে বিরাজ করিতেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ রামমন্দির সম্পর্কে একই মত পোষণ করে। হিন্দুত্ববাদী এই সংগঠনের মতে শ্রীরাম অযোধ্যায় অচল অটলভাবে বিরাজ করছেম, কিন্তু পূর্বের মত নয়। শ্রীরাম মন্দির সেখানেই নতুন জীবন লাভ করবে। ভব্য রাম মন্দির নির্মাণ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
অনুকুল সময় আসতেই এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করেনি রামভক্ত হনুমানেরা। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি শেষে জয় শ্রীরাম' হুঙ্কার ছেড়ে ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ।'
ধর্ম রক্ষা করেছিল রাম ভক্তরা। বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হয়ে রাম মন্দিরের নতুন জীবন লাভের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
গভীর আক্ষেপের সাথে বিবেকানন্দ বলেছিলেন "যদি তুমি অন্য কোনও দেশে গিয়া মুসলমানদিগকে বা অন্য ধর্মাবলম্বীগণকে তোমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতে বল, দেখিবে তাহারে কিরূপ সাহায্য করে। তৎপরিবর্তে তোমার মন্দির এবং পারে তো সেই সঙ্গে তোমার দেহমন্দিরটিও ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। এই কারণেই পৃথিবীর পক্ষে এই শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন.. ভারতের নিকট পৃথিবীতে এখনো বড় পরধর্মসহিষ্ণুতা শুধু তাহাই নয়,পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি শিক্ষা করিতে হইবে।”
ধর্মীয় রাষ্ট্রের জিগিরে মাতোয়ারা মৌলবাদীদের কাছে পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি অর্থাৎ পরধর্মসহিষ্ণুতা নিছক কথার কথা। ধর্মীয় উন্মাদনা থাকবে,অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে কিন্তু সন্ত্রাসের লেশমাত্র থাকবে না এটা সোনার পাথরবাটি। হিন্দুর শত্রু মুসলিম আর মুসলিমের শত্রু হিন্দু এই প্রকার সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিরোধের সৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি।
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে আরএসএস, বিজেপি, বজরং দল থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী শক্তি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯২২ সালে হিটলার একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন- "একজন খ্রিষ্টান হিসেবে ঈশ্বর তথা পরিত্রাতাকে আমি একজন যোদ্ধার রূপে দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই এমন এক মানুষকে তিনি একদা একাকী অল্পকিছু অনুচর পরিবৃত হয়ে ইহুদীদের চিহ্নিত করেন এবং তারপর বহু মানুষকে একত্রিত করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন এবং যিনি ঈশ্বর সাক্ষী, দুঃখভোগী নন, বরঞ্চ একজন মহান যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের একান্ত অনুরাগী হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে আমিই সেই অংশটি পড়ি যেখানে প্রভু অবশেষে শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করছেন আর চাবুক হাতে নিয়ে ঈশ্বরের মন্দির থেকে শয়তানদের কশাঘাত পূর্বক বিতাড়ন করছেন। ইহুদি বিষের বিরুদ্ধে কী সুমহান সেই যুদ্ধ। আজ ২ হাজার বছর পরেও তীব্র আবেগ মথিত করে আমি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে এই কারণেই তাকে ক্রুশের উপর রক্ত ঝরাতে হয়েছে। একজন খ্রিষ্টান হিসাবে আমি নিজেকে ধোকা দিতে পারি না।সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করার দায় আমার উপরেও বর্তায়।"
হিটলারের এই বক্তব্য থেকে যিশুর জায়গায় রাম,ইহুদির জায়গায় মুসলমান এবং খ্রিস্টধর্মের জায়গায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বসালেই কি অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় সেকালের হিটলার মুসোলিনির সাথে একালের আরএসএস,বিজেপির।
মহাকাব্যের রাম হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে প্রবেশ করেন রাজনীতির মহাকাব্যে। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির আঙিনায় নাৎসিবাদীদের যিশু আর হিন্দুত্ববাদীদের রাম মিলেমিশে একাকার।
ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে জয় শ্রীরাম হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক স্লোগান। এক পৌরাণিক চরিত্র 'রাম'কে নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি আসলে আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু আধিপত্যকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদ। সংখ্যালঘু বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে দমন করার এক ফ্যাসিস্ট কৌশল।
ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা বিস্তারের মাধ্যমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য তার জনমত তৈরি করা।
বিবেকানন্দের মতানুসারে,আমাদের ধর্মই আমাদের তেজ,বীর্য,এমনকি রাষ্ট্রিয় জীবনের মূল ভিত্তি। আমি এখন এই বিচার করিতে যাইতেছি না যে,ধর্মেই আমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তি স্থাপন করার পরিণামে আমাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ হইবে;ভালো হউক বা মন্দ হউক,ধর্মে আমাদের রাষ্ট্রিয় ভিত্তি রহিয়াছে,তোমরা উহা ত্যাগ করিতে পার না। চিরকালের জন্য উহাই তোমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তিস্বরূপ রহিয়াছে,সুতরাং আমাদের ধর্মে আমার যেমন বিশ্বাস আছে,তোমাদের যদি তেমন নাও থাকে,তথাপি তোমাদিগকে এই ধর্ম অবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবে। তোমরা এই ধর্মে বন্ধনে চির আবদ্ধ। যদি ধর্ম পরিত্যাগ করো তবে তোমরা চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে। ধর্মই আমাদের জাতির জীবনস্বরূপ, ইহাকে দৃঢ় করিতে হইবে।
ইতালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি,ঐক্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ম্যাৎসিনিরও চিন্তাধারা ছিল ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশিয়ে দেওয়া। ইতালির একত্রীকরণ হওয়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন যে ধর্ম ছাড়া কোনও জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতি সফল হবে না।
হিটলার,মুসোলিনি,গোয়েবলস,ম্যাৎসিনি প্রমুখেরাই তো আরএসএস ও বিজেপির পথপ্রদর্শক।তাই ধর্মের সাথে রাজনীতির একত্রীকরণের ভাবনা তাদের মতাদর্শের মধ্যে নিহিত।
পুঁজি আর শ্রমের দ্বন্দ্বকে ভুলিয়ে এই রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য এক ধর্ম রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা।
সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করতেই লাগাতার এবং লাগামছাড়া বিভেদের বীজ বপন এবং স্থাপত্য ধ্বংসের কর্মসূচী।