অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এর জাঁতাকল বাড়ছে
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 21, 2024 | | views :286 | like:2 | share: 2 | comments :0
দুর্গা দুর্গা, সাবধানে যেও, এইরে পল্টুর মা এই সময়ই তোমার হাঁচি পেলো! একটু দাঁড়িয়ে যা বাবা। রিন্টু বাবা চিন্তা করিসনা তোর বাবা ঠিক সেরে উঠবেন, যে ধন্বন্তরী ডাক্তার অস্ত্রোপচার করবে তাঁর হাতে আমাদের এখানে অনেক রোগী সুস্থ হয়েছে। সত্য সত্য সত্য, দেখ টিকটিকি টক টক করে সত্য ঘোষণা করলো। বোনপো রিন্টু আর ওর যুক্তিবাদী বন্ধু এসেছে বর্ধমান দুর্গাপুর থেকে। চিনার পার্কে মাসি বাড়িতে উঠেছে বাবাকে নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। মাসির কথা শুনে বেরোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো। কিরে, থেমে গেলি কেনো? ঐযে মাসি দেখনা এক শালিক, দাঁড়াও আর একটা শালিক আসুক তারপর বেরবো। একটু পরেই আরো তিনটে শালিক একসাথে এল। ছেলেটি বেরোবে এমন সময় মাসি বললো, বাবা ভুলে গিয়েছিলাম একদম, গতকাল ঠাকুর বাড়ি গিয়ে এই ফুল বেলপাতা আর মাদুলিটা নিয়ে এসেছিলাম, এটা জামাইবাবুর হাতে বেঁধে দিস। রিন্টুর বন্ধুর মুখ সারাক্ষণ ভার হয়ে আছে এইসব দেখে; রিন্টুও বুঝছে সেটা। কিন্তু কিছুই করার ছিলনা বলে এই যুক্তিবাদী পরপোকারি বন্ধুকে নিয়ে। মাসি কি বলছো?অস্ত্রোপচারের আগে দেহের সব কিছু খুলে নেবে না হলে ইনফেকশন হতে পারে। তাহলে বাবা, আচ্ছা জামাইবাবুর মাথায় ঠেকিয়ে জামাইবাবুর বিছানার নীচে রেখে দিস। এই তোর পায়ের কালো কারটা ঠিক মতো বাঁধ, খুলে যাবে যে। আচ্ছা মাসি, এবার চলি দেরী হয়ে যাবে। নিজেদের গাড়িতেই এসেছে এবং গাড়িতে উঠেই পায়ের কালো কার ঠিক করে নিল, গাড়ি নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ করে একটা জোরে ব্রেক কষলো, একটা কালো বেড়াল দ্রুত গতিতে রাস্তা পার হলো। আর একটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটতো। রিন্টু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল; তারপর গাড়ি থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। রিন্টুরা ধনী মানুষ, রিন্টুর হাতের আটটা আঙুলেই জ্যোতিষের দেওয়া নিলা, পলা, গোমেদ, রুবি প্রভৃতির আঙটি। বুড়ো আঙ্গুলে পরা যায়না তাই পরেনি। ওর বন্ধুর মুখের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে বসল।
এদিকে ওর হাসপাতালে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেছে, ওর বাবাকে অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানা স্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে, একটু পরেই অপারেশন রুমে নিয়ে যাবে। রিন্টু বাবার মাথায় মাদুলি –ফুল দুর্বা ঠেকিয়ে বিছানার নীচে রেখে দিল। এমন সময় ডাক্তারবাবু ও স্টাফেরা এলেন পেশেন্ট কে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রিন্টু ডাক্তারবাবুকে দেখে বাবার অবস্থার খোঁজ নিয়ে ডাক্তারবাবুকে শুধলো, বাবা সেরে উঠবেনতো? ডাক্তারবাবু বললেন, দেখুন আমরাতো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি, বাকিটা ওপরওয়ালার হাত। ঈশ্বরকে ডাকুন তিনিই আপনার বাবাকে সুস্থ রাখবেন। বন্ধুটি বলে উঠল আমরা পেশেন্ট কে আপনাদের ভরসায় এনেছি, ওপরওয়ালার ভরসায় নয়। রিন্টু বলল কি আজেবাজে বকছিস। বন্ধুটি বলল ওপরওয়ালার ভরসায় এতদূর এত দামী হাসপাতালে আনার দরকার কি? তোদের কথাতে ওপরওয়ালা সর্বত্র বিরাজমান ; দুর্গাপুরেও নিশ্চিত ওপরওয়ালা আছে? ডাক্তারবাবু বোধহয় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন; তারপর যুক্তিবাদী বন্ধুর দিকে এমন একটা তীর্যক দৃষ্টি হেনে অপারেশন রুমে চলে গেলেন। রিন্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য ঈশ্বরকে প্রণাম জানিয়ে বন্ধুকে নিয়ে রিসিপশানে এসে বসলো। সেখানে বিশাল টি ভী তে সাঁই বাবার বিভূতি দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। এখন প্রতি হাসপাতালেই দেবদেবীর থানে ভরা। রিন্টুর বন্ধু এসব দেখে বলল এবার হাসপাতালে না নিয়ে মন্দির মসজিদ গির্জাতে নিয়েই চিকিৎসা করালে হয়। দুজনে নানান কথা আলোচনা করছিল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে। মাঝে একবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে চা পান করে এসেছে। হঠাৎ রিন্টুর নামে ঘোষণা হলো, রিন্টুকে কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করতে বলছে। রিন্টু ওর বন্ধু ভয়ে ভয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারবাবু ওদের বসতে বললেন এবং বললেন, আপনার বাবার অবস্থা খুব ক্রিটিকাল, ভেন্টিলেশানে দেওয়া হয়েছে, ওনার কোভিড হয়ে গেছে ----আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টাই করছি, তবে বলতে পারছি না। এখন বাঁচা মরা সব ওপরওয়ালার হাতে।
আপনি বলতেই পারেন সোস্যাল মিডিয়া, ফেসবুকে যা খুশী লেখা যায় বলে আপনি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কারে খোঁচাখুঁচি করছেন। আর এইসব সংস্কার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখলেই কি মানুষ কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের গহ্বর থেকে উঠে আসবে? শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বা মৃত্যুভোজ তুলে দেবে, সমস্ত অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বর্জন করবে, জ্যোতিষবিদ্যা, গ্রহরত্ন, হস্তরেখা বিচার, মাদুলি কবচ জলপড়া ইত্যাদির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমবে? না, আমরা এসব এক্কেবারেই ভাবিনা যে আমার ফেসবুকের লেখা দেখে সবাই কাল থেকে পূর্বজন্ম, পরলোক, হাঁচি, দু’শালিক, বেড়ালের রাস্তা কাটা, কবচ মাদুলি, কালো কার লাল সুতো সম্পর্কে আমার ফেসবুকের বন্ধুরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। তবুও প্রচন্ড জলস্রোতের বিপক্ষে মাছেরা সাঁতার কাটে, জিওনার্দো ব্রুনোরা শয়তানদের আগুনে জ্যান্তো পোড়েন, চার্বাকেরা নির্মূল হয়ে যান ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের রোষে; গ্যালিলিওরা কারাগারে অবরুদ্ধ হয়ে জীবন দেন, সক্রেটিসেরা হেমলকে জীবন দেন।
সমাজের সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সংবেদনশীলতা একদিনে তৈরী হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভয় ভীতি অসহায়তা আদিম মানুষের মনোজগতে ধীরে ধীরে নানা অলৌকিক অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি করেছে। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বার্থান্বেষী ধীমান মানুষের প্রশ্রয়ে শাখা প্রশাখা শিকড় বাকড় ছড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে মানুষের কোশে কোশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধমনীতে ধমনীতে, অর্জন করেছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এবং মানুষের বেঁচে থাকার বাধাগুলির বিরুদ্ধে মানুষের অন্ধ আবেগ, ক্রোধ, ঘৃণা, আক্রোশকে প্রশমিত করতে কিছু মানুষ এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে পুঁজি করে অবিজ্ঞানকে সচেতন ভাবে বিস্তার করে গেছে। তাই অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের অধ্যাপক ক্লাশে সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ ছাত্রদের পড়িয়ে গ্রহণের দিন নিরম্বু উপবাস করে গ্রহণের পরে কীর্ত্তনীয়াদের সাথে গঙ্গায় স্নানে যায় পবিত্র হতে, ডাক্তারবাবু নিজের দায়িত্ব কমিয়ে ঈশ্বরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দেন, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ণের অধ্যাপকেরা মারকিউরাস ক্লোরাইড, অ্যালুমিনিয়ামের পাতের সংযোগে উৎপন্ন আতর মেশানো ছাই বা বিভূতি নেওয়ার জন্য সাঁই বাবার আশ্রমে হুমড়ি খান।
আমাদের দেশের সুপ্রাচীন লোকায়ত বেদে বলা আছে --- “কায় শরীর অঞ্চতি রক্ষতি কবচ “---- অর্থাৎ শরীরকে যে রক্ষা করে সেই কবচ। যেমন শীতবস্ত্র শীতের কবচ। পরবর্তী শ্রেণি বিভক্ত জাতপাতে বিভক্ত সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ধীমান শাসক পুরোহিত শ্রেণি সমাজকে অনশবিশ্বাস, কুসংস্কার ও বিভিন্ন আচারে মুড়িয়ে দেয়। কবচের অন্য অর্থ করে ---- ধাতুর খোলে দেবদেবীর নাম লেখা কাগজ এবং ফুল দুর্বা ঢুকিয়ে ধারণ করাকেই কবচ বলেন, এই কবচের মধ্যেকার বীজমন্ত্র জীবনকে রক্ষা করবে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তাহীন, রোগ শোক, দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত মানুষের দুর্বল মানসিকতাকে সাইকোথেরাপির সাহায্যে মোহাবিষ্ট করে ঐসব কবচ মাদুলি রত্ন বিকিকিনি করে লাভবান হন জ্যোতিষ বা রত্ন ব্যবসায়ীর মতো সমাজের গুটিকয় মানুষ আর সর্বসান্ত হয় অধিকাংশ দুর্বল মানুষ। জ্যোতিষেরা অপরের ভাগ্য ফেরান আর নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে বিজ্ঞাপন দেন খবরের কাগজে দূরদর্শনে। সমাজে নানান বাবাদের প্রাদুর্ভাভাব আগের তুলনায় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মানুষ যন্ত্রের প্রভাবে ক্রমশ নি:সঙ্গ একা হয়ে যাচ্ছে। টলমল সমাজে মানুষ সংঘবদ্ধতা থেকে একাকী হয়ে গেলে জ্যোতিষ ওঝা এবং বিভিন্ন বাবাদের মায়েদের প্রাদুর্ভাব আরো বাড়বে আগামীতে। চতুর শিল্পপতি ও ধনীরা দূরদর্শনে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বামাখ্যাপা রামপ্রসাদ লোকনাথ রাসমণির মতো সিরিয়াল দূরদর্শনে আরও বাড়িয়ে দেবেন। এফএম এ কালী কথা কৃষ্ণ কথা শিব মাহাত্ম্য র প্রোগ্রাম আরও বাড়াবে। এগুলো ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
আমার খাবারের থালায় প্রতিদিন একমুঠো করে ভাত কমে যাচ্ছে, বাবার কারখানা অফিস বন্ধ ছাঁটাই চলছে, অর্ধশিক্ষিত ভাইটা কর্মহীনতার অন্ধকারে নিভিয়ে ফেলছে উদ্ধত আলোক শিখার মতো যৌবনশক্তির মহা উত্তাপ, আমার যুবতী বোনটার নাকের কাছে রুমাল দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শয়তান অন্ধকারের দেশে, আমার সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা, স্ত্রীর রক্তহীন পান্ডুর মুখ, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত অসুস্থ পিতা মাতার দীর্ঘশ্বাস এবং নিরুচ্চারিত অস্তিত্ব, মুখের সামনে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা, ইংরাজীতে এম এ এবং বি এড পাশ সোনার পুরের শান্তনু মিস্ত্রির আত্মহত্যার খবরে, পিএসসি, এসএসসি তুলে দেওয়ার খবরে বা রাজ্যের সমস্ত চাকুরি 20-30 লক্ষ টাকাতে বিক্রির খবরে ক্রমে ক্রমে নিভে আসছে বিবর্ণ পৃথিবীর অপসৃয়মান আলো। - কী সীমাহীন অন্ধকার আর ক্রোধ, আমার ভালো অথবা খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী নিয়ন্ত্রকগুলির ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সম্পূর্ণ অনিশ্চিয়তার জীবনের জন্য আমি কাকে দায়ী করবো?
সারাদিন টিভির পর্দায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, বামাখ্যাপা, সাইবাবা, সারদামণি, শ্রীরাম এবং জ্যোতিষেরা বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে সব আয়ত্তে এনে দেবে, হনুমান চল্লিশা ব্রেসলেটের বিজ্ঞাপন মানুষকে দাবিয়ে রেখেছে। ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার আর অজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করে বিশাল দুঃখ আর ক্ষোভকে তাবিজ-কবজ, রত্ন, পাথর আর অদৃষ্টবাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে দিতে চায় --- আমি কি তাদের কাজের প্রতিবাদ করবো না?