স্বাধীনতার অমৃত, তার উৎসব, মহোৎসব মানে মচ্ছব। ১৯৪৭ এর এই রকম এক আগস্টের ১৫ তারিখে, ভারত লাভ করেছিল স্বাধীনতা। কী পেয়েছিল তাতে আম জনতা? তার আগে দেখি আমাদের নেতারা কী পেয়েছিল। তারা পেল দুটো দেশ। একটা ভেঙে দুটো। তাই দুটো রাজা, দুটো মন্ত্রী, দুটো সেনাপতি, মন্ত্রী সান্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল, সব দুটো দুটো করে। যথার্থ স্বাধীনতা পেল এরাই। স্বাধীনতার প্রভুত্ব চালাবে এরাই প্রজাদের উপরে। দিন-মাস- বছরের একক, দশক, শতক ধরে।
এ নাহয় গেল নেতাদের কথা। এখন বলি তাহাদের কথা, মানে আম, জাম, আতা-জাতীয় জনতার কথা। তারা পেল সদ্য স্বাধীনতার অভিশম্পাত। দেশ ভাগ। নিজ দেশে পরভূম। রাতারাতি জানলো, এই দেশটা ওদের, তোমাদের দেশ তো ওপারে। যথেচ্ছ লুঠতরাজ, খুনখারাপি, দাঙ্গা। অনেক লড়াইয়ের শেষে, নিজের দেশে এসে, জুটলো তাদের ক্যাম্প নামক নরক। সেখানে পেল তারা নতুন নামঃ রিফিউজি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে এসে নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে করতে তারা ভাবলো, এর নাম তাহলে স্বাধীনতা? কেন এমন হলো। কে দায়ী এই যন্ত্রণার দেশভাগে?
দায়ী তো আমরাই। হ্যাঁ আমরাই। কিভাবে? সেটাই আজ বলি। ছোট থেকে বাবা, মা, পরিবার, সমাজ, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মহা মহাজ্ঞানীদের শিক্ষায়, বলা ভাল কুশিক্ষায়, অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়েছি চোখ বুজে। ধর্মের পথে চলেছি। ধর্মের প্রতি ভক্তিতে ভক্তিতে খুইয়েছি মানবিকতার পাঠ, মনুষ্যত্বের ভাষা। ধর্ম বুনে দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ধর্ম করে দিয়েছে অন্ধ। তাই দেশভাগে নেতারা বোঝালে, তুমি হিন্দু, কাজেই ঐ দেখ হিন্দুস্থান, ওটাই তোমার দেশ, ওটাই তোমার আবাসস্থান। ওখানে তোমার ধর্ম সুরক্ষিত। নাহলে তোমার ধর্ম আছে খতরে মে।
ধর্মের কাজই তো অন্ধত্বের চাষ। এই চাষে লগ্নী করে ধনীরা, বেনিয়ারা। তারাই বানায় ধর্মের নেতা, রাজনীতির নেতা। এদের চাকরি হলো তোমায় বোঝানো। তুমি মুসলমান, ধর্ম তোমার খতরে মে। ধর্ম করে দিয়েছে অন্ধ। তাই দেশভাগে নেতারা বোঝালে, তুমি মুসলমান, ঐ দেখ পাকিস্তান, ওটাই তোমার দেশ, ওটাই তোমার আবাসস্থান। ওখানে তোমার ধর্ম সুরক্ষিত। ওখানে গড়তে পারবে তোমার ধর্মের রাষ্ট্র।
দেশ হলো স্বাধীন। যারা স্বাধীন হলো, তারাই খেতে পেলে অমৃত। সেই শুরু। সেই স্বাধীনতার অমৃত খেয়ে চলেছে দেশের দু আনা লোক, দেশের চৌদ্দ আনা সম্পদের অধিকারী তারা। আর বাকি চৌদ্দ আনা লোক, পেল দু আনা সম্পদ, দেশভাগের যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িকতার গরল। কারণ দেশভাগের বীজ তো তোমার মজ্জাতেই, তোমার ধর্মবিশ্বাসে, তোমার জীবন বোধে। তোমার জীবন দর্শণে।
তাই যখন মুক্ত চিন্তা করতে দেখলেই রে রে করে তেড়ে আসি, তাড়িয়ে তাদের ঘর ছাড়া করি, দেশছাড়া করি, মারি, ধরি, খুন করি, তখন কি ভেবে দেখবে না, কে দায়ী এর জন্য? একবার তোমায়, ভেবে দেখার আর্জি জানাই, তোমার এই বদ্ধ চিন্তন, এই অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, এমনি ভাবেই লুট-পাটের পথ প্রশস্ত করবে ঐ ধনীদের, বেনিয়াদের, নেতাদের, ধর্মগুরুদের। যখনি ধার্মিক তথা ধর্মান্ধের দল, সামনে "কুকুর বেড়াল মেরো না, নাস্তিক পেলে ছেড়ো না" লেখা ফেস্টুন সাজিয়ে মিছিল করে, মুক্তমনাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করে, তাদেরকে অত্যাচার করার নানান আইন বানায়, তাদের উপর নানান ফন্দি ফিকিরি কানুন চাপায়, তখন স্মরণ করিয়ে দিই, গায়ের জোরে ধর্ম প্রবর্তকদের অন্যায়, অনীতি, অনাচারের ইতিহাস চাপা দেওয়া যায় না, তাদের প্রণীত ধর্ম গ্রন্থের অন্যায়গুলিকে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, ভুল গুলিকে সঠিক বলে প্রচলিত করা যায় না, মিথ্যাগুলিকে সত্য বলেও চালানো যায় না। মুক্তমনে শিখলে, জানলে, পড়লে, ভাবলে সে সব মিথ্যা স্পষ্ট হয়ে যায়, ধর্মের ফানুশ ফেটে কোথায় যে ভ্যানিশ হয়ে যায়, তার চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কত শত ধর্ম, যারা দাবী করেছিল, তাদেরটাই একমাত্র সত্য ধর্ম, ঠিক তোমরা যেমন দাবী করে থাকো, কালের কবলে কোথায় যে হারিয়েছে তার ইয়ত্তা পাওয়া যায় না, নাম ঠিকানা হারিয়ে আজ সে সব সত্য ধর্ম মানবজাতির স্মৃতির অতল থেকেও বেপাত্তা। তাহলে বোঝা গেল তো, কেমন স্বাধীনতা। কেন দেশভাগের যন্ত্রণা, কে দায়ী তার জন্য?
এই দেশভাগের বীজ আমাদের ধর্ম বিশ্বাস। সে বীজের অঙ্কুর বেরোনোয় দরকারী বাতাস দিয়েছে আমাদের ভক্তি-নিঃশ্বাস। চারার বৃদ্ধিতে জলসেচ দিয়েছে আমাদের অন্ধ বিশ্বাস। সে বিষবৃক্ষ এখনো বেড়ে চলেছে।
কাজেই বন্ধু এখনো যদি না জাগো, এখনো যদি না চিন্তা করো মুক্তভাবে, এখনো যদি না পরিত্যাগ করতে পারো আজন্ম লালিত অযৌক্তিক জীবনাচরণ, যাকে তুমি ভেবেছো তোমার জীবনের আদর্শ, এখনো যদি না ত্যাগ করতে পারো তোমার হিন্দু-সত্তা, মুসলিম-সত্তা, তাহলে স্বাধীনতার অমৃত খেয়ে যাবে ওরাই। যুগ যুগ ধরে। তোমার জন্য উপহার অশিক্ষা, শিক্ষার নামে ধর্মশিক্ষা, কুশিক্ষা; আধুনিক চিকিৎসার নামে হোমিওপ্যাথীর চুষিকাঠি, মান্ধাতার আয়ুর্বেদ, চিকিৎসার নামে অভ্যাসের শৈলী যোগ, স্বাস্থ্য কাঠামোর উন্নতির নামে আরো শোষণ। তোমার জন্য উপহার বেকারত্ব, চাকুরির নামে শোষণ। শোষণ, শোষণ আর শোষণ। রাষ্ট্র ক্ষমতা কায়েম করে শুধু শোষণ আর শোষণ।
নির্বিবাদে এই শোষণ চালানোর জন্য মুক্তমনের চিন্তনকে দমন করা, চাপা দেওয়া জরুরি। তাই রাষ্ট্র মুক্ত চিন্তনের বিরুদ্ধে। ধর্ম বিশ্বাস প্রচলিত রাখতে লগ্নী করে বিভিন্ন দিক দিয়ে। ধর্ম বিশ্বাসরূপ অন্ধবিশ্বাসকে সুশিক্ষা বলে চালাতে সমর্থন যোগায় সকল দিক দিয়ে।
কিন্তু ফাঁপা ঢেঁকির শব্দ আচকিত করে মাঝে মাঝেই। ধর্ম বিশ্বাস ফোঁড়া ফেটে পুঁজ বেরোয় হর হামেশাই। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এইসব স্বাধীনোত্তর দেশের সংখ্যালঘুরা, দলিতেরা নিপীড়িত হয় ধর্মবিশ্বাসের "সুশিক্ষার গুণে"। দেশের সেই '৪৭ এর ১৫ই আগস্টে কিংবা আবার পরে '৭১ এর ২৬ শে মার্চে স্বাধীনতা পাওয়া প্রভুরা, রাজারা, মন্ত্রীরা তাদের মহারাজ বেনিয়াদের দেওয়া চাকুরির দায়িত্ব পালন করে চলে অন্ধবিশ্বাস চাষের কর্তব্যে। ব্রেন ওয়াশড ধর্মগুরুগুলিও পুরোদস্তুর ময়দানে নেমে দায়িত্ব পালন করে চলে আরো আরো ব্রেইন ওয়াশ করার "শুভ কর্মপথে"।
আর ব্রেন ওয়াশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। আজকাল বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় অমুক ধর্ম গুরু স্বাধীনতা আন্দোলনে হ্যান করেছিল, ত্যান করেছিল। ধর্মগুরুর বৌটিও না কি স্বাধীনতা সং গ্রামে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কত কি সাহায্য করেছিল। স্বাধীনতা সং গ্রামের বিপ্লবী, জীবনের প্রথম দিকে অনেক কাজই করেছেন, কিন্তু পরে ধর্মের আঁধার আশ্রয়ে গিয়েছেন। ধর্মের লোকেরা কিন্তু তার আলোকিত জীবন নিয়ে যত না আন্দোলিত, তার অন্ধকারময় কাপুরুষকার জীবনকে আলোকিত বলে বলে শতগুণ উচ্ছ্বসিত, অন্ধকারময় কাপুরুষিক জীবনকে, তার জীবনের মিথ্যাকে, সত্য দর্শণ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সহস্রমুখে গোয়েবেলসীয় প্রচারে উৎসর্গীকৃত। হায়, বিশ্বকে বিপথে চালিত করতে ধর্মবিশ্বাসের জুড়ি নাই। তাই এই পথকেই নির্দ্বিধায় বেছে নেয় রাজা তৈরির মালিকেরা। দেশের সব শোষণের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখে এভাবেই।
স্বাধীনতার লড়াই লড়েছিল ভগৎ সিং। স্বাধীনতার জন্য। মুক্তির জন্য। বলেছিল, মুক্তি মানে সকলের জন্য খাদ্য, সকলের জন্য আবাস, সকলের জন্য সুশিক্ষা, সকলের জন্য কাজ, সকলের জন্য নিরাপত্তা, সকলের জন্য বাঁচার অধিকার। মুক্তি মানে শোষণহীন সমাজ। মুক্তি মানে অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর কাজ। অন্ধবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস তাই সমাজের ক্যানসার। এর সঠিক চিকিৎসা হলো মুক্ত মননের পরিচর্চা, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পাঠদান, যুক্তিশীল মানসিকতা গঠনের পরিসর নির্মাণ।
কিভাবে হবে সেই নির্মাণ?
ধার্মিকেরা যেমন যুক্তিবাদীদের মারে, ধরে, হত্যা করে, যুক্তিবাদীরা কি পাল্টা মার দেবে? খুন করবে? ধার্মিকেরা যেমন যুক্তিবাদ দমনের জন্য ব্লাসফেমি আইন বানায়, এই আইনের বলে মুক্তচিন্তনশীল লোকেদের উপর অত্যাচার চালায়, যুক্তিবাদীরাও কি পাল্টা এসব করবে?
মোটেই না। যুক্তিবাদীদের মূল শক্তি হল তাদের যুক্তি, তাদের যুক্তিশীল মানসিকতা, তাদের সত্যকে সত্যরূপে বোঝার ক্ষমতা।
ধার্মিকদের ধর্মগ্রন্থের অসারতা, অন্যায়, অনৈতিকতা যুক্তিনীষ্ঠভাবে দেখিয়ে দেওয়াই যুক্তিবাদী আন্দোলনের মূল কাঠামো।
মানুষ কিন্তু ভিত্তিগতভাবেই র্যাশানাল। তাকে বোঝানো আদৌ কঠিন নয় যে গাধা আকাশে উড়তে পারে না। ঢেকিও না। সূর্য কোনো ছোট্ট নরম কবোষ্ণ রুটি নয় যে বানর, হনুমানে তা বগলে পুরে নেবে। বানরে উড়তেও পারবে মন্ত্রবলে, এ বিশ্বাসে তাদের মনে দ্বিধাই মেশায়। চাঁদ কোনো খেলনা নয় যে তাকে কেউ দ্বিখণ্ডিত করার পর সেটি পৃথিবীতে নেমে এলেও পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় না তো বটেই, সেটিকে আবার আঙুলের ইশারায় জুড়েও দেওয়া যায়। এসব যে আষাঢ়ে গল্প তা বুঝতে কারুর বিন্দ্যমাত্র কষ্ট হয় না। এই রকম ধর্মগ্রন্থ দিয়েই তাদের অন্ধবিশ্বাস ভাঙতে হবে।