নাটক: আপনি ভুল দেখেছেন
অনুপ চক্রবর্তী
Dec. 3, 2024 | | views :1011 | like:0 | share: 0 | comments :0
চরিত্র: অর্ণব। সুনীল (অর্ণবের বাবা)। অনিল (অর্ণবের কাকা)। তপতী (অর্ণবের মা)। সোমা। রথীন দত্ত। মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত ওসি। সাবইন্সপেক্টর। প্রথম পুলিশ। দ্বিতীয় পুলিশ।
।। প্রথম দৃশ্য।।
(অর্ণবদের বাইরের বসার ঘর। অর্ণব, অর্ণবের বাবা আর কাকা গুম হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে বসে আছে। অর্ণবের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। রাত ন’টা হবে। সোমা বাইরে থেকে দ্রুত আসে।)
সোমা: কী হয়েছে অর্ণব? কী সমস্যা হয়েছে যে ওভাবে মেসেজ করে এখনি আসতে বললে? একি? তোমরা সবাই এরকম গুম মেরে আছো কেন? তুমি কাকু কাকিমা ছোটকাকু? কি হয়েছে তোমাদের? এ’কি কাকিমা? আপনি কাঁদছেন কেন?
অনিল: আমি বলছি সোমা।
সোমা: হ্যাঁ। বলুন ছোটকাকু। কী হয়েছে?
অনিল: কিছুক্ষণ আগে আমার এই দাদাটি চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে গেছিলো।
সোমা: সেকি!
অনিল: আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় ও সেটা করতে পারেনি।
সোমা: সেকি! কেন? (সুনীল বাবু হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন। অর্ণবের মাও। এমনকি অর্ণবও।) একি! কী ব্যাপার? সবাই মিলে এভাবে ভেঙে পড়ছেন কেন? অর্ণব, তুমিও এইভাবে ভেঙে পড়ছ কেন? কী হয়েছে? কেন কাকু এরকম করতে গেলেন?
অনিল: আমি বলছি তোমাকে সোমা। অর্ণবের চাকরি চলে গেছে।
সোমা: সেকি! কেন?
অনিল: হাইকোর্টের অর্ডারে।
সোমা: কেন?
অনিল: তুমি জানো না কয়েকটিদিন ধরে হাইকোর্ট কি অর্ডার করে চলেছে। কয়েকদিন ধরে কয়েকশো জন প্রাইমারি টিচারের চাকরি চলে গেছে। আজকেও অনেকের চাকরি চলে গেছে। তার মধ্যে অর্ণবও একজন।
সোমা: কেন অর্ণব? তুমি তো চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেয়েছিলে। (ডুকরে কেঁদে ওঠে অর্নব)
অনিল: না সোমা।
সোমা: তার মানে?
অনিল: সে বড় লজ্জার কথা সোমা। যারা চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে দালালদের ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল, হাইকোর্ট তাদের ধরে ফেলে একে একে বরখাস্ত করেছে। আজ জানা গেছে অর্নবও তাদের মধ্যে একজন। আমি অর্ণবেরও এরকম ব্যাপার জানতাম না। একটু আগে সব শুনলাম।
সুনীল: সোমা, জমানো শেষ সঞ্চয় দশ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছিলাম ওর চাকরির জন্য। ওর বোনের বিয়েতে আগেই পনেরো লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। শেষ সঞ্চয়টা দিয়ে দিয়েছিলাম দালালকে। কেননা তুমি জানো না আমি বিএসএনএলের স্টাফ হলেও গত দু বছর কোন মাইনে পাইনি। কোনোদিন পাবো বলে মনে হয় না। বরং একেবারে তাডিয়ে দেবে হয়তো কিছুদিন পরে। সংসারের খরচ চলত অনেক কষ্ট করে অর্ণবেরই টিউশনির টাকায়। তাই বাঁচার জন্য অর্ণবের চাকরির জন্য দালালকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলাম।
অনিল: অন্যায় করেছিলে।
সুনীল: তুই আমাকে এরকম বলছিস! এইসময়ে! একটু আগে মরতে যাচ্ছিলাম। তুই নিজেই বাঁচালি।
অনিল: তবুও বলছি দাদা খুব অন্যায় করেছিলে। চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছিল তারা তো ঐ পরীক্ষায় পাশ করা ক্যান্ডিডেটদের চাকরিটা দখল করেছিল। এটা অন্যায় নয়?
সুনীল: আর আমার যে বছরের পর বছর মাইনে বন্ধ করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার সেটা অন্যায় নয়?
অনিল: সেটাও ঘোরতর অন্যায়। সেটাও ক্রাইম। এটাও ক্রাইম।
অর্ণব: আমার এছাড়া কী করার ছিল? আমি তো অনেক রকম চাকরির পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম বছরের পর বছর। চাকরি না পেলে কী করব?
অনিল: হকারি করবি আমার মতো। আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না। চাকরি পাইনি। তাই হকারি করে পেট চালাই। তাই করতিস। তাই করবি। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কেন চাকরি করবি? এটা তো চরম দুর্নীতি। যোগ্য ক্যান্ডিডেটের চাকরি চুরি করে পাওয়া। শর্টকাট রাস্তায় গেছিলিস। এখন কি হলো। টাকাটাও গেল। চাকরিটাও গেলো। সম্মানটাও গেল।
অর্ণব: ঠিক বলেছ। আমারই দোষ। বাবা নয়, সুইসাইড আমারই করা উচিত।
সোমা: অর্ণব তুমি থামো। একটু শান্ত হও। আমাকে হালটা ধরতে দাও। যদিও আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নয়।
অনিল: কে বলেছে তুমি আমাদের পরিবারের কেউ নয়? আমরা তো সবাই জানি তুমি অর্ণবকে ভালোবাসো। আমাদের সকলকে ভালোবাসো। আমরাও সকলে তোমাকে ভালোবাসি। আমরাও সবাই চেয়েছিলাম তুমি আমাদের পরিবারের একজন হও। আমাদের বাড়ির বউ হও। অর্ণবের বউ হও।
সোমা: চেয়েছিলেন ছোটকাকু? মানে এখন কি আর চান না?
অনিল: কি করে চাইবো। সবতো সর্বনাশ হয়ে গেল।
সোমা: কিচ্ছু সর্বনাশ হয়নি।
অনিল: কী বলছ তুমি?
সোমা: অর্ণবের চাকরি চলে গেল। আমার চাকরিটাতো আছে? পাকা চাকরি ব্যাংকের। আমার চাকরি যাবে না।
অর্ণব: এরপরও তুমি আমাকে বিয়ে করবে সোমা?
সোমা: হ্যাঁ। কেন করব না? কেন তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না?
অর্ণব: তোমাকে বিয়ে করার মুখটা আমার আছে? আমারতো সম্মানটাই চলে গেল।
সোমা: ও সব ঠিক হয়ে যাবে।
অর্ণব: আমি তো চোর সমাজের চোখে।
সোমা: না। তুমি চোর নয়। তুমি ভিকটিম। এই পোড়া দেশে এই পোড়া সমাজে অন্যায় সমাজব্যবস্থার একটা শিকার তুমি। আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি। তুমি চেষ্টা করেও পাওনি। আমার অবস্থা তোমার মতো হতে পারত। চাকরি না পেয়ে সংসার কে বাঁচাতে তুমি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলে। অপরাধী তারা যারা তোমাদের ঘুষ দিতে বাধ্য করে। মানে যারা দেশটা চালায়। কাকে টাকা দিয়েছিলে তোমরা?
অর্ণব: এই পাড়ারই এক দালালকে। একটা নেতা।
অনিল: কে দাদা?
সুনীল: রথীন দত্ত।
অনিল: ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা? ওর নাম্বারটা আমাকে দাও তো।
সুনীল: কেন? কি লাভ? ও কি টাকা ফেরত দেবে? হয়তো স্বীকারই করবে না।
অনিল: তুমি ওকে কল করে ফোনটা আমাকে দাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। যা বলছি করো। দ্যাখো আমি কী করি। হয়ত কাজ হবে।
(সুনীল রথীনকে কল করে ফোনটা অনিলকে দেয়)
অনিল: হ্যালো রথীন বাবু। আমি সুনীল বোসের ভাই অনিল বলছি। আপনি এখনই আমাদের বাড়িতে একবার চলে আসুন। হ্যাঁ। এখনই। ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার। না না। আপনি কেন আমাদের চাকর হবেন? বরং উল্টোটা। না আমরা কোথাও যাবো না। দাদাও কোথাও যাবে না। আপনি না আসলে কিন্তু আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। কী হয়েছে? কিছুক্ষণ আগে আমার দাদা চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিল। আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় দিতে পারেনি। ওর লেখা একটা সুইসাইড-নোট আমার পকেটে আছে। সেখানে আপনার বিরুদ্ধে ওর নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নয়। ও আবার কিন্তু সুইসাইড করার চেষ্টা করতে পারে। সেটা যদি করে ফেলে তখন আমি ওর ঐ সুইসাইড নোটটা পুলিশকে দেব। তখন আপনার কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? ব্ল্যাকমেল বলুন আর যাই বলুন সেটাই হতে পারে। ঠিক আছে তাহলে আসছেন তো? না। তেমন রাত হয় নি। হ্যাঁ ঠিক এখনই আসুন। রিস্ক নেবেন না। বাইকে আসতে তো আপনার দুমিনিট লাগবে। আসুন। (ফোন বন্ধ করে)
সোমা: কাজ হবে ছোটকাকু?
অনিল: দেখা যাক। ওরা তো ভীষণই পাজি। পাক্কা ক্রিমিনাল। তবে দ্যাখো সোমা আমিও দুঁদে হকার। ওই রথীন দত্ত ওদের দলের একটা পান্ডা বটে। আমিও হকার ইউনিয়নের একটা পান্ডা। আমার গরমটা একটু দেখো।
সুনীল: অনিল, তুই কেন ওদের সঙ্গে লাগছিস? ওরা খুব খারাপ। যা গেছে গেছে। টাকার জন্যে ভাইকে হারাতে চাই না। (ফুঁপিয়ে কাঁদে)
অনিল: তুমি থামো। তাহলে টাকার জন্যে নিজেকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলে কেন? আমার কিছু হবে না।
(সুনীল ফুঁপিয়ে কাঁদে)
সোমা: কাকু শান্ত হোন। কাঁদবেন না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। একটু জল খাবেন?
সুনীল: না। থাক। ঠিক আছে।
(রথীন দত্ত বাইরে থেকে আসে। খুব বিরক্ত।)
রথীন: কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
অনিল: আপনাকে তো ফোনে বললাম রথীনবাবু।
রথীন: সেতো জানলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কী? দেখি সুনীলদার সুইসাইড নোটটা।
অনিল: না। সেটা এখন আপনাকে দেব না। আমাদের মুখের কথাটাই এখন আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।
রথীন: আমি কী করেছি সুনীলদা যে আমাকে অভিযুক্ত করে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে?
সুনীল: (চেঁচিয়ে ওঠে) তুমি কি জানো আজ হাইকোর্টের অর্ডারে অর্ণবের চাকরি চলে গেছে?
রথীন: সেকি! আমি তো জানতাম না।
সুনীল: আমাকে দশ লাখ টাকা ফেরত দাও।
রথীন: কী আজেবাজে বকছো? আমি তোমাকে টাকা দেব কেন?
সুনীল: কারণ তুমি অর্ণবের চাকরির জন্যে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছ। আমি নিজের হাতে তোমাকে সেই টাকা ক্যাশ দিয়েছি।
রথীন: কোন প্রমাণ আছে?
সুনীল: মানে!!! তুমি অস্বীকার করছ?
রথীন: হ্যাঁ করছি।
সোমা: আপনাদের মতো চোরেরাই এভাবে অস্বীকার করতে পারে।
রথীন: এই সোমা। মুখ সামলে। খুব সাবধান। তোমার পলিটিক্স করা ঘুচিয়ে দেব। আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি আমাকে ঠিক চেনো না।
সোমা: ভীষণ চিনি। আমি ভয় পাচ্ছি না। যা ইচ্ছে করবেন।
অনিল: রথীনবাবু, আপনি অস্বীকার করছেন তো? দাদার মানসিক অবস্থাটা দেখছেন? ও যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে, তাহলে কিন্তু সুইসাইডাল নোটটা আমরা পুলিশের কাছে জমা দেব। নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো তখন?
রথীন: (একটু থেমে) দেখো সুনীলদা। তুমি ওসব করতে যেও না। হ্যাঁ। স্বীকার করছি তুমি টাকা দিয়েছ।
অনিল: এইবার পথে এসেছে।
রথীন: কিন্তু বিশ্বাস করো। আমি তার থেকে এক লাখ টাকা মাত্র নিয়েছি। কাল সকালে ব্যাংক থেকে তুলে সেটা তোমাকে ফেরত দেব।
সুনীল: আর বাকি ন লাখ টাকা?
রথীন: ওটা আমার কাছে নেই।
সুনীল: নেই মানে? কার কাছে আছে?
অনিল: ওটা ওপরতলায় চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।
অনিল: বুঝতে পারছ সোমা চুরির জালটা কতদূর ছড়িয়ে আছে?
সোমা: আমরা সেসব শুনতে চাই না। আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন। আপনি ঠিক দশ লাখ টাকাই ফেরত দেবেন।
রথীন: মাস্তানি করছ? তুমি এসব বলার কে?
সোমা: আমি অর্ণবের ভাবী স্ত্রী।
রথীন: পুরো স্ত্রী হলে তখন গলাবাজি করবে।
সোমা: তার মানে আপনি পুরো দশ লাখ টাকা দেবেন না?
রথীন: না। কোত্থেকে দেব? ওটা আমার কাছে নেই। বললাম তো চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।
সোমা: ফেরত আনুন।
রথীন: সম্ভব নয়। চাইলেও ফেরত পাব না।
সোমা: কাদের পাঠিয়েছেন? তাদের নাম বলুন।
রথীন: বলব না।
সোমা: কেন?
রথীন: বলা সম্ভব নয়।
সোমা: কেন?
রথীন: আমি মার্ডার হয়ে যেতে চাই না।
সোমা: আমরা কিন্তু পুলিশে যাব। বলবো আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন।
রথীন: যাও। আমি অস্বীকার করব। বলব তোমরা মিথ্যে কথা বলছো। কী করবে তখন? প্রমাণ করতে পারবে?
অর্ণব: (লাফিয়ে উঠে রথীনের গলা টিপে ধরে) স্কাউন্ড্রেল!
রথীন: এই কি করছ! ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে।
(ধ্স্তাধস্তি হয়। অনিল ছাড়িয়ে দেয়।)
রথীন: (রাগে কাঁপছে)খুব খারাপ করলে অর্ণব। তুমি আমাকে জানো না।
অর্ণব: খুব জানি। আপনি এলাকার মার্কামারা খতরনাক দুনম্বরী নেতা। আপনার হাতে অনেক গুন্ডা। অনেক মার্ডার করিয়েছেন। আমাকে মার্ডার কোরবেন তো? যান। আমাকে মার্ডার করান।
অনিল: রথীন বাবু আমার ভাইপোর আর কোন ক্ষতি করবেন না। এই পর্যন্ত যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। বাড়ির দশ লাখ টাকা চলে গেছে।ওর চাকরিটাও চলে গেছে। সম্মানটাও চলে গেছে। এবার রেহাই দিন। এরপরেও যদি কিছু করেন। তাহলে এই সুইসাইডাল নোটটা কিন্তু আমরা থানায় জমা দেব। আপনিও দেখবেন আমরা কতদূর যেতে পারি। (আগুনের মত তাকিয়ে রথীন চলে যায়।)
অনিল: ব্যাপারটা খুব খারাপ হল। তুই মাথা গরম করে ওর গায়ে হাত না দিলেই পারতিস অনু। খুব ডেঞ্জারাস ওরা।
অর্ণব: কী করবে? আমাক মেরে ফেলবে তো? ওকে তো বললাম আমি সেটার পরোয়া করি না। বাবার শেষ সঞ্চয়টা তো নষ্ট করে দিলাম। চাকরিটা চলে গেল। সবাই জেনে গেল। সম্মানটাও চলে গেল। আর বেঁচে কি হবে? আমাকে আটকালে কেন? ওকে আজই গলা টিপে মেরে ফেলে না হয় ফাঁসি যেতাম।
সোমা: কেন অর্ণব? একটা আরশোলাকে মেরে ফেলে নিজের জীবন নষ্ট করবে কেন? ঐ নরকের কীটের চেয়ে তোমার জীবনের দাম লক্ষ গুণ বেশি। যা গেছে যাক। টাকা, চাকরি, সো কলড পাবলিক প্রেস্টিজ - সব কিছুর চেয়ে তোমার জীবনের দাম বেশি। কিসের পাবলিক প্রেস্টিজ। ভালো ছাত্র হয়েও তুমি বছরের পর বছর সৎভাবে চেষ্টা করে কঠিন পরিশ্রম করে চাকরি পাওনি। আমি তো জানি। ঐ পাবলিক আমজনতা তোমাকে কি বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেছিল? ওদের কথা ছাড়ো।
অনিল: সোমা আমি আসছি। অনেক রাত হয়ে গেল। আমাকে ভোরের লোকাল ধরতে হবে। সামান্য হকারি করে খাই। তুমি বাড়ি ফিরবে তো? অনেক রাত হয়ে গেল তো।
সোমা: না ছোটকাকু। আমি বাড়িতে বলেছি আজ ছোটমাসির বাড়ি থাকবো। ছোটমাসির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। অর্ণবের মেসেজ পেয়ে বুঝেছিলাম মারাত্মক কিছু হয়েছে। তাই মাসিকে ম্যানেজ করেছি। মাসি আমাদের রিলেশনশিপের ব্যাপারটা জানে। আমাকে বন্ধুর মত ভীষণ কোঅপারেট করে।
অনিল: ঠিক আছে। আমি তাহলে যাচ্ছি। তোমার ছোটকাকিমাও মনে হয় চিন্তা করছে। ও তো এসব কিছুই জানেনা। আমি একটা দরকারে দাদার কাছে এসেছিলাম। দেখলাম বাড়িটা থমথমে। বৌদি আর অর্ণব ভীষণ চুপ করে আছে। দাদা কোথায় বলতে বলল চিলেকোঠার ঘরে আছে। বুঝলাম কিছু সমস্যা হয়েছে। যাই হোক ভাগ্যিস চিলেকোঠার ঘরে গেলাম। আ্য একটু দেরী হলেই দাদাকে হারিয়ে ফেলতাম।
সুনীল: সেটা ভালোই হতো। কেন বাঁচালি আমাকে?
অনিল: বাজে বোকো না।
(অর্ণবের বাবা ও মা দুজনেই হাউ হাউ করে কাঁদে) কান্নাকাটি কোরোনা। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এবার সবাইকে বাঁচতে হবে। জীবন কি অত সস্তা। লড়াই করে বাঁচতে হবে। আমাকে দেখছ না? সারাদিন লড়াই করে বাঁচি। আর তোমাদের এত সুন্দর একটা বৌমা হচ্ছে। যে তোমাদের সবাইকে এত ভালোবাসে। এতো তোমাদের বিরাট সহায়। যাও বৌদি দাদাকে ঘরে নিয়ে যাও। চোখে চোখে রেখো। আর দাদা তুমি কাপুরুষের মত আর ওরকম নোংরা কাজ করতে যেও না। ছোট ভাই হলেও জ্ঞান দিয়ে বলছি। মানুষের মতো বাঁচো। কাপুরুষরাই লড়াই না করে নিজেকে মেরে ফেলতে যায়। যাও। তোমরা ভেতরে যাও। (অর্ণবের বাবা ও মা ভেতরে চলে যায়) আমি যাচ্ছি সোমা। যাচ্ছি অর্নব। মনের জোর বাড়া। রথীন দত্ত তোর কিছু করতে পারবে না। বাবারও বাবা আছে। আমি ঘরে গিয়ে জটাদাকে একটু পরে ফোন করে সব বলব। জটাদা যেরকমই লোক হোক আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি যাচ্ছি। সোমা এদের সবাইকে একটু দেখো।
সোমা: হ্যাঁ। ছোটকাকু। আমি আছি। চিন্তা করবেন না। আপনি আসুন। (অনিল বেরিয়ে যায়)
সোমা: মন খারাপ করে থেকো না অর্ণব।
অর্ণব: তুমি রাতে এ বাড়িতে রয়ে গেলে কেন? বাড়ির সবাই বাবা-মা কাকু কাকিমা তোমাকে যদি খারাপ ভাবে, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
সোমা: আমাকে কেউ খারাপ ভাববে না। কেননা ওরা কেউ খারাপ নয়। আর ওরা জানে আমিও খারাপ মেয়ে নয়।
অর্ণব: কোথায় থাকবে রাতে?
সোমা: (হেসে) তোমার ঘরে।
অর্ণব: তাহলে খারাপ ভাববেই।
সোমা: (হেসে) ভয় নেই। আমি চিলেকোঠার ঘরে একলা থাকব।
অর্ণব: আবার ওখানে?
সোমা: (হেসে) ভয় নেই। মরব না। মরার কোনো ইচ্ছে নেই। বরং বাঁচার ইচ্ছে ভীষণ। তোমাকে নিয়ে। তোমার সঙ্গে। (সোমা দুহাত দিয়ে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে গান গাইতে থাকে। অর্ণবের ক্রমশ চোখ ভিজে যায়।)
অর্ণব: (আবেগরুদ্ধ কন্ঠে)কেন এখনও আমাকে এত ভালোবাসছ তুমি? আমার মতো একজন অপদার্থ দুর্নীতিপরায়ণ ছেলেকে।
সোমা: নিজেকে গালাগালি দেবে না অর্ণব। একদম নয়।
অর্ণব: গালাগালিরই যোগ্য আমি।
সোমা: আমি তা মনে করি না।
অর্ণব: কী মনে করো?
সোমা: বললাম তো একটু আগে। তুমি সিস্টেমের শিকার। তুমি ভালো। শতকরা একশ ভাগ ভালো।
আমার চোখ ভুল দেখেনি।
অর্ণব: কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।
সোমা: কীভাবে?
অর্ণব: তোমাকে তো বলিনি দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আমি চাকরি পেয়েছি।
সোমা: কোন ছেলে কি এত সহজে তার প্রেমিকাকে এসব বলতে পারে?
অর্ণব: আমি একজন কাওয়ার্ড। আমাকে তুমি ডিফেন্ড করছ?
সোমা: করছি। আমাদের বিয়ের পর তুমি নিশ্চয়ই সেটা বলতে।
অর্ণব: তখন আমাকে ঘেন্না করতে না?
সোমা: না। কারণ ওটাই। তুমি সিস্টেমের শিকার। আমি তো জানি তুমি ভালো ছাত্র। উন্নত সুস্থ রুচি আর মন তোমার। কেন তোমাকে কোনদিন ঘৃণা করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ণব। তোমার সমস্ত সত্তাকে। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে। কাটাছেঁড়া করে, ভুল ঠিক বিচার করে, দোষগুণ বিচার করে এই ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা কেউ ত্রুটিমুক্ত নই পৃথিবীতে। ভুল ত্রুটি, দোষ গুণ - কোন কিছুই বিচার্য নয়। শুধু ভালোবাসাই বিচার্য। শুধু প্রেমই একমাত্র সত্য অর্ণব। কী হল অর্ণব? এত গুম হয়ে আছ কেন? দেখো এই প্রথম তোমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আমি রাত কাটাচ্ছি। আমার এই রাতটা ব্যর্থ করে দিও না।
অর্ণব: কেন তুমি আমার মত একটা মানুষের জন্যে এত ভাবছ? কেন রয়ে গেলে এখানে? চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
সোমা: তাড়িয়ে দিচ্ছ আমাকে?
অর্ণব: আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। থাকবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে।
সোমা: শুধু বাজে কথা। কিচ্ছু শেষ হয়নি।
অর্ণব: হ্যাঁ সব শেষ হয়ে গেছে। আর যাদের জন্য শেষ হয়ে গেছে তাদের আমি ছাড়বো না। আমি চরম প্রতিশোধ নেব।
সোমা: কী সব পাগলের মতো বলছ মাথা গরম করে?
অর্ণব: কিচ্ছু পাগলের মত নয়। আমি আবারও বলছি। আমি চরম প্রতিশোধ নেব। রথীন দত্তদের আমি ছাড়বো না।
সোমা: কী সব বলছ! তুমি ওদের সঙ্গে আর লাগবে না। ওরা ভয়ংকর খারাপ। যা গেছে গেছে। যা হবার হয়ে গেছে। তুমি ওসব করতে গেলে তোমার বাকি জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে অর্ণব। আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদের সুন্দর করে ভবিষ্যতের এক সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে হবে।
অর্ণব: না তা আর হবে না।
সোমা: কেন হবে না? আমি তো আছি তোমার সঙ্গে অর্ণব।
অর্ণব: আমাকে তুমি ভুলে যাও সোমা। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।
সোমা: কী পাগলামি করছ?
অর্ণব: পাগলামি নয়। আমি ঠিক বলছি। আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে অসহায় কপর্দকশূন্য বাবার দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। আমি অপদার্থ। দুর্নীতিপরায়ন। চোর। অবৈধ পথের পথিক। তুমি একটা সৎপরিশ্রমী মেধাবী ছাত্রী। পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতায় ব্যাংকে চাকরি পাওয়া একজন সম্মানীয়া মহিলা। আমার সঙ্গে - আমার মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমার সম্মান নষ্ট কোরোনা। আমি অপদার্থ। সংসারের সর্বনাশ করলাম। নোংরা রাস্তায় চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। তাই হাইকোর্টের অর্ডারে আমার চাকরি চলে গেল। সবাই জেনে গেল। সমাজে আমার সম্মান চলে গেল। আমার এই সম্মানহীন জীবনের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমাকে অসম্মানিত করতে চাই না।
সোমা: বার বার সেই একই কথা। সেই অপরাধবোধ।
অর্ণব: হ্যাঁ অপরাধ বোধ। কারণ আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী।
সোমা: আমি তো বার বার বলছি আমি তা মনে করিনা। কেননা আমার স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে সমাজ সচেতনতা দিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিতে সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বলছি তো তুমি অপরাধী নও। আবার বলছি তুমি সিস্টেমের শিকার। কেন আমাকে একই কথা বলে বোর করছ?
অর্ণব: আমাকে নিতান্ত ভীষণ ভালোবাসো বলে আজ এই কথা বলছ। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে একদিন কিন্তু তুমি হয়ত অন্য কথা বলতে পারো। আমাদের সন্তানদের হয়ত বলতেই পারো তোর বাবা ছিল একটা করাপটেড দুর্নীতিগ্রস্ত চোর। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে তারপর ধরা পড়ে চাকরি খোয়ানো একটা রাস্কেল জানোয়ার। বলতেই পারো ভবিষ্যতে তাদের - তাদের শুধু কেন – হয়ত আমাকেই একদিন বলতে পারো এইসব।
সোমা: তাই নাকি? এতদূর ভেবে ফেলেছ? আমাকে এই চিনেছ? এত অবিশ্বাস আমাকে?
অর্ণব: হ্যাঁ। তাই। আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না। কোনকিছুই বিশ্বাস করি না। তাই?
সোমা: তাহলে সত্যি আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। অবিশ্বাস দিয়ে আমিও জীবন শুরু করতে চাই না। (বাষ্পারুদ্ধ কণ্ঠে) ঠিক আছে অর্ণব। তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। (প্রচন্ডভাবে কেঁদে ফেলে)
অর্ণব: দাঁড়াও। এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?
সোমা: নিজের বাড়িতে। লাস্ট বাস পেয়ে যাব।
অর্ণব: আমি পৌঁছে দেব?
সোমা: না। (চলে যায়)
।। দ্বিতীয় দৃশ্য।।
(থানা। ওসির চেম্বার।)
অর্ণব: বলুন অফিসার আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন।
ওসি: আপনি বুঝতে পারছেন না নাকি ন্যাকার মতো বুঝেও না বোঝার ভান করছেন?
অর্ণব: আমি নিশ্চয় অনেক কিছু আন্দাজ করছি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই আমার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ কী।
ওসি: আপনি লিফলেট ছাপিয়ে চতু্র্দিকে সেগুলো ছড়িয়ে এলাকার কিছু সম্মানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে তাদের সম্মান নষ্ট করছেন।
অর্ণব: সম্মানীয় নেতা? হাসালেন। হ্যাঁ। করছি। কারণ সেটাই তাদের প্রাপ্য। দরকার হলে ওরা আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুক। এসবে আপনার সমস্যা কিসের?
ওসি: আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছেন?
অর্ণব: না কৈফিয়ত চাইছি না। শুধু জানতে চাইছি কারণটা।
ওসি: আপনার কথা কে শুনবে? কে বিশ্বাস করবে? আপনি তো চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে তারপর দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়েছেন আর তারপর ধরা পড়ে গিয়ে হাইকোর্টের অর্ডারে আপনার চাকরি খুইয়েছেন।
অর্ণব: ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন। আমি তো লিফলেটে এই সমস্ত কথাই লিখেছি।
ওসি: কিন্তু লিফলেটে যাদের নামে আপনি অভিযোগ করেছেন, তারা নির্দোষ সম্মানীয় নেতা।
অর্ণব: তাই নাকি?
ওসি: আপনি প্রমাণ করতে পারবেন তারা আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?
অর্ণব: না। পারবো না। আমি অভিযোগ করছি। তদন্ত করার কর্তব্য আপনাদের। রথীন দত্ত আর আমার বাবার কল লিস্ট চেক করে রথীন দত্তকে জিজ্ঞেস করুন কী এত কথাবার্তা হয়েছিল ওর সঙ্গে আমার বাবার। আপনারা ওকে পেঁদিয়ে ওর স্বীকারোক্তি আদায় করুন।
ওসি: আপনার কথায়?
অর্ণব: হ্যাঁ। আমার কথায়। আমি তো বলছি ওদের দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছি।
ওসি: আপনি মিথ্যেকথা বলছেন।
অর্ণব: তাহলে আমার চাকরি গেল কেন? আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করতেও আমার চাকরি হলো কেন?
ওসি: আপনি ঘুষ দিয়েছেন। তাই হয়েছে।
অর্ণব: হ্যাঁ। বলছি তো দিয়েছি। ভূতকে তো ঘুষ দিইনি। আমরা সেই সব ক্ষমতাবানদের ঘুষ দিয়েছি যারা আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও আমাকে চাকরি তে ঢুকিয়েছিল। তারা কারা?
ওসি: সে আমি কি করে জানব আপনি কাদের ঘুষ দিয়েছেন? সেটা তো আপনি জানেন।
অর্ণব: জানি তো। তাদের নামই তো লিফলেটে লিখেছি। তাদের অ্যারেস্ট করে ইনটারোগেট করুন।
ওসি: আপনার কথায়?
অর্ণব: হ্যাঁ। আমার অভিযোগের ভিত্তিতে।
ওসি: আপনি নির্দোষ লোকদের নামে মিথ্যে অভিযোগ করছেন তাদের ফাঁসাবার জন্য। আসল অপরাধীদের আড়াল করতে।
অর্ণব: আমার মোটিভ?
ওসি: আপনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এই কাজ করছেন। এটাই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
অর্ণব: আপনার কথার প্রমাণ?
ওসি: কোনো প্রমাণ বা কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। আপনি আজকেই আবার একটা লিফলেট ছাপিয়ে সেখানে লিখবেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় আপনি সম্মানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
অর্ণব: তাই নাকি? আমাকে এতই ভেড়া আর রামছাগল মনে করেন? আমার তো সব গেছে। টাকা কড়ি চাকরি সম্মান। আমার আর হারাবার কিছু নেই। ভয়েরও কিছু নেই। শুনুন অফিসার। আমি আর কোন লিফলেট ছাপাবো না। যেটা ছাপিয়েছি, সেটাই বরং আরো অনেক জেরক্স করে সব জায়গায় বিলি করব। আর রাস্তাঘাটে বাজারে মোড়ে সর্বত্র মাইক ভাড়া করে আপনাদের ওই সম্মানীয় নেতাদের মুখোশ খুলে দেব। ওদের বলবেন আমি ওদের ছাড়বো না।
ওসি: আপনাকে অ্যারেস্ট করব।
অর্ণব: করুন। তারপর জামিন নিয়ে বেরিয়ে আবার একই কাজ ক্রমাগত করে চলব। আপনাদের ওই ঘুষখোর সম্মানীয় নেতাদের সম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে দেব। যেভাবে আমার সম্মান ওরা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
ওসি: আপনি বেরিয়ে যান। আ আর এক মিনিট থাকলে আপনাকে লকআপে পুরব।
অর্ণব: যাচ্ছি। এখানে এক সেকেণ্ডও থাকার ইচ্ছে নেই। আপনি ডেকেছিলেন। তাই এসেছিলাম।
(সেই মুহূর্তে মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত বাইরে থেকে এসে ওসির ঘরে ঢুকে পরে।।)
মৌসুমীঃ দাঁড়াও অর্ণব। তুমি যাবে না। আমরা বাইরে থেকে সব শুনেছি।
ওসি: কী ব্যাপার? আপনারা বিনা পারমিশনে ওসির ঘরে ঢুকলেন কেন?
তাপসঃ বেশ করেছি। রথীন দত্ত ঢুকলে এটা বলতেন?
ওসি: এই তাপস! বড় ফুটবলার হয়ে গেছ? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
প্রশান্তঃ তার আগে বলুন আমাদের কি অপরাধ? অর্ণবদার মতো একইরকমভাবে রথীন দত্ত স্কুলে চাকরি দেওয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আর কোর্টের অর্ডারে ওর মতো আমারও চাকরি চলে গেছে।
তাপসঃ রথীন দত্ত আমার কাছ থেকেও দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আমারও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে।
মৌসুমীঃ আমরাও বাড়ি থেকে রথীন দত্তকে দশ লাখ টাকা দিয়েছি আমার ছোট ভাই তপনের চাকরির জন্যে।ওরও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে।
ওসি: কোর্টে যান। কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করুন। আমার কাছে এসেছেন কেন?
তাপসঃ আপনি কি জানেন আমার বাবা জমি বেচে টাকা দিয়েছে রথীন দত্তকে?
প্রশান্তঃ আপনি কি জানেন আমি মায়ের গয়না বেচে টাকা দিয়েছি রথীন দত্তকে?
মৌসুমীঃ আপনি কি জানেন আমার ভায়ের চাকরি চলে যেতে ও কাউকে কিছু না বলে গতকাল পাগলের মত বাড়ি থেকে চলে গেছে? শুধু রথীন দত্ত নয়। রথীন দত্ত বরফের চূড়ো। অনেক রাঘব বোয়াল পেছনে আছে।
ওসি: ওসব ফালতু কথা আমাকে বলতে এসেছেন কেন?
তাপসঃ ফালতু কথা? আপনি সব জানেন।
প্রশান্তঃ ওই কয়েকটা লোকের জন্য আমাদের সকলের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
ওসি: তোমরা আমাকে বলছ কেন?
মৌসুমীঃ কাকে বলব? আপনি তো এলাকার ওসি। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি।
ওসি: বললাম তো। কোর্টে গিয়ে অভিযোগ করুন। এটা কোর্ট নয়।
মৌসুমীঃ কোর্টে যাবার পয়সা কে দেবে? আপনি? আমরা অভিযোগ করছি রথীন দত্তর নামে। আপনি স্টেপ নিন।
তাপসঃ হ্যাঁ। রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করব।
ওসি: (হেসে) রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করবে?
প্রশান্তঃ হ্যাঁ। আর আপনাকে ডায়েরি নিতে হবে।
মৌসুমীঃ আর ওকে অ্যারেস্ট করতে হবে।
ওসি: (হেসে) তাই নাকি?
মৌসুমীঃ হ্যাঁ। তাই।
অর্নবঃ আর তা যদি না করেন, আমরা গণআদালত করে ওর বিচার করব।
ওসি: (হেসে) তাই নাকি? এতবড় নেতা হয়ে গেছ? এরকম বেআইনি কাজ করলে আমরা কী করব জানো?
তাপসঃ হ্যাঁ। আইন দেখিয়ে আমাদের অ্যারেস্ট করবেন। কিন্তু ঐসব চোরেদের চিটিংবাজির ব্যাপারে আপনাদের আইন চুপ করে থাকে।
(রথীন দত্তর প্রবেশ)
রথীন দত্ত: কী ব্যাপার অফিসার?
ওসি: (হেসে)এরা আপনাদের বিরুদ্ধে ডায়েরি করতে এসেছে।
রথীন দত্ত: তাই নাকি?
ওসি: (হেসে) আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বলছে।
রথীন দত্ত: আচ্ছা?
ওসি: (হেসে) বলছে গণআদালতে আপনার বিচার করবে।
রথীন দত্ত: পিটিয়ে বের করে দিন থানা থেকে।
ওসি: ঠিক। সেটাই করতে হবে। বহুৎ বাড়াবাড়ি করছে।
অর্ণব: (চিৎকার করে) দিন। পিটিয়ে বের করে দিন আমাদের থানা থেকে। কিন্তু আমাদের মুভমেন্ট থামবে না। প্রতিদিন বেড়ে চলবে। প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়বে। আর আপনাদের নেতাদের চামচাবাজি করার মুখোশ টেনে খুলে ফেলবে।
ওসি: (পুলিশদের ডাকে) এই! এদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
(দুজন পুলিশ ওদের ধাক্কা দিয়ে বার করতে থাকে। ওরা বেরোবার সময় প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী চিৎকার করতে থাকে।)
।। তৃতীয় দৃশ্য।।
(অর্ণদের বাড়ি। রাতের বেলা। কলিং বেল। অর্ণবের বাবা দরজা খুলে দেন। একজন সাবইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ ঢুকে পরে।)
সাবইন্সপেক্টর: কোথায় আপনার ছেলে? তাকে ডাকুন।
সুনীল: কেন?
সাবইন্সপেক্টর: আমরা ওকে থানায় নিয়ে যাব।
সুনীল: এত রাতে কেন ওকে থানায় গিয়ে যাবেন?
সাবইন্সপেক্টর: সেই কৈফিয়ত আপনাকে দেব না।
সুনীল: আপনাদের কাছে ওর কোন নামে কোন আরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?
সাবইন্সপেক্টর: আপনাকে কোন জবাবদিহি করব না। ওকে ডাকুন।
সুনীল: ও ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ঘুমোচ্ছে।
সাবইন্সপেক্টর: (পুলিশদের)এই তোমরা ছাদে গিয়ে ওকে নীচে নামিয়ে নিয়ে এসো। (পুলিশদের কানে কানে কিছু বলে। পুলিশদুটো ওপরে চলে যায়।)_
সুনীল:একি! আপনারা আমার বিনা পারমিশনে ওপরে গেলেন কেন? আপনাদের কি কোন সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? (অর্ণবের মা তপতী ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে)
তপতী: কী হয়েছে? পুলিশ কেন?
সুনীল: অর্ণবকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।
তপতী: কেন? কী করেছে আমার ছেলে? আমার ছেলেকে কোথাও নিয়ে যাবেন না।
সুনীল: ওরা অলরেডি আমাদের ছাদের ঘরে চলে গেছে অর্ণবকে ধরতে।
তপতী: না আমার ছেলেকে ধরবেন না। আপনারা এসব করতে পারেন না।
সাবইন্সপেক্টর: চোপ। আর একটা কথা বললে আপনাদের দুজনকেও তুলে নিয়ে যাব।
সুনীল: মানে? জোর যার মুল্লুক তার। গাজুয়ারি পেয়েছেন। রাত দশটার সময় বাড়িতে এসে বিনা ওয়ারেন্টে আমাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যাবেন?
সাবইন্সপেক্টর: হ্যাঁ। যাব।
সুনীল: আপনারা এসব করতে পারেন না।
সাবইন্সপেক্টর: চোপ। একটা কথা বলবেন না।
সনীলঃ রাতের বেলায় ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে মাস্তানি করছেন পুলিশ অফিসার হয়েছেন বলে? দেশে আইন নেই? বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।
সাবইন্সপেক্টর: চোপ। পুলিশ অফিসারকে বেরিয়ে যেতে বলছে! এত স্পর্ধা!
সুনীল: হ্যাঁ বলছি। ঐ পুলিশ দুটোকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আপনাদের কাছে কোন ওয়ারেন্ট নেই। বেআইনিভাবে ঢুকে মাস্তানি করছেন।
( সাবইন্সপেক্টর অর্নবের বাবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়)
তপতী: একি! আমার স্বামীকে মারলেন কেন? কেন মারলেন? কেন মারলেন? (তপতী চিৎকার করতে থাকেন। এই সময় পুলিশ দুটো নেমে আসে।)
প্রথম পুলিশঃ স্যার কাজ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় পুলিশঃ কমপ্লিট।
সাবইন্সপেক্টর: কী ব্যাপার?
(একজন পুলিশ সাবইন্সপেক্টর কে কানে কানে কিছু বলে)
সাবইন্সপেক্টর শুনুন সুনীল বাবু। আপনার ছেলেকে পুলিশরা ধরতে গেছিল। ও পুলিশের হাত ছাড়িয়ে তিনতলার ছাদ থেকে রাস্তায় লাফ দিয়ে পালাতে গেছিল। এখন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই তোমরা চলো।
(অর্ণবের বাবা ও মা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাইরে থেকে অনিল দৌড়ে ঢোকে।)
অনিল: দাদা, এরা অনুকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখনি চলো। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
সাবইন্সপেক্টর: কে বলল ওকে আমরা ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি?
অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) আমার জানলা থেকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সাবইন্সপেক্টর: আপনি ভুল দেখেছেন।
প্রথম পুলিশঃ হ্যাঁ। আপনি ভুল দেখেছেন।
দ্বিতীয় পুলিশঃ ও আমাদের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছে।
অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) না। আপনারা মিথ্যে বলছেন। আমি নিজে দেখেছি ওকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
সাবইন্সপেক্টর: (প্রচণ্ড ধমকে) আপনি ভুল দেখেছেন। এই তোমরা চলো।
অনিল: ওকে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান।
সাবইন্সপেক্টর: আপনারাা নিয়ে যান। লাফ দিয়েছে ও। আমরা ওকে লাফাতে বলিনি। এই চলো। (বেরিয়ে যায়।
অনিল: দাদা! বৌদি,!এখনি চলো। এভাবে ভেঙে পোড়োনা। অনুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে গেলে হয়ত অনু বাঁচতে পারে।কী করছ দাদা? ওঠো ওঠো। (প্রচণ্ড আকূতি করে চিৎকার করে) ওঠো ওঠো।ওঠো…………………….
(প্রচণ্ড আবহ। অন্ধকার।)
(অন্ধকার মঞ্চে অতি ক্ষুদ্র আলোকবৃত্তে উদ্ভাসিত হয় অর্ণবের মুখ)
অর্ণব: আমারতো মৃত্যু হল। এরপর কী কী ঘটবে আমি বলে দিতে পারি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হইচই করবে। একদল বলবে দুর্ঘটনা। অন্যরা বলবে হত্যা। ময়নাতদন্ত বলবে দুর্ঘটনা। বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ আন্দোলন বিক্ষোভ মিছিল হতে থাকবে। আমার মুমূর্ষু শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবা মাকে মিডিয়ার লোকরা এসে নিয়মিত বিরক্ত করে যাবে। বাবা-মা- কাকার মুখ বন্ধ করার জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া ও প্রলোভন দেখানো চলবে। বুদ্ধিজীবীদের মোমবাতিগুলো নেভানোই থাকবে। তারপর মানুষেরা কমবেশি ফ্রী লজেন্স পেতে পেতে ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে। একটা ছোট্ট শহীদ বেদী হয়ত হবে। সেটাও আসতে আসতে ময়লা হয়ে যাবে। এইভাবে দিন মাস বছর গুলো গড়িয়ে একদিন ভোট এসে যাবে। শপথগ্রহণ হবে। তারপর কোনদিন আবার কোন অর্ণব হয়ত পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরবে বা তাকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আপনাকে বলা হবে আপনি ভুল দেখেছেন, ভুল শুনেছেন, ভুল বুঝেছেন।
(নাটকটি প্রযোজনার অনুমতির জন্য যোগাযোগঃ 8910019589)