চিনে রাখা প্রয়োজন

সায়ন কর্মকার


Nov. 18, 2024 | | views :819 | like:2 | share: 2 | comments :0

আজ একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের বিজ্ঞান দুর্বার গতি লাভ করেছে। অভূতপূর্ব তার উন্নতি। আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানকে এবং বিজ্ঞানের দৌলতে পাওয়া কৃতকৌশল প্রযুক্তিবিদ্যাকে জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহার করেও আমরা অনেকেই বিজ্ঞান বিরোধী। তবু আজ জনমনে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অলৌকিকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে চাইছে। বিজ্ঞান বিরোধিতার স্থূল ও সূক্ষ্ম চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ডারউইন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা-র বই, প্রবন্ধ লক্ষ লক্ষ বিক্রি হয়েছে। পরমাণু জগৎ থেকে মহাকাশবিদ্যা, এমনকি মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা বৃদ্ধির ব্যাপক চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ অলৌকিক শক্তির প্রতি নিরর্থক প্রার্থনা ছেড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আরাধনায় রত হয়েছে। তবু কেন মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ছে না? 

        এমন হওয়ার কারণটি আমাদেরই সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর হুজুর দল ও তার মদত পুষ্ট ধান্দাবাজ গোষ্ঠীর ধর্মীয় নেতা, জ্যোতিষী-তান্ত্রিক-বাবাজি-মাতাজি, প্যারাসাইকোলজিস্ট-রা কখনোই চায় না সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার আলো প্রবেশ করুক। তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সাধারণ মানুষদের ডুবিয়ে রাখে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের সুগভীর সাগরে, টিকিয়ে রাখে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজটাকে।

সম্প্রতি এক ভূত গবেষিকা ঈশিতা দাস সান্যাল ও তার দল "ডিটেকটিভ অফ সুপারন্যাচারাল (DOS)”উদয় হয়েছে যারা বিভিন্ন বিতর্কিত অঞ্চল গুলোতে (তথাকথিত ভৌতিক, অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা) সত্যানুসন্ধানের নামে একটা অলৌকিক আবরণে আবৃত পরিবেশ গড়ে তোলে এবং তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ব্যাখ্যা ও ভয়ের সঞ্চার করে। বছর খানেক আগেও এই ঈশিতা দাস সান্যালকে 'দাদাগিরি'-র মতো একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি(?) শো তে এসেও অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা ভূতুরে গুলগপ্পের চচ্চড়ি রান্না করতে দেখা গিয়েছিল। ঈশিতা দাস সান্যাল ও তাঁর দলের মতো আরো অনেক ভূত অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন বিজ্ঞানবিরোধী ধ্যান-ধারণা সঞ্চার করে চলেছে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কে। বলা ভালো প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে। এই সকল প্যারাসাইকোলজিস্ট রা স্বভাবে ধুরন্ধর চালাক প্রকৃতির। তাঁরা নিজে থেকে তো বলবে না যে, আমরা মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাই! খুব চালাকির সাথে নিজেদের অবস্থানটা তৈরি করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে তারা বিজ্ঞানের পক্ষে। বলবে, আমরা জানতে চাই কী আছে? যেন এমন একটা ভাব যে – অজানাকে জানার ভীষণ চেষ্টা। তাঁরা এমন কিছু যুক্তি সামনে নিয়ে আসে যেগুলো উপর থেকে দেখলে মনে হয় ভীষণ ধারালো যুক্তি। তাঁরা উপস্থাপন করেন — বিজ্ঞানে আজও প্রমাণিত হয়নি বলে ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? —এর  সাপেক্ষে বলতে পারি যে ঘোড়ার ডিম আজও প্রমাণিত হয়নি বলে, ভবিষ্যতেও যে প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? আবার এও শোনা যায়, "বিজ্ঞান আজও প্রমাণ করতে পারেনি যে ভূত, অলৌকিকতা নেই"। এর সাপেক্ষেও বলা যায় – হাঁসজারু, বকচ্ছপ, রামগরু ইত্যাদি আজও বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি যে এগুলো নেই। এই সকল যুক্তি দিয়ে যা খুশির অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়। আসলে এগুলো কোন যুক্তিই নয়। এগুলোকে বলা হয় লজিক্যাল ফ্যালাসি বা প্রতারণা মূলক যুক্তি।


প্যারাসাইকোলজিস্টদের তথাকথিত ভূত গবেষণার কাজে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেগুলোর সাহায্যে তাঁরা ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার অস্তিত্বের প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি গুলি ব্যবহার ক্ষেত্র বিজ্ঞানে। Electromagnetic field detector, External thermometer,  Parabolic Thermometer এই সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এগুলোর সাথে ভূত, আত্মা, অলৌকিক কোনও কিছুর অস্তিত্ব খোঁজার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। প্যারাসাইকোলজিস্ট ও জ্যোতিষীরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যায় অবৈজ্ঞানিক  প্যারাসাইকোলজি ও জ্যোতিষকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করতে। Extra -sensory perception (ESP) বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (Telepathy/দূরচিন্তা, Precognition/ ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, Clairvoyance/অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, Psycho-Kines (PK)/ জড় পদার্থে মানসিক শক্তি প্রয়োগ) -র মতো চমকদার অবান্তর বিষয়গুলির সাথে কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষা চয়ন করে আর উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে প্যারাসাইকোলজিস্টরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। তাঁরা বিজ্ঞানের মোড়কে বাঁধা এক রসালো অতিরঞ্জিত সাজানো গল্প মানুষের সামনে পরিবেশন করেন। আর তার সাথে মদত দেয় মেরুদণ্ডহীন সেলিব্রিটি ও তাবড় তাবড় মানুষেরা। যার ফলে সাধারণ মানুষ সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ফলে একটা কুপ্রভাব সমাজে বিস্তার করে। লজিক ছেড়ে ম্যাজিকে চালিত হয় মানুষ। সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষ ভালোবাসে অতিরঞ্জিত গল্প গুলো বিশ্বাস করতে, তার মধ্যে ডুবে থাকতে এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার লোভও সামলাতে পারে না। যার ফলে একটা গণ হিস্টিরিয়া তৈরি হয়। বিজ্ঞানের যুগেও মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মানুষদের সাথে প্রতারণা চালিয়ে এভাবেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছে প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় এখনো ডাইনি সন্দেহে হত্যা, ভূতে ভর এই সকল ঘটনা গুলি পরিলক্ষিত হয়। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যান এবং ঘটনাগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে মানুষের ভুল ধারণার অবসান ঘটানোর চেষ্টা চালান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই সকল বিজ্ঞানবিরোধী ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার ধারণা মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে   প্যারাসাইকোলজিস্টরা ডাইনি সন্দেহ, ভূতে ভরের মতো কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস গুলিকে পরোক্ষ ভাবে মদত দিচ্ছে। এদের চিনে রাখা প্রয়োজন। 

 এ সমাজ ব্যবস্থা ততটাই এগোয় যতটা মানুষ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি বিজ্ঞানমনস্কতা। মানুষ যতদিন না অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে মুক্তমনে বিজ্ঞানের পথে না চলবে ততদিন অগ্রগতির চাকা স্তদ্ধ রয়ে যাবে। প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা এ সমাজের শত্রু। তারা সমাজের অগ্রগতির চাকাকে বিপরীতে ঘোরাতে চাইছে।

আমরা, বিজ্ঞান প্রিয় তরুণ, দেখিয়ে দিতে চাই কারা সমাজের শত্রু, প্রকৃত দেশদ্রোহী ও দেশপ্রেমিককে। 

এই পরিস্থিতিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটা কথা খুব মনে পড়ে যায় — 

তখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ

উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি

এ যদি সমাজ হয়

তবে আমি সমাজবিরোধী।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929