কিছু রাজনৈতিক কথা

বিতান সানা


Nov. 23, 2024 | | views :295 | like:2 | share: 2 | comments :0

Bhakti in religion may be a road to the salvation of the soul. But in politics, Bhakti or hero-worship is a sure road to degradation and to eventual dictatorship.

বি আর আম্বেদকর Constituent Assembly এর শেষ দিন অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৫ শে নভেম্বর তাঁর বক্তৃতায় মধ্যে এই কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, কেন বলেছিলেন?

আমরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। কংগ্রেসের একটা বিক্ষুব্ধ অংশ যারা মূলত রাজনীতিকে ইনকাম করার রাস্তা হিসেবে দেখতো, তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি বিজেপি আর আরএসএসের সহায়তায় তৃণমূল কংগ্রেস নামের একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে। পরের বছরই ১৯৯৯ সালেই তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুপ্রেরণায় বিজেপির এনডিএর শরীক হয়েছিলো। এরপর ২০০৩ সালের আরএসএসের একটি অনুষ্ঠানে তারাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'দুর্গা' বলে অভিহিত করেন। মমতা প্রত্যুত্তরে জানান তাদের সাহায্য পেলে তিনি রাজ্য থেকে সিপিআইএমকে তাড়াতে পারবেন। অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট যে তৃণমূল কংগ্রেস কাদের সহায়তার দল গড়েছিলো। 

এবার কথা হলো এই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতি-আদর্শ আসলে কী ছিলো? আদৌ ছিলো কী? আজ্ঞে না। এটি একজন কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল, দিল্লি-পাঞ্জাবের আপ পার্টির মতো।

 এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেন সেটাই শেষ কথা। দলের ক্ষেত্রেও তাই, সরকারের ক্ষেত্রেও তাই। কেন, আমরা দেখিনি শিক্ষাবিষয়ক নানান ঘোষণা তিনি করছেন? এই দলের একটাই নীতি ছিলো। সেটা সিপিআইএম বিরোধিতা। এটা কোনো কথা বলুন? একটা দলের নীতি যখন শুধু সিপিআইএম তাড়ানো তাহলে বাংলার মানুষ কিভাবে এই দলকে বা দলের নেত্রীকে বিশ্বাস করলেন? বাংলার জনগণ একটুও জানতে চাইলেন না এই দল ক্ষমতায় আসলে কী নীতিতে রাজ্যের অর্থনীতি চালাবে? পলিসি ঠিক কী হবে? এই দলের ন্যাশনাল ইস্যুতে স্ট্যান্ড কী? দলের রাজনৈতিক স্ট্যান্ড কী? লেফ্ট না রাইট? নাকি সেন্টার? আমরা কেউ জানিনা। তারাও জানাননি আজ অব্দি কারন বাংলার মানুষের সে’সবে যায় আসে না। এই রাজ্যে বা এই দেশে মুখ দেখে ভোট হয়। সেই মুখ খুব ভালো বিরোধী নেতা বা নেত্রী হতেই পারেন।

কিন্তু, তিনি যে ভালো মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে নাও পারেন সেটা এই রাজ্যের বা এই দেশের মানুষ ঠিক মানতে চান না।

 সবাই মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। রাজ্যের হাল দেখেছেন নিশ্চয়ই। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনীতির জন্মলগ্ন থেকেই বুঝে গেছিলেন যে মিথ্যে কথা বারবার বললে সেটা একসময় সত্যি মনে হয়। নিশ্চয়ই হিটলারের ডানহাত গোয়বেলসের থেকে শিখেছিলেন এটা। তিনি মানুষকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন যে সিপিআইএম খারাপ, তৃণমূল কংগ্রেস ভালো। এর চেয়েও বড়ো কথা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি একজন সৎ নেত্রী। তার স্লোগান থাকতো মা মাটি মানুষ। ভুয়ো ডক্টরেট ডিগ্রি হোক বা নামের আগে কুমারী বসানো, মানুষ সবই দেখেছে, ভুলেও গেছে। কোনো প্রশ্ন করেনি। সিঙ্গুর বলুন বা নন্দীগ্রাম! তিনি এই দুটো জায়গায় সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সিপিআইএম আসলে কৃষকবিরোধী। কিন্তু, তিনি কৃষকদের পক্ষে। মানুষ এটা বিশ্বাস করেছিলেন। বিশ্বাস করবে নাই কেন? ২০১৬ সালে সিঙ্গুরের চাষের অযোগ্য জমি কৃষকদের হাতে পুনরায় ফেরত দিয়েছিলেন। তার সেই দক্ষতা ছিলো। পরবর্তীকালে দীপক ঘোষের বইগুলো পড়েই আমরা আসল তথ্যগুলো জানতে পেরেছি। তার মিথ্যেকথা বলা শুরু তার জন্মসাল থেকেই। যাইহোক, সেদিকে আর যাচ্ছিনা।


আপনাদের সবার মনে থাকবে, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষকে এটাই বলেছিলেন যে তাকে দেখেই যেন ভোট দেয় বাংলার মানুষ। ২৯৪ টি আসনে তিনিই প্রার্থী। বাংলার মানুষ সেটা বিশ্বাস করেছিলেন। কারন তারা তখনও মনে করতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই সৎ এবং মানবিক একজন মুখ্যমন্ত্রী। আপনি যদি ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৮ এর পর থেকে ২০১১ এবং তারপর 

২০১১ থেকে ২০২২ এর নানান ঘটনাগুলো দেখেন, আপনি বুঝবেন যে রাজনীতিতে একজনকে অন্ধভক্তি করলে ঠিক কী পর্যায়ে ক্ষতি হতে পারে।

 যেমন ধরুন তৃণমূল কংগ্রেস বাইরে বিজেপি বিরোধিতা করলেও, লোকসভার ভেতর বিগত ১১ বছরে বিজেপির আনা বিলগুলির বিপক্ষে একটিবারও ভোট দেয়নি। হয় পক্ষে ভোট দিয়েছে বা বিরত থেকেছে। এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন যে বাইরে বিরোধিতা করলে আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে 'ক্যা ক্যা ছি ছি' করলেই বাংলার জনগণ বলবে, 'দেখেছো, আমাদের নেত্রী সিএএ এর বিরোধিতা করছে'। কিন্তু, লোকসভায় যে সেই বিলের বিপক্ষে তৃণমূলের ২২জন এমপি ভোট না দিয়ে বিরত থাকলেন, সেটা খুব একটা সাধারণ মানুষ জানতে পারলেন না। এটাই ম্যাজিক। এই রাজ্যের মিডিয়া সেটাই ফলাও করে দেখাবে যেটা এই রাজ্যে হচ্ছে কিন্তু, ন্যাশনাল ইস্যুতে তাদের অবস্থান অতটা মিডিয়া দেখাবে না, প্রিন্ট মিডিয়া দেখালেও রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ খবরের কাগজ পড়েন না। পড়লেও সব খবর পড়েন না। আর এইভাবেই অন্ধভক্তি দ্বিচারিতাকেও হার মানিয়ে দেয়। তৃণমূল কংগ্রেস একটা রাজনৈতিক দল তো বটেই, কিন্তু এদের কোনো রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নেই, এরা মূলত 'পপুলিজম' নামক একটি নীতিতে বিশ্বাসী যার অর্থ মানুষকে নানান স্কিমের মাধ্যমে শুধু বিলিয়ে যাও, কোষাগারের টাকা অবাধে খরচ করো। এই নীতি অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, দিল্লি সরকারও অনুসরণ করে। এরা সবাই রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতিহীন দল। এগুলো করার কারন যাতে তারা মূল ইস্যু নিয়ে মাথা না ঘামায়। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প এরমই একটি 'পপুলিস্টিক' নীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে গ্রামবাংলার লাখ লাখ মহিলারা অন্ধভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রীকে ভোট দিয়ে থাকেন, তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন। ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে গ্রামে গ্রামে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা রাতের বেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বুঝিয়েও এসেছিলেন পুনরায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় না আনলে, লক্ষ্মীভান্ডারে টাকা পাবেন না তারা। অগত্যা!


২০১১ থেকে ধারাবাহিকভাবে গোটা রাজ্যে সবকিছু নীল সাদা রঙে মুড়ে দেওয়া, ঝাঁ চকচকে করে দেওয়াটাও এর অংশ। এর ফলে মানুষ এটা দেখতে চাইবেন না যে ভেতরে কী আছে, এটা কতটা টেকসই, বা এটা আসলে কে তৈরি করেছে আর কে নতুন রং করে নিজের নামে চালাচ্ছে? বাইরের সৌন্দর্য দেখেই তারা ভাববেন এটাই উন্নয়ন। আপনিই বলুন বাড়িঘরের বাইরে রং করলে, সেটাকে পরিষ্কার রাখলে দেখতে ভালো লাগেনা? রঙিন-উজ্জ্বল কিছুতে আমাদের চোখ আটকে যায়। 

যেমন ধরুন, সরকারি হাসপাতাল। সেটাকে ভালো করে রং করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলেই যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ এটাতেই খুশি।

 তারা জানতে চাইবেন না সেখানে কী কী সরঞ্জাম আছে, কতজন এমডি ডাক্তার আছেন, এমার্জেন্সিতে কতজন থাকেন, কতজন ট্রেইন্ড নার্স আছেন, বেড কতগুলো আছে, দরকারে বেড পাওয়া যাবে কিনা? অনেকটা তৃণমূলের নেতারা যেইভাবে উডবার্ন ওয়ার্ডে বেড পান। হাসপাতালে নানান অপারেশনের সুবিধে কতটা আছে, রেফার করার প্রবণতা নেই তো? ওষুধের সহজলোভ্যতা কতটা আছে, কোনো সিন্ডিকেট চলছে কিনা ইত্যাদি। কারন এগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। কী বলেন? যেমন ধরুন, সল্টলেক স্টেডিয়াম। ১৯৮৪ সালে তৈরি করলো বামফ্রন্ট সরকার, কিন্তু, ২০১৭ সালে অনুর্দ্ধ ১৭ পুরুষ ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য সেটাকে পুনঃসংস্কার করার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করে নিজের নামে সেখানে ফলক বসিয়ে দিয়েছেন। কেউ প্রশ্ন করেছে? দুয়ারে রেশন এরমই আরও একটি উদাহরণ। রেশন নেওয়া সাধারণ মানুষ জানতেও পারছেন না এই দুয়ারে বা বলা ভালো পাড়ার মোড়ে/ ক্লাবের সামনে রেশন দেওয়ার ফলে সরকারের অতিরিক্ত কত টাকা খরচ হচ্ছে যা আমাদের করের টাকা। তারা ভাবছেন তারা সুবিধে পাচ্ছেন, এই সরকার মমতাময়ী, মানবিক কিন্তু রেশনের দোকানে নিজেরা গেলে সরকারের কত টাকা সাশ্রয় হতো সেটা তারা জানেনও না। 


এখানে বলে রাখা ভালো যে হাইকোর্ট এটাকে বেআইনি বললেও খাদ্য দপ্তরের উচ্চপদস্থ অফিসারদের ধমকের চোটে রেশন ডিলাররা এখনও এই বেআইনি প্রকল্পটি চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। একইভাবে সরকারের করের টাকায় প্রায় প্রতিদিন সমস্ত প্রিন্ট মিডিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন করাটাও এর অংশ। কেউ প্রশ্ন করেননা যে কেন এত ফালতু টাকা খরচ করা হচ্ছে? রাস্তার গর্তগুলো অন্ততঃ এই টাকায় ভরাট করা যেত। কিছুদিন আগে তৃণমূলেরই এক নেতার ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেলন। কিন্তু, ওই যে সাধারণ মানুষ মনে করেন দুর্ঘটনা তো ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকারের এক্ষেত্রে কোনো দায় নেই। রাজনীতিতে একজনের প্রতি অন্ধভক্তি আসলে সত্যিই সবকিছু ভুলিয়ে রাখে। প্রশ্ন করতেই শেখায় না। আপনি সেই দলে নেই তো?

তথ্যসূত্র:

Anandabazar Patrika 

The Print

The Hindu

The Tribune

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929