দুর্নীতিযোগ (রম্যরচনা)

অশোক দাস চার্বাক


Dec. 3, 2024 | | views :769 | like:0 | share: 0 | comments :0

[শ্রী শ্রী গীতার উনিশতম অপ্রকাশিত অধ্যায়। রম্যরচনাটি               ইতিহাসসিদ্ধ নয়, ধর্মশাস্ত্র পুরাণাদির মত সম্পূর্ণ কাল্পনিক                                     একটি গণগুজব]          

        অত:পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবভাষায় উবাচ - আরেএ, অর্জুন ইয়ার, তুমি দেখিতেছি মহা বুদ্বু! পুণ্যতীর্থ কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে অনুষ্ঠিতব্য দুর্নীতির কথা ভাবিয়া তুমি অযথা সেন্টিমেন্টাল হইয়া পড়িতেছ! সিংহাসন দখলের ধর্মযুদ্ধে  দুর্নীতি  হইবেনা, ভোটে নেতাদের স্বেচ্ছাসেবী ফড়িয়ারা ছাপ্পাভোট মারিবেনা, সমাজবিরোধী মা মাটি মানবসেবীরা প্রক্সীভোট দিবেনা, চোরডাকাতেরা চুরি ডাকাতি করিবেনা, সাধুবাবারা বুজরুকি করিবেনা, জ্যোতিষীরা লোক ঠকাইবেনা, নেতা- মন্ত্রী চোরাকারবারীরা কালো টাকা জমাইবেনা, কালো কালো মা লক্ষীরা মেঝের তলায় লুকাইয়া, ব্যাঙ্ক বা সিন্ধুকে বন্দী হইয়া চাকুরীচোর,গরুচোর ইত্যাদী সমাজবিরোধীদের ঘর 'আলো করিবেনা'  - ইহা কিরূপে সম্ভব। ভু ভারতে এসব অবাস্তব কথা কে কবে শুনিয়াছে,না দেখিয়েছে?

        শোন বন্ধুবর, রাজাকে অবশ্যই দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে হয়। চুরি ডাকাতি, খুন খারাবী, সমুদ্রমন্থণাদিতে প্রতারনা করিয়াই সত্যযুগে দেবত্বলাভ, দ্বাপরযুগে রাজত্বলাভ এবং কলিযুগে নেতাত্ব ও মন্ত্রীত্বলাভ করিতে হয়। যুগ অনুযায়ী ভক্ত, প্রজা বা ভোটারগণের পকেট কর্তন,প্রয়োজনে তাহাদের মস্তক ছেদন করিয়াই দেববিলাস,রাজবিলাস, মন্ত্রীবিলাস নেতাবিলাস ইত্যাদি করিতে হয়। রাজার সিংহাসনই বলো, মন্ত্রীর শৃগালাসনই বল, ডাকাত নেতাদের গুপ্তধনই বল - সবই দুর্নীতির ফসল। সেই চোরাই মালের বখরা লইয়া এই যে ধর্মযুদ্ধ ঘটিতে চলিয়াছে  তাহারতো গোড়াতেই দুর্নীতি। কিন্তু জানিও যে এই দুর্নীতি ধর্মসম্মত এবং এ যুদ্ধ অবশ্যই আগামী কলিকালের  ভোটযুদ্ধের মত ধর্মযুদ্ধ। দুর্নীতি দুর্নীতি বলিয়া শোরগোল তুলিয়া এ যুদ্ধে বিরত হইলে তুমি মহাপাতকী হইবে।  দেবতাগণ তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করিবেন, কেননা তাঁহারাও   চোরাইমালের বখরার নৈবেদ্যলাভ কাটমানিলাভ করিয়া দেবতাগিরি,নেতাগিরি ইত্যাদি করেন। দেবনীতি, রাজনীতি,নেতানীতি, প্রজানীতি,ভোটারনীতি মানেই দুর্নীতি। ভবিষ্যত কলিকালের গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে   বর্ণচোরা আপাত 'সৎ' (কেতনা ত্বক) ভোটারগণ দুর্নীতি করিবার সুযোগপ্রাপ্তির গোপন আশায়-অভিপ্রায়ে  দুর্ণীতিগ্রস্ত  দুর্নীতিঅভিজ্ঞ  নেতা মন্ত্রীগণকেই ভোট দিয়া মন্ত্রী সিংহাসনে বসাইবেন। দুর্নীতি করিবার সুযোগ না পাইলে দলবদল করিবেন, অথবা নুতন দল ফ্লোট করিবেন। অতএব তুমি দুর্নীতি  ত্যাগ করিওনা। মেকিয়াভেলী, চাণক্য ইত্যাদী আগামী দিনের রাজনীতি বিজ্ঞানীরা এই উপদেশ দিবেন  বলিয়া আমার দিব্য চক্ষুতে দেখিতে পাইতেছি। দুর্নীতি করিতে করিতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাইয়া বক্তৃতা দাও, টিভির তর্কসভায় গাল ফোলাইয়া, গলা ফাটাইয়া ঝগড়াকলহ কর, বিদ্বজনের সেমিনারে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দাও, ইহাতে কোন ক্ষতি নাই। এই পবিত্র শঠতায় সরল পাবলিক বেশ গ্যাস খাইবে। চীৎকার চ্যাঁচামেচি কুরুচিকর গালমন্দ করিবার গণত্রান্ত্রিক অধিকার লাভ করিয়া কৃতার্থ হইবে। পেট খালি থাকিলেও মন ভরিবে। তাহারা সন্তুষ্ট থাকিয়া ক্রোধ প্রশমিত করিবে। তাহাদের সুগার প্রেসার কমিবে। তাহা বলিয়া পবিত্র দুর্নীতিকে সমূলে পরিত্যাগ করিবে - ইহা কদাপি ধর্মসম্মত বাস্তবসম্মত  নহে। 

           হে প্রিয়সখা, হস্তিনাপুরের রাজত্বে তোমাদের কোন আইনসম্মত অধিকার নাই।  জুয়া খেলিয়া সবই খোয়াইয়াছ। অজ্ঞ  লোকে বলিবে, সে তো কপট জুয়া - বেআইনী। কিন্তু হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, বেআইনী চুরি,আইনসম্মত চুরি বলিয়া যেমন আলাদা কিছু হয়না, তেমনি জুয়া ইজ জুয়া, চুরি ইজ চুরি, আবার জুয়াচুরিও জোচ্চুরি, চাকুরীচুরি গরুচুরি, কয়লাচুরিও চুরি। জুয়া নীতিসম্মত না হইলেও ধর্মসম্মত। কপট জুয়াও জুয়া, সৎ জুয়াও জুয়া।খাঁটি মদও মদ, আবার ভেজাল চোলাইও মদ। স্বর্গের কারণবারীও মদ আবার সুইজারল্যান্ডের হুইস্কি বা রাশিয়ার ভোদকাও মদ।  ভোটযুদ্দ্বে সরলমতি ভোটারকে আলফাল বোঝাইয়া, পঞ্চ বৎসর পূর্বের  ভোটে  দেওয়া তামাদী প্রতিশ্রুতিগুলি রিনিউ বা ঘুষ প্রদান করিয়া অথবা ছাপ্পা ভোট,বুথ দখল ইত্যাদী ন্যায়সঙ্গত শাস্ত্রসম্মত দুর্নীতির দ্বারা ভোটে জয়লাভ করাও জেতা। বোমা মারিয়া, ভয় দেখাইয়া জয়লাভ করাও জেতা। আবার কালো টাকার বিনিময়ে মীরজাফর এম এল এ, এম পি,কাউন্সিলার ইত্যাদী লাইভস্টক ক্রয় করিয়া দুর্নীতি করিবার অধিকার দখল করাও জেতা। 

               হে পাণ্ডবকুলতিলক, চিন্তা করিয়া দেখ, রাজত্ব খোয়াইয়াছ।এখন খাইবে কি করিয়া। রাজার সন্তান হইয়াতো আর কৃষিজীবী, গোপালক বা আমার মত রাখালবালকদিগের মত খাটিয়া খাইতে পারনা। পূজনীয় দেবদেবী,সম্মানীয় যুদ্ধে হারা রাজা মন্ত্রী,ভোটে হারা মাননীয় নেতা মস্তানগন অনভ্যস্ত হস্তে হাপর টানিয়া বা লাঙ্গল চালাইয়া দেববিলাস, রাজবিলাস, নেতা বিলাস, মস্তানবিলাস করিবে - ইহা বিধিসম্মত নহে। সশস্ত্র ডাকাতির সাহায্যে অপরের রাজ্যের দখল লইয়া প্রজাশোষণ করিয়াই তোমাদের খাইতে হইবে।  

              ভগবান সঞ্জয় তখন  অর্জুনের কানের কাছে আস্তে আস্তে বলিলেন,হে তৃতীয় পান্ডব, পরিকল্পনা ছিল কোনক্রমে পাঁচখানা গ্রামের দখল লইয়া ধীরে ধীরে পুরা রাজ্য দখল করিবে।  সুঁচ হইয়া ঢুকিবে আর ফাল হইয়া বাহির হইবে। কিন্তু ধূর্ত কৌরবরা তোমাদের মতলব ধরিয়া ফেলিল।  সে কারণে পাঁচখানা গ্রামের প্রজাশোষণের সামান্য বখরাও দিতে কৌরব পার্টি রাজি হইলনা। তোমাদর  কারসাজি ফাঁস হইয়া গেল। অতএব এখন আর কোনো উপায় নাই। যেনতেন প্রকারেন যুদ্ধ জয় করিয়া  পুরা রাজ্যের দখল লইতেই হইবে। এখন ন্যায় নীতির কথা কপচাইলে না খাইয়া  মরিবে। তুমি শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। অস্ত্রবলে বলীয়ান তুমি। তোমার তীরের ফলাই শক্তির উৎস।  ন্যায়নীতি, আইনাদী দুর্বল অক্ষম এলেবেলে ভদ্রলোকেদের নিমিত্য সৃষ্টি হইয়াছে, তোমার মত বীরের জন্য নহে। দুর্নীতি দর্শনে গেল গেল রব তুলিয়া বিচলিত হওয়া তোমার শোভা বর্ধন করেনা।  প্রয়োজন হইলে তিনশো ছাপ্পান্ন বা ইমার্জেন্সি জারি করিয়া ন্যায়ধর্মের ভন্ডামীটাও মন-গাত্র হইতে ঝাড়িয়া ফেল।  পবিত্র ভারতভূমিতে সনাতন   দুর্নীতিধর্ম পালন কর। এই দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিতে আমি  যুগে যুগে আবির্ভুত হই। আমিই সব কৰিব।  তুমি সরকারী আমলা রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির রবারস্ট্যাম্পের  মত নিমিত্তমাত্র।  

        হে মহামতি অর্জুন, আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া অতীতের ইতিহাস প্রতক্ষ কর। কি দেখতেছ?অবতারগণের শ্রেষ্ঠ মডেল মাননীয় রামচন্দ্রও রাজত্ব হারানোর আশঙ্কায় দুর্নীতির আশ্রয় লইতেছেন।পাবলিকের নো  কনফিডেন্স মোশানের ভয়ে ভীত হইয়া সরলমতি পত্নীর সহিত চারশোবিশ করিয়া বেচারাকে বাড়িছাড়া করিতেছেন। দুষ্ট চক্রীদের ছড়ানো কেচ্ছা গুজব সম্পূর্ণ মিথ্যা বুঝিয়াও তাঁহার পতিব্রতা সতীকে বিনা অপরাধে অত্যন্ত বেআইনিভাবে চক্রান্ত করিয়া  তালাক দিতেছেন। ভাই লক্ষণের সাথে ষড়যন্ত্র করিয়া সরলমতি রাজরাণীকে তাঁহার অজান্তে বনবাসে পাঠাইতেছেন।প্রাপ্য খোরপোষও দিতেছেননা। অসহায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মরিল কি বাঁচিল সে সংবাদও লইলেননা। স্ত্রী পুত্রদের কথা বেমালুম ভুলিয়া রাজবিলাসে গা ভাসাইতেছেন। এমনকি এই আদর্শ অবতার নিজ স্ত্রীকে আত্মহত্যা করিতে পর্যন্ত প্ররোচিত করিতেছেন। তথাপি ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীগণ তাঁহাকে হৃদয়হীন দুর্নীতিগ্রস্থ অপবাদ দিয়া গালমন্দ করিলনা।  রাজপদ পরিত্যাগ করার দাবীতে প্রজাগণ বন্ধ হরতালও ডাকিলনা, সীতাও ৪৯৮এ করিলনা, সি বি আইও রামের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলনা। উপরন্তু আজও তাঁহাকে তাঁহারা মাথায় তুলিয়া পূজা করিতেছেন, তাঁহার আঁতুড়ঘরের দখল লইতে মারামারি কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোর্ট কাচারী করিতেছেন। ভবিষ্যতের কলিকালেও দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি আদর্শ রাজা,আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ শাসক হিসাবে বিরাজ করিবেন।  তাঁহার সেই সনাতন আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া নরকভীরু দেবভীরু মহান ভারতবাসীগন বধূহত্যা, বন্ধুহত্যা,ম্লেচ্ছহত্যা, পরধর্মীহত্যা, হরিজনহত্যা, নাস্তিকহত্যা ভিন্নমতবাদীহত্যা ইত্যাদী পুণ্যকর্ম করিতে উদ্বুদ্ধ হইবেন। কলিকালের উচ্চতম দেশশাসকেরাও সতী গৃহবধূকে ভরনপোষণতো দূরের কথা, নিজ ঘরে প্রবেশ করিতে পর্যন্ত অনুমতি দিবেননা। তাঁহার আধ্যাত্বিক  আদর্শ ভারতভূমিতে  জাতীয় আদর্শে পরিণত হইবে। সেই আদর্শ অনুকরন করিয়া সে দেশে কলিকালের ভবিষ্যতকালে  পুনরায় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। জয় রামসীয়ারামকি।

               হে মহাধানুকী, আমি ত্রিকালজ্ঞ। তুমি আমার এক চক্ষুতে অতীতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে। আবার আমার অপর চক্ষুতে ভবিষ্যতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে।   এইবার বল  তুমি কি দেখিতেছ? তুমি দেখিতেছ এই আদর্শ পুরুষ মনুকৃত ন্যায়নীতিহীন আইন পূতিগন্ধময় শাস্ত্র অনুযায়ী কিভাবে শম্বুকবধ করিতেছেন। রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া রক্তাক্ত শম্বুকমুন্ড দেখিয়া অমানুষ দেবতাগণ আনন্দনৃত্য করিতে করিতে হত্যাকারীর মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই পরম ধর্ম। মহামতি রামচন্দ্র সেই মহান ধর্ম রক্ষা করিলেন। পাপী শম্বুক  নিম্নশ্রেণীর ঘৃণ্য জাতির সন্তান হইয়াও জ্ঞানার্জনের জন্য সচেষ্ট হইয়াছিল। এই অভিপ্রায় ধর্মবিরোধী পাপকর্ম। ইহাতে স্বর্গের দেবতাগণ লজ্জিত হইতেছিলেন। পৃথিবী পাপে ভরিয়া যাইতেছিল। মহামতি রামচন্দ্র শূকরবৎ  নিম্নজাতির শুম্বককে খুন করিয়া দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিলেন। তিনি ধন্য, তিনি আদর্শ পুরুষ। তিনি পুরুষোত্তম। সে কারণে পিতৃপুরুষের হত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার পাইবার জন্য শম্বুকের বংশধর নিচু জাতির ভবিষ্যতের মানুষেরা আন্দোলন করিতেছেন। পিতৃহত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার জয় করিয়া আনন্দে ডগমগ হইতেছেন। 

                  হে তথাকথিত তৃতীয় পান্ডব! দুর্নীতি সর্বত্র। অধিক আর কি বলিব, তোমার জন্মেও দুর্নীতি। তোমরা কুন্তীপুত্র, মাদ্রিপুত্র বটে, কিন্তু তাহা বলিয়া সন্তান প্রজননে অক্ষম পান্ডুর ঔরসে তোমাদের জন্ম হয় নাই। তোমরা কদাপি পাণ্ডব নও।  রাজত্বের দাবী ন্যায়সঙ্গত করিবার নিমিত্বে ঘুরপথে তোমাদের পাণ্ডবপুত্র সাজানো হইয়াছে মাত্র। 

              হে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ, আবার বিবেচনা কর, চন্দ্রদেবকে ব্যভিচারী,ইন্দ্রদেবকে লম্পট, অথবা ব্রহ্মাকে নিজকন্যাগামী দুর্নীতিপরায়ণ আখ্যা দিয়া কেহ ঘৃণা করেনা। আমার নিজস্ব পরনারীগামী পরকীয়া লীলাও ধর্মীয় ব্যাখ্যা টিকাটিপ্পনীর ছলচাতুরীতে ধর্মসিদ্ধ ও কালে কালে আদালত দ্বারা আইনসঙ্গতও হইয়াছে। আমার শত শত নারীলীলার উপাখ্যানের বর্ণনাকীর্তন করিতে করিতে আমার ভক্তগণ দু হাত তুলিয়া নাচিতে নাচিতে, বাতাসা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, আবীর মাখিতে মাখিতে, চক্ষের জলে বুক  ভাসাইতে ভাসাইতে নগর কীর্তন করিয়া পুণ্যলাভ  করিতেছে। নির্জন কুঞ্জবনে ডজন ডজন গোপিনীদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করিতে সচক্ষে দেখিয়াও  নীতিপুলিশগণ আমাকে কান ধরিয়া উঠবস না করাইয়া আমাকে পূজা করিতে লাগিল। এইরূপে কলিকালে দেবতা সমান নেতাগণের ভোটচুরি,মন্ত্রীত্ব চুরি,চাকুরী চুরি, পুকুর চুরি, গুরুবাবাদের জোচ্চুরী প্রভৃতি দুর্নীতির অকাট্য প্রমান পাইয়াও ভোটারগণ সেই  দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের ভোট দিয়া গলায় মালা পরাইয়া তাহাদের শোষকগদিতে বসাইবে। গুরুবাবাদের শিষ্যরা জেলখানাবাসী মহামান্য ধর্ষক গুরুবাবাদের ভেট দিবে, তাহাদের পূজা করিবে। কেননা দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসকরাই তাহাদের দুর্নীতি করিবার সুযোগ করিয়া দিবে। 

              হে কৃষ্ণসখা, আমার বাক্য মন দিয়া শ্রবন কর। পবিত্র দুর্নীতি নারায়ণের অংশ। দুর্নীতিই ব্রহ্ম।  কি স্বর্গে, কি মর্ত্যে, কি সত্যযুগে, কি কলিযুগে, ইস্কুলে,কলেজে,  হাসপাতালে, অফিস আদালতে,দেবস্থানে গোরস্থানে  - দুর্নীতি সর্বত্র সদা বিরাজমান। প্রাকৃতিক মানবধর্ম ছাড়া বাকি সমস্ত মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম  ধর্ম, ধর্মীয় শাস্ত্র, ধর্মীয় প্রথা ও নিয়মকানুনে দুর্নীতি প্রচ্ছন্ন।  ধর্ম ও ঈশ্বরের জন্মও মিথ্যার গর্ভে, দুর্নীতির ঔরসে।  একথা জানিও যে when rationality ends, religion begins. প্রতিনিয়ত নুতন জ্ঞান অর্জনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়  যুক্তিবাদী জ্ঞানের সীমানা যে স্থানে শেষ হয়, সেই স্থানে ধর্মের উৎপত্তি হয়।  ঝড় বৃষ্টি বন্যা গ্রহণ ইত্যাদির যথাযথ প্রাকৃতিক কারণ না জানা থাকায়  চতুর অসৎ দূর্ণীতিগ্রস্হ মুনি ঋষিরা পবনদেব-বরুণদেব, রাহু-কেতু ইত্যাদীর মিথ্যা গল্পগুজব ফাঁদিয়া প্রচার করিয়া নিজ নিজ অজ্ঞতা গোপন করিয়াছেন এবং করিতেছেন। আর সরলমতি দৈবভীত ভক্তগণ প্রকৃতিদত্ত চিন্তনশক্তিকে নিশ্চল করিয়া সেই গুজবগুলিকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। অতএব হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, তুমি ধর্ম রক্ষার্থে দুর্নীতি করিতে বিচলিত হইওনা।  

               নেতা দেবতাদের পেটে টোকা মারিলে দুর্নীতির দুর্গদ্ধে পৃথিবী ভরিয়া যাইবে। রাজা-দেবতাগন মানবের শ্রদ্ধাভক্তি হারাইয়া কাটমানি নৈবেদ্যাদিবঞ্চিত হইবে। অসিযুদ্ধ অথবা ভোটযুদ্ধের পরে দেশে রাজা মন্ত্রীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু নুতন গদিতে বসা নেতা  পুরানো নেতামন্ত্রীকৃত দুর্নীতি ধরাইয়া দিবার ভয় দেখাইলেও কিভাবে আইনের কানাগলির আড়ালে ও মহামান্য আদালতের অসহায়তার সুযোগে সেসব দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। তাঁহারা  দূর্ণীতিগ্রস্থ তাঁহাদের সহধর্মী পূর্ববর্তী নেতামন্ত্রীদের শাস্তিপ্রদান করিতেছেননা।  বন্দী পুরুরাজ যেমন আলেকজান্ডারের নিকট রাজার অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন, দুর্নীতিগ্রস্থ প্রাক্তন নেতা মন্ত্রীরা কলিযুগে তেমনি সমসাময়িক নেতামন্ত্রীদের নিকট অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন। বর্তমানের দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসক পূর্ববর্তী প্রশাসকদের দুর্নীতির শাস্তিবিধান করিতেছেননা। 

        হে মহামতি অর্জুন, আমি ত্রিকালজ্ঞ। এবার তুমি আমার দক্ষিণ চক্ষুর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ভবিষ্যৎ অবলোকন করিতে থাক। ঐ যে শ্বেতপাথরের দেবতাবাসটি দেখিতেছ, মঠ মন্দির দেখিতেছ - ওগুলি কিভাবে নির্মিত হইয়াছে? হাজার হাজার ক্রীতদাসের রক্তে, তাহাদের শ্রমে, তাহাদের  ঘামে দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন স্বর্গলোভ দেখাইয়া, ক্যাডার ভক্ত নিয়োগ করিয়া তাহাদের বিলাসভবন বানিয়াছেন। ফলস্বরূপ মানবসন্তানগন অনাহারে অপুষ্টিতে মরিয়াছে।  কোনারকমন্দির গড়িবার ফলে দশ বৎসরকালব্যাপী দুর্বিক্ষে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে। যখন ঝড় বৃষ্টি রৌদ্রে অমৃতস্য পুত্র মানবসন্তানগন মাথার উপর সামান্য আচ্ছাদন পাইতেছেনা,তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন মানবের সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া কিভাবে মন্দিরবিলাস অট্টালিকাবিলাস করিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু ইহাও জানিও যে, এই দুর্নীতি অন্যায় হইলেও ধর্মসম্মত। ভবিষ্যতের নেতা মন্ত্রীগণ এইভাবে রাজভবনবিলাস, পাঁচতারা হোটেলবিলাস,রিসর্টবিলাস করিবার জন্য জনগণের নিকট তোল্লা কাটমনি আদায় করিবে। And these  corrupted Brutases are honourable men. এবং এরূপ পাপকর্ম ধর্মসম্মত।  

              হে পার্থ! চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখ। যখন অমৃততস্য পুত্র মানবসন্তানেরা অনাহারে মরিতেছে, তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন তাঁহাদের সহযোগী নেতা মন্ত্রী আমলা গুরুবাবা পুরোহিতগন কিভাবে বিলাসবৈভবে অলস দিনপাত করিতে করিতে লীলা করিতেছেন, কিভাবে দেবদাসী,পুরনারীদের সহিত ফস্টিনস্টি করিতেছেন। কিভাবে তাঁহারা ধূপধুনা,পুষ্পচন্দনাদি বিলাসদ্রব্যের সৌরভ সেবন করিতেছেন, কিভাবে বলির পশু,এমন কি মানব রক্ত পান করিয়া জিহ্বা মুখমন্ডল রক্তরঙে রঞ্জিত করিয়া অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ভয় দেখাইয়া টেররাইজ্ড করিতেছেন। কিভাবে অসহায় ফুলগুলির বৃন্তচ্চুত মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া নিজ নিজ অঙ্গশোভা বৃদ্ধি করিতেছেন। 

                সঞ্জয় আরও উবাচ,আমি ত্রিকালজ্ঞ।  সুদূর ভবিষ্যতে কি ঘটিতেছে তাহা আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করিতেছি। পুরাকালের ঘটনাবলীও আমার নয়নে কলিকালের টিভির ছবির মত  ফুটিয়া  উঠিতেছে। আমার চোক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কলিযুগের বিস্বরূপ দর্শন কর। 

                 অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কমললোচনের দিকে চক্ষু রাখিয়া শ্রীমান অর্জুন বলিলেন, সবুজ,গেরুয়া, সাদা নানা রঙের, নানা ধর্মের নানা ভগবানগণ তাঁহাদের প্রতিপক্ষ ভাগবানদের ভক্তদের ভাড়াটে গুন্ডার দ্বারা গুপ্তহত্যার ফতোয়া জারি করিতেছেন। মন্ত্রীরা গবাদি পশুদের যাবনা চুরি করিয়া উদরপুরণ করিতেছেন,কিভাবে গণেশজী মহারাজ শিশুদের দুগ্ধ চুরি করিয়া উদর স্ফীততর করিতেছেন, কিভাবে অপুষ্ট শত শত শিশুদের অনাহারে রাখিয়া তাহাদের দুগ্ধে লিঙ্গ শোধন করিতেছেন, কিভাবে পূজা লইবার ছলে ভক্তদের দেবস্থানে আমন্ত্রণ করিয়া পূজারত ভক্তগণকে কখনো জলে ডুবাইয়া, কখনো আগুনে পোড়াইয়া, কখনো পদপিষ্ট করিয়া, এমনকি পবিত্র শিন্নিতে বিষ  মিশাইয়া গণহত্যা করিতেছেন। চিড়িয়াখানার বিশ্বাসঘাতক শেরওয়ালীমাতা সরলমতি গুজববিস্বাসী ভক্তের ঘাড়  মটকাইয়া তাহার রক্ত পান করিতেছেন, নানা ধর্মের ভগবানভাইগন নরকের ভয় ও স্বর্গলাভের  লোভ দেখাইয়া ভীরু,দুর্বল  মনুষ্যদের নৈবেদ্য শোষণ করিতেছেন।  প্যারিস, নিউইয়র্ক,বালিতে নির্বোধ ধৰ্মোদ্মাদ ধার্মিকদের দ্বারা গণখুন করাইতেছেন।  স্বর্গীয় শুঁড়িখানায় বিনাপয়সায় কারণবারি  বিলাসব্যাসন, বেহেস্ত /স্বর্গের  ফ্রী পৌনপৌনিক  গণিকাভোগের লোভ দেখাইয়া টুইন টাওয়ার,তাজ হোটেলে গণহত্যায় প্ররোচিত করিতেছেন। আর দুর্নীতিগ্রস্থ পরজীবী পুরুত মোল্লা যাজকদের দক্ষিণা / কমিশন লুন্ঠন করিবার ব্যবস্থা করিতেছেন।  

                আরো দেখিতে পাইতেছি কলিযুগের দেবদেবীগণ ধর্মে দুর্বৃত্তায়ন করিতেছেন।  নিজ নিজ ঘরবাড়ি, প্রভাব প্রতিপত্তি, জমি জায়গা দখল ও রক্ষার্থে বিভিন্ন সাম্রদায়ের ভগবানগন পরস্পর  নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি মারামারি করিতেছেন। নিজ নিজ পার্টি ক্যাডার নিয়োগ করিয়া এক ভগবান অন্য  প্রতিযোগী ভগবানদের ঘরবাড়ী  আঁতুরঘর ভাঙিতেছেন, রাস্তাঘাট ফুটপাথ পাবলিকসম্পত্তি জবরদখল করিতেছেন, প্রতিপক্ষ ভগবানের সমর্থক ভক্তদের খুন কারাইতেছেন, ধর্মীয় রায়ট বাধাইতেছেন। দেবদেবীরা রাজা নেতামন্ত্রীদের মত গুন্ডা মস্তান পুষিতেছেন, দেবদেবীসেনা মারফত বারোয়ারী পূজা চাঁদা তোলা আদায় করিতেছেন। দুর্নীতিতে মদত দিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই ধর্মের প্রাণস্বরূপ। 

          সঞ্জয় বলিলেন, বেশ বেশ, আরো দর্শন কর। আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার দৃষ্টি ফিরাইয়া দ্বিতীয় চ্যানেলের ছবি দেখ।  কি দেখিতেছ?

           অর্জুন বলিলেন,দেখিতে পাইতেছি দেবদেবীদের বিচারব্যবস্থা। এক লালচাঁদ লালচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা - সারাজীবন চোরাকারবারী করিল, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মিশাইল, ওষুধে ভেজাল দিয়া গণহত্যা করিল, দেনা না মিটাইয়া ব্যাংকের টাকা আত্মস্যাৎ করিল। সে থানার আর মন্দিরের দেবতাগণের বামহস্তে প্রচুর ঘুষ প্রদান করিতে থাকিল। সেই মহাপাপী দেবদেবীদের নামে সিন্নিপার্টি দিল, অষ্টপ্রহর নামকীর্তন করিয়া দেবদেবীদের চাটুকারিতা করিল। গঙ্গাসাগরে ডুব দিয়া, সাগরমন্দিরের দেবতা/পুরুতদের চোরাই সোনাদানা, কালো টাকা ইত্যাদী উৎকোচ প্রদান করিয়া তাহার সমস্ত পাপ সমুদ্রজলে ধুইয়া ফেলিল। দেবতাদের সমর্থনে নগরকীর্তন, মিটিং মিছিল করিতে লাগিল। দেবতাদের বিলাসের জন্য শ্বেতপাথরের মন্দির বানাইয়া দিল। দূর্ণীতিগ্রস্থ দেবদেবীরা পাপী লালচাঁদের পাপপুণ্যের লেজার একাউন্ট বেআইনিভাবে পাল্টাইয়া ফেলিলেন। পূজা, চাটুকারিতা,নৈবেদ্য-উৎকোচের বিনিময়ে তাহার সমস্ত পাপকার্য ধামাচাপা দিয়া দিলেন। চুরি দুর্নীতির সমস্ত প্রমান লোপাট হইল, চিত্রগুপ্ত কেরানীর লেজার পাতা অদৃশ্য হইল। প্রমাণাভাবে স্বর্গীয় সি বি আই, স্বর্গীয় আদালত কিছুই করিতে পারিলনা।    

                মহামতি অর্জুন তখন এরূপ ধর্মীয় অনাচার দর্শন আর সহ্য  করিতে পারিলেননা।  প্রবল উত্তেজনায় তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করিয়া ফেলিলেন। শরীর এলাইয়া অশ্বসকটের সিটে শুইয়া পড়িলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে কোনোরকমে নিজ বক্ষে আকর্ষণ করিয়া প্রশান্ত কণ্ঠে কহিলেন, " হে প্রিয়সখা, চক্ষু উন্মোচন কর। দেবতাদের দুর্নীতি দর্শন করিয়া তুমি এরূপ উতলা হইওনা। নৈবেদ্য ঘুষ প্রদান ধর্মবিরুদ্ধ নহে। পূজাপাঠ,নৈবেদ্যপ্রদান ইত্যাদির দ্বারা পাপ ধামাচাপা দিয়া আখের গোছানো অনৈতিক বা অধর্মীয় কার্য্য নহে। বরং ইহাই ধর্মপালন, ধর্মীয় অভিনয়ের আসল উদ্দেশ্য। পাপী লালচাঁদ চরম দূর্ণীতিগ্রস্থ হইলেও সে ঈস্বরভীরু ধর্মপ্রাণ মানুষ। দেবতা,রাজা,নেতা মন্ত্রীদের উৎকোচ প্রদান,ভজন কীর্তন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদী কুকর্ম হইলেও ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকর্ম।  ইহাতে পুন্য জন্মে, এবং সেই পুণ্যে মনুষ্যকৃত সমস্ত দুস্কর্মের শাস্তি মকুব হইয়া যায়। মৃত্যুর পরে নরকে যাইতে হয়না।  ইহাই সত্য। তুমি তোমার চক্ষু উন্মোচন করিয়া সত্যদর্শন কর।  সত্যকে স্বীকার করিয়া চিত্ত শান্ত কর। বল সখা, এইবার তুমি কি দেখিতেছ?

            - আমি দেখিতে পাইতেছি মৃত পাপীদের পুত্রকন্যাগন পিতামাতার পাপপুণ্যের লেজার-বালান্সশিট উল্টাপাল্টা করিবার অভিপ্রায়ে  পিতামাতার শ্রাদ্ধশান্তি করিতেছে।  তাহারা পুরহিত টাউটের থ্রু দিয়া নানা দান-ভেট -উৎকোচাদি দেবতাদের হস্তে প্রদান করিয়া মহাপাপী পিতামাতার সমস্ত অনাচার,দুস্কর্মজাত পাপ ব্যাকডোরে মকুব করাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিতেছে। দুর্নীতিগ্রস্থ দেবদেবীগণ উৎকোচের বিনিময়ে পাপীদের নরকের জেলখানায় না পাঠাইয়া স্বর্গরাজ্যের ভিসা মঞ্জুর করিতেছেন। তাহারা তাহাদের আজীবনকৃত দুস্কর্ম পাপের প্রাপ্য শাস্তি হইতে অব্যাহতি পাইতেছে।  

           অর্জুন আরো বলিলেন,হে পার্থসারথী! আপনার কৃপায় আমি দ্বিব্যদৃষ্টি লাভ করিতেছি।  সুদূর ভবিষ্যতের দৃশ্য আমার চক্ষুতে প্রতীয়মান হইতেছে।  আমি স্পষ্ট দেখিতেছি যে ধর্মীয় চাটুকারিতা নৈবেদ্য পূজা ইত্যাদীর বিনিময়ে দেবদেবীগণ মন্ত্রী আমলাদের মত তাঁহাদের পছন্দমত ভক্তগনকে নানা সুযোগ পাওয়াইয়া দিতেছে।  পূজা দিলনা বলিয়া যোগ্য বেকার চাকুরী  পাইলনা, গ্যাসের ডিলারশিপ, মদের দোকানের লাইসেন্স পাইলনা, অথচ অযোগ্য,অশিক্ষিত দুশ্চরিত্র ব্যক্তি পূজাপাঠ, জাগযোগ,  উৎকোচ প্রদান করিয়া দেবতাদের বেআইনীভাবে  সবই বাগাইয়া লইল। অশিক্ষিত শিক্ষকগণ স্কুলে শিক্ষাদান করিতে লাগিল। অযোগ্যরা চাকুরী চুরি করিল, যোগ্যরা রাস্তায় বসিল।   

             আরো দেখিতেছি যে ভোটফান্ড নেতাফান্ড ইত্যাদিতে তোল্লা প্রদান করিয়া দূর্ণীতিগ্রস্তরা পার পাইয়া যাইতেছে, খুনির শাস্তি মকুব হইয়া যাইতেছে,রাজারহাট,সল্টলেকে জমি পাইয়া যাইতেছে। প্রাসাদবাসীরা গৃহহীনদের প্রাপ্য অনুদানের অর্থ আত্মস্যাৎ করিতেছে। 

              তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রবল আনন্দে হাততালি দিয়া বলিয়া উঠিলেন, " সাবাস অর্জুন ইয়ার, সাবাস।  তোমার বিশ্বদর্শন সম্পূর্ণ হইয়াছে। আর সময় নাই, আমার শেষ কথা শ্রাবন কর।  দুর্নীতি অবশ্যই অন্যায় এবং খারাপ কর্ম,  কিন্তু ইহা কদাপি পাপকর্ম নহে। অধর্মও নহে। বরং দুর্নীতি ব্যতিরেকে স্বর্গলাভ, রাজ্যত্বলাভ, মন্ত্রিত্ব, নেতৃত্বলাভ অসম্ভব। তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুন হইতে বান তুলিয়া লও। বক্তৃতামঞ্চে, সংবাদ মাধ্যমে, টিভির তর্কসভায়   ভোটনেতাদের অসভ্য বাক্যবান নিক্ষেপের মত তুমিও শত্রুর দিকে বান ছুঁড়িতে শুরু কর।  শঠতাবলে, চাতুর্য্যবলে, বুদ্ধিবলে, ছলনাবলে,  বাহুবলে,,আইনের অপব্যাখ্যাবলে রাজত্ত্ব ছিনাইয়া লও। 

             কুরুক্ষত্রের এই ধর্মযুদ্ধ যুগে যুগে চিরকাল দুর্নীতিগ্রস্থ ধার্মিকদের পথ দেখাইবে। গীতার এই সর্বশেষ অধ্যায় ভক্তিভরে পাঠ করিয়া ধর্মপ্রাণ জনগণ একাধারে দুর্নীতিধর্ম পালন করিতে উদ্বুদ্ধ হইবে, অন্যধারে পূজাপাঠ, নৈবেদ্যঘুষ প্রদানে প্ররোচিত হইবে। উত্তরোত্তর দুর্নীতিধর্ম জনপ্রিয় হইবে, সাথে সাথে জবর দখল করিয়া দেবদেবীগণ শিশুদের খেলার মাঠ, জনসাধারণের চলার পথ জবরদখল করিয়া প্রনামীর বাক্সভ্রাইবেন। 

                অতএব হে কৃষ্ণসখা, জানিয়া রাখিও - নিষ্ঠাভরে দুর্নীতিধর্ম পালন করা, দুর্নীতিধর্ম প্রচার করা এবং মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্থ রাখা, তাহাদের দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে বাধ্য করা সত্যযুগে দেবধর্ম,দ্বাপরযুগে রাজধর্ম ও কলিযুগে নেতাধর্ম। ইহাই সনাতন মৌলবাদী ধর্মের সার কথা - গীতার  সারমর্ম। যেদিন মানুষ পবিত্র দুর্নীতিধর্ম ত্যাগ করিবে সেদিন পৃথিবী পাপে পূর্ন হইবে।  দেবতাগিরি,রাজাগিরি, পুরুতগিরি, গুরুবাবাগিরি সমস্ত বৃত্তি ধরাধাম হইতে অবলুপ্ত হইবে।  সেই ভয়ঙ্কর দিনে দেবতা, রাজা, নেতা ফড়েদের খাটিয়া খাইতে হইবে।  

               সুতরাং হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। দেব দ্বিজ,রাজা মন্ত্রী, নেতা শোষকদের পবিত্র দুর্নীতি ধর্মের পথ দেখাও। তাহারা দূর্ণীতিগ্রস্থ ধার্মিক হউক। 

                অতঃপর কুরুক্ষত্রের যুদ্ধ শুরু হইল। নব নব যুগে, নব নব রূপে সে যুদ্ধ আজও চলিতেছে। ওং তৎসত - আমেন -

প্রথম প্রকাশ: ' অনির্বান ' শারদীয় সংখ্যা ১৪০৬ / ১৯৯৯

দ্বিতীয় প্রকাশ: চার্বাক রচনাবলী ২০১৬ (সামান্য সংযোজিত)

সমালোচনা ও ত্রুটিনির্ধারণ: asokdas.godless@gmail.com



আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929