পিতৃতন্ত্রে দাম্পত্য, আধিপত্য ও টক্সিক ব্যবহার - কিছু ভাবনা

সম্রাট সেনগুপ্ত


Nov. 18, 2024 | | views :886 | like:25 | share: 0 | comments :0

কিছুদিন আগে একটা বাংলা ছবিতে দেখছিলাম কর্মব্যস্ত স্বামী বার বার ফোন ধরছেন বলে স্ত্রী ফোনটা আছড়ে দিল। অতঃপর স্বামী গেল দোকানে ক্রুদ্ধ স্ত্রীকে খুশি করতে শাড়ি কিনতে। রোজ অজস্র দাম্পত্য জোকস ভেসে আসে মোবাইলে যার মূল কথা হল, স্ত্রীরা কলহপ্রবণ এবং কলহ মেনে জীবন কাটানো সংসারে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।

        সে এক সময় ছিল কিছুকাল আগে যখন স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর হেনস্থাকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হত। ওটা ছিল ভালোবাসারই আরেক রূপ - প্রকাশ। স্বামী ছিল সেই যে গালি দেয়, মারে, আবার সোহাগও করে। নিজের জন একটু খবরদারী তো করবেই আর কি। নারী নির্যাতন ও গৃহ হিংসা নিয়ে আমাদের সচেতনতা সেই বোধকে অন্তত শিক্ষিত ভদ্রলোক সমাজে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছে। 


        কিন্তু বারংবার বলে বলে যেন নারীর টক্সিক ব্যবহারকে, খবরদারী ও ঔদ্ধত্যকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। আসলে মূল পিতৃতান্ত্রিক পিতৃসুলভ নিয়ন্ত্রণের কাঠামোটি টিকেই থাকছে। নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো টিকে থাকলে যদি সেই নিয়ন্ত্রণ ও ঔদ্ধত্যের অধিকার নারীর কাছে যায় তবুও মূল আধিপত্যবাদী সিস্টেমটি টিকেই থাকে। অর্থাৎ নারী বা পুরুষের আদর্শ ব্যবহার ও যাপন কীরকম হবে তা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হতেই থাকে, সাথে চলে সম্পর্কের মধ্যে টক্সিক ব্যবহারকে স্বাভাবিক করে তোলার প্রক্রিয়া।

        এমতবস্থায় কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে টক্সিক ব্যবহারে অভ্যস্ত পুরুষ বা নারী কি ভালোবাসেন না। অবশ্যই বাসেন। তাদের ভালোবাসার ধারণার সাথে আসলে নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও ক্ষমতা প্রদর্শন যুক্ত। এক বিকৃত অধিকারবোধের পিতৃতান্ত্রিক ধারণা যেমন পুরুষকে দীর্ঘকাল প্রভাবিত করেছে, তা নারীকেও একভাবে চালিত করে। সমাজকে বদলাতে গেলে desire কেও বদলাতে হবে, ভালোবাসার ধারণাকেও বদলাতে হবে।


        অপরকে সম্মান দেওয়া এবং কাছের মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করা প্রতিটি মানুষের স্বীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সংসার তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে বিবাহ আমাদের সনাতন ভাবনা বলে যে যত যাই বলুক না কেন বিবাহ একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই ভাবনা থেকেই একজন পার্টনার আরেকজনের ওপর টক্সিক ব্যবহার ছুঁড়ে দেন। কারণ বিচ্ছেদের ভয় নেই। বরং অন্যজন মেনে না নিলে তার মধ্যেই যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করে। অর্থাৎ আপনার স্ত্রী আপনার মোবাইল ফোনটি আছড়ে ভাঙলে (তা সে যে কারণেই হোক না কেন) আপনার পক্ষে তা মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং উলটে আপনি সেই রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন আদর্শ স্বামী হিসেবে। 


         যে কোনও সামাজিক সম্পর্কে আমাদের অপর মানুষটি যেন ক্ষুব্ধ না হয় সেই চেষ্টা করে যেতে হয়। অফিসে, বাজারে, বন্ধুদের আড্ডায় আমাদের অন্য কারও ব্যবহার বা কাজ পছন্দ না হলেও নম্রভাবে তা ব্যক্ত করে বা তার ভিন্নতাকে সম্মান দিয়ে চুপ থাকি। এর কারণ সেখানে বিচ্ছেদের ভয় আছে। সোজা কথায় যার ওপরে আপনি খবরদারী করছেন, সে যদি আপনার ওপর নির্ভরশীল কর্মচারী না হন তা হলে সে আপনাকে এড়িয়ে চলবে, আপনার সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়বে। 


         অনেকে মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পর্কে সেই সম্ভাবনা নেই। মা বাবা তাই ছেলেমেয়ের ওপর যথেচ্ছ খবরদারী করেন, নিজের ধারণা অনুসারে তার ব্যক্তিত্ব ও যাপনকে চালিত করতে চান। একই কাজ দাম্পত্যে একে অপরের ক্ষেত্রে করতে থাকে স্বামী অথবা স্ত্রী। সেখানে হারানোর ভয় নেই, আছে সীমাহীন অধিকারবোধ ও আধিপত্য। সেখানে মানিয়ে চলা মানে একে অপরের টক্সিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিজের নিজস্বতাকে প্রকাশ না করা, দমিয়ে রাখা। মানিয়ে চলা মানে কখনোই অপরের ভিন্নতা ও ব্যক্তিত্বকে মেনে নিয়ে ও সম্মান করে একসাথে থাকা হয়ে ওঠে না। এই ideology of possession আসলে কোনও এক সময়ের মালিকানার ধারণার সাথে যুক্ত, যখন স্ত্রী অন্যান্য সম্পদের মতোই স্বামীর সম্পত্তির অংশ হতেন। এখন তা আমাদের আবেগ অনুভূতির সাথে মিশে গেছে।


        একটি পরিবারে সন্তান অপরের ভিন্নতাকে মর্যাদা দিতে শেখে না, শেখে না আপন ব্যক্তিত্বকে উদযাপন করতে। সে জানে বাবা মা তাকে যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রয়োজনে বকা মারা করতে পারে তার ভালোর জন্যেই। ভবিষ্যতে তার সমস্ত সম্পর্কের ধারণাই এই আধিপত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। অপরের ভালোর কথা ভাবতে গেলে তাকে বুঝতে হয় ও বোঝাতে হয় কারণ সে ভিন্ন মানুষ। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আপনার নেই। ছেলেবেলা থেকে এই প্রচেষ্টার অভাব দেখে মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক মনে করে। 

 

       আমি তোমার ভালো তোমার চেয়েও বেশি বুঝি তাই তুমি আমার কথা শুনে চলবে - এই ভাবনা হল paternalistic ধারণা। সেখানে একজন আরেকজনের কাছে বোদ্ধা এবং ক্ষমতাবান পিতা হিসেবে আবির্ভুত হয়। পুর্নবয়স্ক মানুষকেও তার পার্টনার এভাবেই paternalize করে। অপরের নিয়ন্ত্রণ কখনোই বিশুদ্ধ হয় না। কারণ সেও মানুষ। তারও ইচ্ছা অনিচ্ছা লিপ্সা আকাঙ্খা ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি আছে। অধিক নিয়ন্ত্রণবাদী পিতারা তাই অচিরেই খবরদারীতে অভ্যস্ত হয়ে পরে। মেয়ের ভালোর জন্য যেমন তারা মেয়েকে সন্ধ্যের পর বেরোতে দেয় না বা তার পোষাক নিয়ন্ত্রণ করে তেমনই একদিন মেয়ে কার সাথে মিশবে, কাকে বিয়ে করবে সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পিতা। অতঃপর পিতা স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের মতো হয়ে ওঠে। তার ভালোর ধারণা সন্তান মানতে না চাইলে তার পিতৃত্বের ইগো আহত হয়। তখন - 'তুমি আমার কথার অবাধ্য হচ্ছ' - টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন আর 'তোমার' ভালো নয়, জেগে ওঠে 'আমার' কথা, কারণ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, তোমার জন্য এত কিছু করে থাকি। 


       একই ঘটনা দাম্পত্যে অভিনিত হতে থাকে। স্বামী তো বটেই স্ত্রীরাও এখন স্বামীকে স্বীয় সন্তানের ন্যায় নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার ইচ্ছার বাইরে গেলে তাদের 'আমিত্ব' জেগে ওঠে। টক্সিক ব্যবহারকে তারা অধিকার মনে করে ও সেই অধিকারকে প্রশ্ন করলে তাতে ভালোবাসার অবমাননা হয়েছে মনে করে তারা। ইদানিং স্ত্রীর এই ভুমিকাকে গ্লোরিফাই না করা হলেও অন্তত স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে যেটুকু লিঙ্গ 



       চেতনা তৈরি হয়েছে তাতে পুরুষের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণকে, টক্সিক ব্যবহারকে সহজেই খারিজ করা চলে, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তা তেমন সহজ হয় না। তাই সর্বত্র হাসিঠাট্টার ছলে অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্যের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929