নীল দিন পালন করা বর্জন করুন

রাজর্ষি


Nov. 20, 2024 | | views :281 | like:0 | share: 0 | comments :0

সম্প্রতি কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে “বিশ্ব অটিজম সতর্কতা দিবস” পালন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি  প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নীল বাতি জ্বালাচ্ছেন, রিবন ব্যাজ পরছেন, পাজল চিহ্ন পোস্ট করছেন। কিন্তু জানেন কি, এই অনুষ্ঠান কোন বার্তা দেয়? 


আমি নিজে অটিস্টিক । অনেকের ধারণা অটিস্টিক ব্যাক্তি মাত্রই কথা বলতে লিখতে বা পড়তে অক্ষম, তাঁদের  জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি ঐ তিনটি কাজই আমি যথেষ্ট ভালভাবে করতে পারি। আমার নিজের বক্তব্য আমি তুলে ধরতে পারি, আর যেসমস্ত অটিস্টিক ব্যাক্তি এই তিন মাধ্যমে সংযোগ করতে পারেন না, তাঁদের প্রকৃত অনুভূতি ঠিক কিরকম, সেটা বলার মতো কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি রাখি; যেটা   “পেশাদার” বিশেষজ্ঞরাও বুঝতে পারেন না।   


অটিজম বিষয়ে লাগাতার প্রচারাভিযানের ফলে আজকাল অটিজম শব্দটি সবাই জানেন। অথচ অটিজম কী, সে বিষয়ে প্রায় কেউই ঠিকঠাক জানেন না । অটিজম কথার আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মমগ্নতা’, ডাক্তারি পরিভাষায় কোনো বিশেষ আকর্ষণের প্রতি প্রবল একাগ্রতা এবং একই কাজ বারবার করে যাওয়া, সামাজিক বোধ এর অভাব। 


এখন, ভাবার বিষয় হল, ‘আত্মমগ্নতা’ কে  আদৌ ‘ব্যাধি’ বলা উচিত কিনা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিক্ত সত্য এই, যে, যেসমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তি আত্মমগ্নতা কে ‘ব্যাধি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন সরাসরি নাৎসি গণহত্যাকারী সুপ্রজননবাদী। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যাক্তিদের, অর্থাৎ যাদের “educability” কম থাকতো, যাদের ‘ডিসিপ্লিনড’ করা যেতনা, তাদের হত্যা করা হত।  ফলে ‘আত্মমগ্নতা’ যাকে এখন ব্যাধি বলে গণ্য করা হয়, সেটি কতটুকু ব্যাধি, আর কতটুকু সমাজযন্ত্রের শিকার, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। 


এখন, কথা উঠতে পারে, যে অটিস্টিক ব্যাক্তি কি সমস্যার সম্মুখীন হন না? অবশ্যই সমস্যার সম্মুখীন হন, এবং তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষের চাইতে অনেক, অনেক, অনেক বেশি। কিন্তু একটু ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অবশ্যই দেখা যায় ‘আত্মমগ্নতা’ সমস্যাগুলির কারণ নয় বরং সমাজই সমস্যাগুলির উৎস।  ধরুন, কোনো ব্যাক্তি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না।  তাহলে তাঁর কর্মস্থলের সহকর্মী, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাঁর ‘পিছনে লাগবেন’, তাঁর ‘ঘণ্টি বাজিয়ে’ দিয়ে চলে যাবেন। যেন অটিস্টিক ব্যাক্তি টি কোনও গুরুতর অপরাধ করেছেন। ডাক্তারবাবুরা হয়ত জ্ঞান দেবেন, আরও চেষ্টা করুন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবার। প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টায় হারায় আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমরা কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছি, প্রকৃত বক্তব্য পেশ করার সাথে চোখের দিকে তাকানোর  আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? শুধুমাত্র এরকম অগুনতি ছোটো-ছোটো সামাজিক নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে ফেলায় মানুষকে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস আর হয়রানি র শিকার হওয়া টা একরকম অবধারিত। 

এবার আসি, তাঁদের কথায়, যাঁরা কথা বলার মাধ্যমে সংযোগ রাখতে পারেন না। বাড়িতে হাহাকার পড়ে যায় কথা বলা শেখানোর জন্য। শেষমেশ আমরা ভেবে নিই বাচ্চাটির কোনও বোধ-বুদ্ধি নেই । অথচ আমরা কেউই হয়ত জানি না, যে, চিন্তাভাবনা করার জন্য শব্দ বা বাক্যই একমাত্র ভাষা নয়। ছবির ভাষা, অলটারনেটিভ অগমেন্টেটিভ কমিউনিকেশন, সাইন ল্যাংগুয়েজ, ব্রেইল, আরো বহুরূপ ভাষা আছে পৃথিবীতে। অনেকেই আছেন যাঁরা কথা বলতে পারেন না, কিন্তু টাইপ করতে পারেন এমনকি বাইরের দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। (সন্দেহ থাকলে গুগল করুন হরি শ্রীনিবাসন সম্পর্কে, যিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই।)  তাহলে সমাজ যদি ভেবে নেয় কথা বলার ভাষা ই একমাত্র ভাষা, আর যারা যারা সেই ভাষায় কথা বলতে পারবেনা, তাদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারেনা, তাহলে সমস্যাটা আত্মনিমগ্ন ব্যক্তির নয়। সমস্যাটা সমাজের। 


“তোমার অটিজম কে তুমি পরাস্ত করেছ” – সমাজের এই অদ্ভুত কথাবার্তা আমাদের অনুপ্রাণিত করেনা। তার কারণ অটিস্টিক ব্যক্তি এবং অটিজম পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। চঞ্চলতা চঞ্চল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, শান্তভাব শান্ত ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, চামড়ার কালো রঙ কালো মানুষের বৈশিষ্ট্য, গাণিতিক চিন্তা গণিতবিদের বৈশিষ্ট্য। ঠিক সেরকম ‘অটিজম’ অটিস্টিক ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যও। অটিজম কে অস্বীকার করতে বলা মানে অটিস্টিক ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। 


দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, সমাজটা তথাকথিত সামাজিক লোকজন নিয়ে তৈরী। (অটিস্টিক রা সংখ্যালঘু এবং বিচ্ছিন্নও )  ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশ,  এমনকি বিজ্ঞানী, পণ্ডিত, এমনকি প্রায়শই অটিস্টিক ব্যক্তির তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ বাবা-মা ও ঠাহর করতে পারেন না, সমস্যাটা আদতে ‘অটিজম’ নয়। কিন্তু যাবতীয় বইপত্র, ‘চিকিৎসা পদ্ধতি’ (?), সতর্কতা অভিযান তৈরি হয়েছে এমন ব্যাক্তিদের দ্বারা, যাদের এই অন্তর্দৃষ্টি ছিল না। ফলে তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন অটিজম এর  “মেডিক্যাল মডেল”, যেখানে অটিজম কেই মূল সমস্যা বলে মনে করা হয়। আর আগেই বলেছি, অটিজম কে অস্বীকার করা আর  অটিস্টিক ব্যক্তি কে অস্বীকার করা একই ব্যাপার।  কদর্য এবিএ চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক ইভার লোভাস মনে করতেন অটিস্টিক ব্যক্তিরা মানুষের মধ্যে গণ্য নয়। আজও, ব্যায়বহুল এইসব কদর্য চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে আচরণের অবদমন শেখানো হয়। যার ফলে আপাতদৃষ্টিতে অটিস্টিক ব্যক্তিকে ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। কিন্তু পরিবর্তে সে হারিয়ে ফেলে তার নিজের যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। ভুলে যায় তার নিজের ও কিছু বলার থাকতে পারে, যেটা হয়ত বাকি পৃথিবীর সাথে মিলবে না। এই পণ্ডশ্রম অটিস্টিক ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে নিজের মতো করে খেলা থেকে, নিজের মতো করে বাঁচতে শেখা থেকে। 


নীল দিন কেন নয়? 

কোটিপতি ব্যবসায়ী সংগঠন “অটিজম স্পিকস” মনে করে অটিজম কোনও ঘৃণ্য অভিশাপ। এরা অটিজম সম্পর্কে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। এরা বারংবার এইডস ক্যান্সার প্রভৃতি মারণব্যাধির সাথে আত্মমগ্নতা কে এক শ্রেণিতে ফেলাটা একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করে তোলে । । ২০০৯ সালে  “আই অ্যাম অটিজম” বিজ্ঞাপন এ এরা মানুষজন কে প্রবল ভাবে ভয়ার্ত করে তুলেছিল।  প্রচার করছিল অটিজম বাবা-মা র embarassment (লজ্জা) র কারণ।  প্রকৃতপক্ষে সমাজই লজ্জার কারণ। প্রভাবশালী এই সংস্থা গোটা পৃথিবী থেকে কোটি-কোটি টাকা ডোনেশান তোলে, যার সিংহভাগ যায় অটিজম কে পৃথিবী থেকে তাড়ানোর গবেষণায়, (অটিজম দূর করা আর অটিস্টিক ব্যাক্তি কে দূর করা একই ব্যাপার আগেই বলেছি)। অটিস্টিক ব্যক্তির জীবন সহজসাধ্য করে তোলার কোনো কাজে তাৎপর্যপূর্ণ কোনমাত্র অংশ নেয় না সংস্থাটি। সংস্থাটিতে ক্ষমতাসীন পদে কোন অটিস্টিক ব্যাক্তি নেই। 

এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মহল কে সহজেই প্রভাবিত করে। আমেরিকার সরকার ও ‘ওয়ার অন অটিজম’ (আত্মমগ্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ) অভিযান করছিলো।   এবং এপ্রিল ফুলস ডে- র পরদিন অর্থাৎ ২রা এপ্রিল  কে নীল দিন অর্থাৎ বিষণ্ণ দিন ঘোষণা করা হয়। 


অটিজম মোটেও হুহু করে বাড়ছেনা। প্রাচীন কালের মুনি ঋষি দার্শনিক দের কথা পড়লে তাঁদেরকে অটিস্টিক বলেই মনে হয়।  আমাদের সমাজে অটিস্টিক মানুষ আরও অনেক বেশি বেশি দরকার। যারা সমাজের সংখ্যাগুরুর ভুল গুলিকে ধরিয়ে দিতে সমর্থ।  


তাই অটিজম এর বিরুদ্ধে সতর্কতা নয়, বরং সমাজকে সংশোধন করার জন্য অভিযান করুন, যাতে অটিস্টিক ব্যক্তির জীবন সহজসাধ্য হতে পারে, যাতে সমাজ অটিস্টিক ব্যক্তির কথা সম্মানের বিনিময়ে গ্রহণ করতে পারে।   

আরও পড়ুনঃ 

Chown, Nick. "Who benefits from autism research? And to what extent is it participatory and/or emancipatory?: A brief follow-up to Pellicano, Dinsmore and Charman (2014)." Autism Policy and Practice 2, no. 1 (2019): 93-95.


Armstrong T. The myth of the normal brain: embracing neurodiversity. AMA J Ethics. 2015 Apr 1;17(4):348-52. doi: 10.1001/journalofethics.2015.17.4.msoc1-1504. PMID: 25901703. 


Czech, Herwig. "Hans Asperger, national socialism, and “race hygiene” in Nazi-era Vienna." Molecular autism 9, no. 1 (2018): 1-43. 


Long-term ABA therapy is abusive: A response to Gorycki, Ruppel, and Zane; by A. H. Sandoval Norton, Gary Shkedy, Dalia Shkedy; Advances in Neurodevelopmental disorders (2015) 5:126-134


How much complience is too much complience: Is long term ABA abuse? by A. H. Sandoval-Norton and Gary Shkedy, Cogent Psychology (2019), 6:1, 1641258.


Ethical concerns with Applied Behaviour Analysis for Autism Spectrum “Disorder”. by Daniel A Wilkenfeld, Allison M. McCarthy; Kennedy Institute of Ethics Journal, Volume 30, Number 1, March 2020, pp. 31-69 (article). 


Thibault, R. (2014). Can autistics redefine autism? The cultural politics of autistic activism. Trans-Scripts, 4, 57-88. 


Waltz, M. M. "Getting from 'you can’t speak for my child' to ‘nothing about us without us' :: A brief history of diagnostic denial, misuse and misunderstanding in autism." Lancaster Centre for Disability Studies (CeDR) Conference, UK. 2018

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929