বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না

চিত্রদীপ সোম


Nov. 16, 2024 | | views :818 | like:2 | share: 2 | comments :0

বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না। ছিলেন একান্তভাবেই দোষ গুন মিশিয়ে একজন মানুষ। বরঙ ছিলেন সেই ব্যতিক্রমী ধর্মপ্রচারকদের অন্যতম যিনি কোনো কাল্পনিক ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করেন নি মানুষের মধ্যে। মানুষ ও তার ইহজীবনই ছিলো তাঁর মতবাদের বিষয়বস্তু। এখানেই তিনি খ্রীষ্ট মহম্মদ বা শংকরাচার্য সহ অনান্য সমস্ত ধর্মপ্রচারক থেকে আলাদা৷ অথচ সেই বুদ্ধকেই আজ ভগবান হিসাবে পুজো করা হয়, নবম অবতার মনে করা হয়, এর চেয়ে হাস্যকর ও আপত্তিকর কিছুই হতে পারে না।


প্রসঙ্গতঃ বুদ্ধের যে ছবি বা মূর্তিগুলি দেখি আমরা তার কোনোটাই তাঁর আসল রূপকে তুলে ধরে না। বুদ্ধের আসল চেহারা আমাদের অজানা। কারণ বুদ্ধের জীবিতকালে তাঁর কোনো মূর্তি বা ছবি বানানো হয় নি। বুদ্ধের প্রথম মূর্তি বানানো বা ছবি আঁকা হয় তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পর। বলাবাহুল্য সেই শিল্পীরা কেউই চোখে দেখেন নি বুদ্ধকে। তাই কল্পনাই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা। গান্ধার শিল্পরীতিতে প্রস্তুত এইসব ছবি বা মূর্তিগুলি তাই বুদ্ধকে সঠিকভাবে তুলে ধরে না। বরঙ এই মূর্তি বা ছবিগুলোর সাথে অনেক বেশী মিল পাওয়া যায় গ্রীক দেবতাদের।


যে সময় আসমুদ্র হিমাচল ছিলো গোঁড়ামি, জাতপাত, আর কুসংস্কারে নিমজ্জিত, সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি বেদ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরলেন। দৃঢ়তার সাথে বেদের অপৌরুষেয়তাকে অস্বীকার করলেন৷ অস্বীকার করলেন স্বর্গ নরকের ছেলেভোলানো গালগল্পকে। অস্পৃশ্যতাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন সমাজ জীবন থেকে৷ আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যখন দেখি কোনো বিজ্ঞানের অধ্যাপকের হাতে গ্রহরত্নের আংটি, ডাক্তারকে দেখি অপারেশনের আগে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কী সাংঘাতিকভাবে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন এই মানুষটি। বুঝতে অসুবিধা হয় না আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের তমসাঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে দেবদ্বিজকে অস্বীকার করতে হলে কতটা কলজের জোর দরকার হয়েছিলো তাঁর।


বুদ্ধ সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। মানুষ হয়েছেন রাজ বৈভবের মধ্যে। পরবর্তীকালেও পেয়েছেন রাজঅনুগ্রহ৷ তাই মানুষের দুঃখকষ্টের বস্তুবাদী কারণ অনুসন্ধান তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। মানুষের দুঃখকষ্টের পিছনে যে সম্পদের অসম বন্টন লুকিয়ে আছে তা তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় নি। ইহজীবনের দুঃখের জন্য তিনি ভুলভাবে দায়ী করে গেছেন কামনা ও বাসনাকে। মনে করেছেন কামনা বাসনার অবসান হলেই দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। এটা বুদ্ধের সীমাবদ্ধতা। বুদ্ধের সময়ের সীমাবদ্ধতা। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিকাশের সময় সেটা ছিলো না৷ ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক রূপ তাই বুদ্ধের চোখে ধরা পড়ে নি। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেটুকু ইতিবাচক দর্শনের সূচনা তিনি করেছেন তাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হতেই হয়।


অহিংসা ছিলো তাঁর ধর্মের মূল কথা। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। জৈন ধর্মের মতো ইঁটকাঠ পাথরেও তিনি প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ান নি। উপরন্তু অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাংস খাওয়ারও বিধান দিয়েছেন৷ এ থেকে বোঝা যায় বাস্তবতাবর্জিত আদর্শবাদী তিনি ছিলেন না। বরঙ বাস্তবতাবোধ নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর নীতিবোধকে। ঘন ঘন যুদ্ধের রাজতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে গেছেন অহিংসার জয়গান, জীবনের জয়গান। যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো, যুদ্ধবন্দীনিদের যৌনদাসী বানানো, বিধর্মীদের উদ্দেশ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধে মদত দেওয়া, পরকালে সুন্দরী মহিলার লোভ দেখানো, ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে ছিলো না। ছিলেন একান্তভাবেই সত্য ও সুন্দরের উপাসক। আজ যখন যুদ্ধে দীর্ণ, ভাতৃঘাতী হানায় দীর্ন পৃথিবীকে দেখি, তখন অনুভব করি বুদ্ধের উপদেশ আজও কী পরম প্রাসঙ্গিক।


রোমিলা থাপার বলেছিলেন বিশ্বকে দেওয়া ভারতের শ্রেষ্ঠ উপহার গৌতম বুদ্ধ৷ আমার মতও তাই। শুধু ভারত নয়, এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। এই হিংসা, হানাহানিতে ভরা পৃথিবীর বুকে তাই জেগে থাকুন বুদ্ধ, জেগে থাকুক তাঁর বরাভয়ের মুদ্রা। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিক রাজকীয় বিলাসিতাকে হেলায় পরিত্যাগ করা এই ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসীকে।


ওঁং বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929