সমকামীতাকে বিজ্ঞানের চোখে দেখুন?

মুজিব রহমান


May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0

আমার এক সমকামী (মূলত রূপান্তরকামী) বন্ধু আছে। সে বলে, ‘আমার বাইরের অবয়বটা পুরুষের কিন্তু ভিতরের উপলব্ধিটা নারীর। ভিতরে একজন নারীত্ব নিয়ে কি করে আরেকজন নারীকে ভালবাসবো। ভিতরের নারী তো একজন পুরুষকেই কামনা করে।’ আমার এই বন্ধুকে এই সমাজ খুবই সন্দেহের চোখে দেখে। তার আত্মীয়রা মনে করে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলেই সমাধান হয়ে যাবে। তারা ভাবে এসব অনৈতিক, পাগলামি ও বিকৃত চেতনার। আমি কি বলতে পারি, এটা বিকৃত চেতনার? পারি না তো! কিন্তু এ সমাজে সে কিভাবে টিকে থাকবে? তার ভিতরের নারীত্ব আরেকজন পুরুষকেই সে কামনা করে। যদি সেই পুরুষ অবয়বের মানুষটিও ভিতরে নারীত্ব অনুভব করে তবে তারা সুখে দিন কাটাতে পারে।


শিশুদের বলাৎকার করা বা দুজন একই লিঙ্গের ব্যক্তির সাময়িক যৌনক্ষুধা মেটানোকেই আমরা সমকামীতা ধরে নেই। বাস্তবিক সমলিঙ্গের প্রতি তীব্র প্রেম ও আকর্ষণকেই বলে সমকামীতা। কেন একজন পুরুষ একজন নারীর পরিবর্তে আরেকজন পুরুষকেই কামনা করে? এটা কি মানসিক বিকৃতি? নাকি কোন মানসিক রোগ? বন্ধুটির দিকে তাকালেই বুঝবো বাস্তবিক তার কোনটিই নয়। সম্ভবত জিনের গঠনের কারণেই একজন পুরুষ বা নারী সমলিঙ্গের প্রতি প্রেম ও আকর্ষণ বোধ করে। পুরুষকে বলে গে আর নারীকে বলে লেসবিয়ান। অনেকে হরমোনের কথাও বলেন। তবে হরমোন দায়ী হলে এর চিকিৎসা সম্ভব হতো সহজে। এটা কোনভাবেই কোন মানসিক রোগ নয়। বহু স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞানীরা এটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন। সক্রেটিস, লর্ড বায়রণ, দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, রোমান সম্রাট হেড্রিয়ান, এলেন গ্রিন্সবাগসহ অসংখ্য মানুষ সমকামী বা উভকামী ছিলেন। বহু সাধারণ গে বা লেসবিয়ানকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে সমলিঙ্গের প্রতি প্রেম বা আকর্ষণ ছাড়া তাদের কোন মানসিক সমস্যা নেই।

তাহলে গে বা লেসবিয়ানদের এই সমস্যার জন্য দায়ী কে? কোনভাবেই তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নন। জিনের উপর তাদের হাত নেই। এই জিনের কারণে মানুষ ছাড়াও আরও বহু প্রাণির মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যায়। এমন কি ফিতা ক্রিমির মধ্যেও এমন প্রবণতা রয়েছে। ভেড়ার মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। মাছ, সরীসৃপ, উভচর বহু প্রাণীর মধ্যেও এমনটা লক্ষ্য করেছেন গবেষকগণ। তারা কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জিন, হরমোন ও পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার সন্ধানই পান। তার মানে এমন আচরণ করার ক্ষেত্রে তাদের করণীয় কিছু নেই। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি না হলে তারা বিয়ে করেও জীবন যাপন করতে পারবে না। সে এক অসম্ভব কষ্টকর জীবন যাপন। যাকে দেখে শরীর কথা বলবে না, তার সাথে তো শারীরিক চাহিদা মেটানোও সম্ভব নয়। অনেকটা একজন সাধারণ পুরুষের সাথে জোর করে আরেকটি পুরুষের বিয়ে দেয়ার মতো হবে। তাহলে?


ইংরেজরা সমকামীতা, উভকামীতা ও পশুকামীতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন করে যায়। ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে, অথবা বর্ণনা অনুযায়ী নির্দিষ্টকালের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে। বাংলাদেশে এই আইনটি এখনও বলবৎ। পৃথিবীর আরও ৭১টি দেশে সমকামীতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম আইন রয়েছে। কিন্তু ভারতসহ পৃথিবীর বাকি দেশগুলোতে সমকামীতা অপরাধ নয়। ভারতে আইনটির বিরুদ্ধে একজন সমকামী মামলা করলে আদালত আইনটি মানুষের অধিকার পরিপন্থী বিবেচনা করে বাতিল করে। এখন উন্নত দেশগুলো বোঝতে পারছে সমকামীতা শুধু যৌন প্রবৃত্তি দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। সমকামীতা শুধু শরীর সর্বস্বতা নয়। এখানে অনুভূতিটাই প্রধান। এজন্য এখন অনেক দেশে সমকামীদের বিয়েও রেজিস্ট্রি হচ্ছে। অনেক দেশেই তারা জনপ্রতিনিধিও হতে পারছেন। তাদের সামাজিক আন্দোলন শুধু আইনগত দিকেই নয়, মানুষের ভাবাদর্শ বদলাতেও কাজে লাগছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ দেশে এই আইন কঠোরভাবেই যেমন প্রয়োগ করা হয় আবার সামাজিকভাবেও তাদের নিগৃত হতে হয়। ঢাকার কলাবাগানে এমন এক জুটিকে মূর্খ মৌলবাদীরা হত্যা করে। তাতে বাংলাদেশের জিনগত কারণে সৃষ্ট এমন মানুষেরা আরও প্রকট সমস্যায় পড়েন। তারা হয় অধিক গোপনীয়তা অবলম্বন করেন নয়তো নিজের শরীরের চাহিদার বিপক্ষে গিয়ে বিপরীত লিঙ্গে বিয়ে করে চরম অসুখী জীবন যাপন করেন।


গত বছর পত্রিকায় দেখলাম, বাংলাদেশের নোয়াখালীর মেয়ে বিলকিস ভালোবাসার টানে টাঙ্গাইলের বাসাইলের মেয়ে আঁখির কাছে ছুটে এসেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকের মাধ্যমে পরস্পরকে খুঁজে পান। পরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানান দু’জনেই। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের উৎসুক বিভিন্ন বয়সি মানুষজন তাদের এক নজর দেখতে ওই বাড়িতে ভিড় করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি নতুন। আমাদের দেশে সমকামীতা থাকলেও তারা তা গোপনেই রাখেন। সামাজিক মাধ্যম না থাকলে দুই তরুণীর মধ্যে যোগাযোগও হতো না। বিলকিস আক্তার বলেছিলেন, ‘ফেসবুকে তাদের পরিচয় হয়। এরপর দুই বছর হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন। জড়িয়ে পড়েন প্রেমে। তবে তাদের এই সম্পর্ক মানতে পারছে না পরিবার। আমি আঁখিকে ভালোবাসি, তাই ওর কাছে চলে এসেছি। আমার ফ্যামিলিকে বলেছিলাম, ওর কাছে যাব। কিন্তু ওনারা রাজি হয়নি। তারা আমাদের সম্পর্ক মানবে না। তাই বাড়ি থেকে নিরুপায় হয়ে পালিয়ে এসেছি। এখন ওর পরিবার না মানলে আমরা দু’জনে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করব।’ আঁখি আক্তার বলেছিলেন, ‘বিলকিসকে নিয়ে আমি এর আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। আমরা ঢাকায় দেখা করেছি। ঢাকায় আমাদের ফ্যামিলি গিয়ে আমাদের আলাদা করে নিয়ে এসেছে। আমার ফোন নিয়ে নিয়েছিল। কয়েকদিন পর ফোন ফেরত দেয়। তখন আবার আমরা কন্ট্যাক্ট করে ওকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। সামাজিকভাবে আমাদের কেউ মানবে না। কিন্তু আমি ওর সঙ্গেই সারাজীবন থাকতে চাই। বাঁচলেও ওর সঙ্গে, মরলেও ওর সঙ্গে। পুলিশ বা তারা যদি আমাদের মেরে ফেলতে চায়, তাহলে দু’জনকে একসঙ্গেই মারবে। আর যদি বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে দু’জনকেই রাখতে হবে।’ আমাদের মিডিয়া কতিপয় মূর্খ অধ্যাপক ও ডাক্তারের মতামত নিয়েছে। তারা এটাকে বিকৃত যৌনাচার বলে দিয়েছে। তারা বলেছে এটা সাময়িক! কিন্তু এটা সাময়িক নয়। ছবি দেখেই বুঝেছেন এরা দরিদ্র পরিবারের। এরা খাঁটি সমকামী! 

রূপান্তরকামীর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশে পুরোটা নেইও। মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শে প্রথমে হরমোন দিবে ডাক্তার। সেটা কার্যকরী না হলে অপারেশন করে দুজনকেই পুরুষ করে ফেলতে হবে। কারণ তাদের ভেতরটা পুরুষের। পুরুষের হরমোন প্রয়োগে তাদের বাইরের অবয়বও বদলে যাবে। তখন দুজনই দুজন নারীকে বিয়ে করে নিতে পারবেন। বাংলাদেশে টিএমএসএস এর নির্বাহী পরিচালক পুরুষ থেকে নারী হতে পেরেছিলেন। তিনি পরে তার সহপাঠী পুরুষকে বিয়েও করেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।

জোর করে শিশুদের বলাৎকার করাটা ধর্ষণযোগ্য অপরাধ। কিন্তু দুজন গে বা লেসবিয়ান যদি স্বেচ্ছায় নিজেরা সুখে জীবন যাপন করেন তবে তা কি অপরাধ হয়? জিনের ত্রুটির দায়টা ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিতে কি মানুষ পারে? এসব প্রশ্নের জবাবটাই বাংলাদেশের আইন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা এসব বিষয় গোপন করতে চাই এবং কথা বলতে চাই না। ফলে সমস্যা চুপিচুপি বাড়তেই থাকে। সবদেশের আইনই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929