কিছু কিছু কথা আছে, শুনলে হাসি রোখা যায় না। যেমন গ্রামে হবে এক ধর্মসভা। বক্তা কে? একজন মৌলভি মৌলানার নাম, কোন মাদ্রাসায় তার শিক্ষা, কী কী তার ডিগ্রী এইসব বড় বড় অক্ষরে, নীল লাল বেগুনি সবুজে ছাপা। একটা বিশেষণে কিন্তু হাসি আর চেপে রাখা যায় না। সেটি হ'ল, তার মতো যুক্তিবাদী বক্তা খুবই কম আছে। তার সমস্ত যুক্তিই অকাট্য। কোরাণ হাদিসের বাইরে এক মিলিমিটারও তিনি বেরিয়েছেন, এ অপবাদ তার ঘোরতর প্রতিযোগী মৌলানা মৌলভীরাও করতে পারে না।
এই হলো যুক্তিবাদ সম্বন্ধে মুসলিম জনসমাজের ধ্যানধারণা। এবার একটু মুসলিম জনসমাজ থেকে বেরিয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষিত জনের ভাবনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
কুসংস্কার দূরীকরণ বলতে তারা কী বোঝেন? ঐ সাপে কাটলে ওঝার কাছে যাওয়া নয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তেলপড়া জলপড়া নয় ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াতে হবে। কোন ডাক্তার? এলোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, চাইনিজ, জাপানিজ, যেকোনও ডাক্তার হলেই চলবে, নামের আগে ডাক্তার লেখা হলেই হলো। জলপড়া, তেলপড়ার মতো হোমিওপ্যাথি যে স্রেফ ওষুধবিহীন চিকিৎসা এইটুকু বললেই সেই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারিরাও রে রে ক'রে তেড়ে আসে। হোমিও খেয়ে যে তার নিজের, নিজের বাবা-কাকা- দাদু- দিদার কিংবা অপরের বাবা-মা- কাকা-জ্যেঠা কতজনের যে রোগ নিরাময় হয়েছে, তার না কি থই পাওয়া যায় না।
কুসংস্কার বলতে আপামর শিক্ষিতজনের চিন্তাস্রোত এমনই গড্ডালিকাপ্রবাহিনী। কিছু মানুষ আছেন, সমাজে তারা কেউকেটা। এই যেমন সরকারী বিজ্ঞান সংস্থার উচ্চপদাসীন, নামকরা চিকিৎসক, বিজ্ঞান পড়ানো টিচার। তারা সব ধরে ধরে রাস্তায় চলার পথে কালো বেড়াল দেখলে কেন থামতে হয়, পিছন থেকে ডাকলে কেন যেতে নেই, এক শালিক দেখলে কেন কাজ সফল হয় না, ডিম খেয়ে কেন পরীক্ষা দিতে যেতে নেই, গর্বের সাথে সে সবের বড় বড় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে পাণ্ডিত্য ফলিয়ে থাকেন। নিজেকে কুসংস্কারহীন, বিজ্ঞানমনস্ক, বিজ্ঞানকর্মী বলে পরিচয় দেন। এইসব মণীষীগন বিজ্ঞান আন্দোলনের যে কত ক্ষতি করেন তার মাপ পরিমাপ নেই। বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্মেলনে, জ্যোতিষীর দেওয়া রত্নপাথরের শোভা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেও এরা নি:সঙ্কোচ।
কেউ কেউ আছেন, একটা বিজ্ঞান সংস্থার কর্ণধার, সর্বেসর্বা, এরা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, গ্যাজেট নিয়ে ভূত ভগবান শয়তান নিয়ে গবেষণা করেন, নিদেনপক্ষে সেইসব বিজ্ঞানীদের প্রমোট করে থাকেন। এই সব অপবিজ্ঞানের ধ্বজাধারিদের।
সমাজে চোর ডাকাত জোচ্চররা ঠিক কতটা ক্ষতি করে তা ঠিক পরিমাপ করতে পারি না, কিন্তু এই স্বার্থান্বেষী বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মীগুলো ভূত-প্রেত-স্বার্থান্বেষীদের বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞানানুসন্ধানী বলে সমাজ মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ছলে ভট্টাচাজ্জিগিরি করে বিজ্ঞান চেতনার পথ থেকে পৃথিবীকে হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে , যাচ্ছে তা কিন্তু নিশ্চয় করে বলা যায়।
সমাজমাধ্যমে এইরকম মুখোশপরা সেলিব্রিটি “কুসংস্কারমুক্ত” মেকি কুসংস্কারবিরোধী লোক বিজ্ঞানমনস্কতা নির্মাণের পথে রঙচঙে দেওয়ালবিশেষ। কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে হলে এই লোকগুলিকে মোকাবিলা করতে হবে, বিজ্ঞান আন্দোলনে সেটাও এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কুসংস্কারমুক্তির জন্য তাহলে কী চাই? চিকিৎসক হতে হবে? অনেক ডাক্তারকে দেখবেন মাদুলি নিয়ে ঘুরছেন। তিনি নিজে ডাক্তার, অথচ পীরবাবা, মৌলানা-মৌলভীদের দেওয়া মাদুলি পরে বসে আছেন। তাহলে কি বিজ্ঞানী হতে হবে? নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী বলছেন, কুলদেবতা ঠাকুর তাকে থিসিস যুগিয়ে চলেছে। তাহলে কি টিচার হতে হবে? টিচাররাও শিশুদের বাগদেবীর আরাধনার উপদেশ দিচ্ছেন। তাহলে কি হতে হবে?
আমার মনে হয়, পাঠক হতে হবে। ভাল ভাল বই আছে সেগুলি প্রতিনিয়ত পড়তে হবে।
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলেই প্রচুর বই আছে। সেগুলি পড়তে হবে। যার যেখানে সম্পর্ক আছে এইসব বইয়ের সন্ধান দিতে হবে। পড়তে তাগিদ দিতে হবে। শিশুদের তো বাবা-মা- পরিবার-প্রতিবেশী কুশিক্ষা দেয়। কুসংস্কারের আঁচে ধোঁয়া দেয়। শিক্ষিত পরিবারেও এতটুকু বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবেশ পরিশীলনের অবকাশ নেই। প্রতিটি পরিবারে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নবীদের কথা-হাদিসের গল্প গুলো শিশুদের চরিত্রগঠনের দায় চাপিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। বিষের বীজ এভাবেই অঙ্কুরিত হচ্ছে শিশুমনে। কুসংস্কারমুক্তির জন্য চেতনার চাষ করতে আগে এইসব রামকৃষ্ণ হাদিস বিবেকানন্দ নবী সদৃশ আগাছা আমূল তুলে ফেলা দরকার। এ কাজটা খুব জরুরি। কিন্তু আগাছা নিকাশ করা অত সোজা নয়। তাই বিজ্ঞানকর্মীদের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশী।
আমাদের এই কাজটা বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবু মনে প্রত্যয়, উই শ্যাল ওভারকাম।