হাজার বছর আগে ইসলামের জন্ম হয়নি

পঙ্কজ কুমার ভাদুড়ী


Nov. 20, 2024 | | views :766 | like:0 | share: 0 | comments :0

৫ হাজার বছর আগে, পৃথিবীতে একটাও মুসলমান ছিলো না। মাত্র দেড় হাজার বছর আগেই, পৃথিবীতে একজনও মুসলমান ছিলো না। অর্থাৎ পাঁচ হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষেও, কোনো মুসলমান ছিলো না। স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু পাঁচ হাজার বছর আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা হয়েছিলো। কাদের মধ্যে হয়েছিলো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ? কৃষ্ণের সময়, দ্বাপর যুগের শেষে, সনাতন ধর্মাবলম্বী একই পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত ভাইয়ে-ভাইয়ে যে যুদ্ধ হয়েছিলো, যে নারকীয় আত্মীয় নিধন, নির্বিচারে আসমুদ্রহিমাচলের মানুষের চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছিলো, তারই নাম কুরুক্ষেত্র। ইগোর লড়াই, ক্ষমতার লড়াই, কুৎসা, ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখলের রাজনীতি, প্রেম, যৌন ঈর্ষা, ব্যভিচার, বহুগামীতা, হত্যাযজ্ঞ- মহাভারত এই, বা হয়তো তার থেকে অনেক, অনেক বেশি কিছু। কিন্তু যাইইহোক, যে রক্তগঙ্গা বয়েছিলো, তাতে মুসলিমদের কোনো হাত ছিলো না।

রাম। আজ যে নামটাকে জপমালা বানিয়ে, ভারতবর্ষ ক্রমশঃ সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠছে- সেই রামের সময়, রামায়ণের সময়ও, ভারতবর্ষে একজনও মুসলমান ছিলো না। প্রায় ৭০০০ বছর আগে, রামের জীবনে কোনো মুসলমান না থাকা সত্ত্বেও, রামকে প্রাসাদ রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের পরিবারকে ফেলে, রাজসুখ ফেলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। একে বলে Palace Ordeals. পৃথিবীতে একজন মুসলমান না থাকা সত্ত্বেও, রামকে স্বধর্ম-স্বজাতির মানুষের হাতে হেনস্থা হয়ে, বনবাসে গিয়ে পর্ণ- কুটিরে থেকে, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, হিংস্র জন্তুজানোয়ারদের মাঝখানে সীতাসহ বসবাস করতে হয়েছিলো। রাজা দশরথ মুসলমান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর তিনজন রানী ছিলেন। এবং তিনি তার লিবিডোর কারনে বলুন, হৃদয়ের দুর্বলতার কারনে বলুন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলুন- সন্তানকে সাপ-শ্বাপদের মধ্যে, দৈত্য-দানো, রাক্ষসখোক্ষসের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন। 

পার্টিসানের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মিলে, তৈরি হলো একটা রাষ্ট্র। দুটো দেশই তৈরি হলো মুসলমানদের জন্য। ভারতের মূল ভূখণ্ড হিন্দুদের। পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মুসলমানদের। কিন্তু ধর্মের মিল কী তাদের এক দেশ, এক জাতি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো? পারলো না। ধর্মীয় ঐক্য বলে আদৌ যদি কিছু থাকে, তা একটা প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিয়ে কিছুকাল বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রতিপক্ষ সরে যাওয়ার পর, ধর্মীয় ঐক্য ভূলুন্ঠিত হতে দশ মাস সময় লাগে না। ইতিহাস কি দেখাচ্ছে আমাদের? মুসলমানকে মুসলমানের হাতে তুলে দিয়ে, কি হলো তার পরিণতি? ৩০ লক্ষ হত্যা। ৭ লক্ষ নারী ধর্ষণ। একটা এমন মুক্তিযুদ্ধ, যার স্মৃতি এখনো গোটা বাংলাদেশকে তাড়া করে বেড়ায়। মুসলমান মানেই তার মানে, মুসলমানের রক্ষাকর্তা নয়! মুসলমান মানেই তার মানে, মুসলমানের মান-সম্মান, ধন-প্রাণের জিম্মি নয়! মুসলমানও মুসলমানের দুঃস্বপ্নের কারন হতে পারে। 

নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, শরীর-মন জড়িয়েমড়িয়ে কি যে একটা ব্যাপার হয়। কিন্তু আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায় কেমন। হিন্দু ছেলে, হিন্দু মেয়ে। তাও ডিভোর্স হয় কেনো? মুসলিম ছেলে, মুসলিম মেয়ে। তাও তালাক হয় কেনো? তার মানে হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই, এক সঙ্গে থেকে যাওয়ার একমাত্র ক্রাইটেরিয়া নয়? হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই, সম্পর্কে টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা নয়? ধর্ম এক হওয়ার পরও, এতো বিরোধ তৈরি হয়? ধর্ম এক হয়েও, এতো বিশ্বাসঘাতকতা করে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে? এতো ক্ষতি করে? এতো আঘাত দেয়? দেয়। কারন ধর্মের মিল আসলে একটা মিথ্যে মিল। সাজানো ব্যাপার। ধর্মের মিল বলে আসলে কিছুই হয় না। ধর্মের মিল মনের মিল তৈরি করতে পারে না। 

একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, সমস্ত জীবনে যতোবার অপমানিত হয়েছি, যতোবার প্রবঞ্চিত হয়েছি, যতোবার আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেছে, যতোবার আমার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যতো অন্যায় হয়েছে আমার সঙ্গে, অফিসে, কলেজে, কোর্ট-কাছারিতে, বাসে-ট্রামে, পুলিশ স্টেশনে, পরিবারের ভেতরে-বাইরে, সমস্ত খারাপ ব্যবহার, যাবতীয় অসভ্যতা, কূটকচালি, নোংরা সম্ভাষণ - যা যা সহ্য করতে করতে আমাকে পথ চলতে হয়েছে, সব কিছুই কি আমার কাছে মুসলিমদের কাছ থেকেই এসেছিলো? তাই কি আসে? নাহ! মুসলমানরাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, এই একই প্রশ্ন করুন নিজেকে। দেখবেন উত্তর হবে একই। না। না। আর না। দেখবেন আপনার চারপাশের যে মানুষগুলোর ব্যবহারে কান্না গলায় এসে আটকে গেছে, তারা সবাইই হিন্দু নয়।

৭০০০ বছর আগেও ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিলো না। আজও নেই। পরেও থাকবে না। ক্ষমতা, অর্থ, ধনসম্পত্তি, নারী- এসব নিয়ে মানুষে মানুষে ক্ষমতা দখলের প্রলয় চলবেই। তারপরও শুধু রাজনীতি পয়েন্ট আউট করে দেবে, Hindu's enemy Muslim, Muslim's enemy Hindu। 


আজ একজন ধার্মিক মানুষের জীবন নিয়ে কিছু বলবো আমি। তিনি শুধু একজন ধার্মিকই নন, তিনি এই সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। লাহোরের ফজল মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন তিনি। মসজিদের ঈমাম সাহেব লক্ষ্য করতেন তিনি খুতবার সময়টিতে প্রায়শই কি যেনো লিখছেন তাঁর একটা নোটবইয়ে। ঈমাম সাহেব পরে জেনেছিলেন, তিনি আসলে সেই নোট বুকে খুতবা থেকে পাওয়া ইসলামী বয়ান লিখতেন না, তিনি লিখতেন ফিজিক্স এর সম্ভাব্য এক্সপেরিমেন্টস গুলো যা তাঁর মাথায় আসতো, যেনো ভুলে না যান তাই লিখে রাখতেন।

তাঁর ঘরে সব সময় থাকতো একটি কুরআন, কয়েক হাজার গানের লং প্লে রেকর্ড আর তার চাইতেও বেশী সংখ্যক বই।

ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা কে "ষ্টুপিড আইডিয়া" বলতেন তিনি। কেননা দুটি সম্পূর্ণ দুই মাত্রার বোঝাপড়ার বিষয়। একটি পদ্ধতিগত আরেকটি নিছক ব্যক্তি মানুষের। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত নিয়ে চিন্তা করার চাইতেও তাঁকে পিড়িত করতো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় একশো বছরেও কেনো একজন গনিতের পিএইচডি তৈরী করতে পারলোনা সেই অপমানজনক গ্লানি।

তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন - পারটিকল ফিজিক্স এর "ক্ল্যাসিক্যাল মাইন্ড"দের একজন। তিনি নোবেল পুরুস্কার জিতেছিলেন। তিনি তাঁর নোবেল পুরষ্কার টি দান করেছিলেন শিক্ষা খাতে। তাঁর সাথে আরও দুজন নোবেল পেয়েছিলেন তাঁদের একজন প্রফেসর ওয়েইনবারগ বলেছিলেন - "আমি কখনই তা করবোনা, আমারটা আমি রেখেছি ব্যাংকে"। ভারতে তাঁর অসুস্থ ও শয্যাগত শিক্ষকের হাতে নোবেল মেডেলটি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, গুরুজি এই নোবেল আসলে আপনার পাওনা, কেননা আপনিই আমাকে গনিত শিখিয়েছিলেন।

এই স্কলারের ব্যক্তি জীবন কে তছনছ করে দিয়েছে পাকিস্তানের সুন্নী মুসলমানেরা, জামাতে ইসলামী, জুলফিকার আলী ভুট্টো আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এর শাসনকাল। সংগঠিত ধর্ম কতটা অন্ধ, ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার নজির হচ্ছে এই ধার্মিক মানুষটির পাকিস্তান ত্যাগ আর হাজার হাজার কাদিয়ানীদের উপরে নেমে আসা সুন্নী নিপীড়নের ইতিহাস। সূন্নী মুসলমানেরা তাঁর কবরের এফিটাফ থেকে "মুসলিম" শব্দটিকেও হাতুড়ী দিয়ে ভেঙ্গে মুছে দিয়েছে।

অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষ কতো বিচিত্র ভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মোকাবিলা করে তার হাজারটা উদাহরনের একটি হচ্ছে এই মানুষটির পেশাদার জীবন।

এই লেখাটির সময় মাথার ভেতরে ঘুরছিলো বুয়েটের ছাত্রটিকে নিয়ে করা তসলিমা নাসরিনের মন্তব্যগুলো......... ছিঃ ছিঃ বুয়েটে পড়ে "নামাজ পড়ে" তাহলে সেকি "বিজ্ঞান মনস্ক"? পরে নিজেকেই বোঝালাম ... কিসের মধ্যে কি নিয়ে আসছি আমি... বরং এই মহান মানুষটিকে নিয়েই ভাবি।

কেইমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট জন হলের লম্বা করিডোরের মাঝে মুখোমুখি আছেন - কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ ও এই মানুষটি, যাঁর নাম প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুস সালাম। সব কিছু ছাপিয়ে এটাই হয়ে থাকবে ইতিহাস।

না শুধু ছবি নয়, আরেকটি বিরাট প্রতিষ্ঠান সালামের "বিউটিফুল মাইন্ড" কে বয়ে নিয়ে যাবে ইতিহাসে, সেটা হচ্ছে ইতালীর ত্রিয়েস্ত শহরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিটিপি (ICTP)।

তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিলো অনগ্রসর দেশগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের উন্নত বিশ্বের গবেষণার সাথে যুক্ত করা।

তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রধান উন্নত দেশ বলে দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেইন এই প্রত্যেকটি দেশ এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলো। এদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো একটি "অপ্রয়োজনীয়" উদ্যোগ।

সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশিকতা কেবল দেশ দখল করেই হয়না, আরও অসংখ্য উপায়ে হয়। বোঝার জন্যে শুধু দরকার আমাদের বোধ আর কিছু তথ্য।

মানুষ অমর হন তাঁর কাজ দিয়ে। ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। মানুষ "বিচার" করা উচিত তাঁর কাজ দিয়ে, ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। কেননা এই মানুষটি ও জিয়াউল হক দুজনেরই ধর্ম বিশ্বাস ইসলাম।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929