কবি নবীনচন্দ্র সেন বলেছিলেন, কর্ণ আসলে দুর্বাসারই সন্তান। দুর্বাসার বর দেয়ার যে ব্যাপারটা বলা হয়, সেটা আসলে একটা গালগপ্প। কুন্তী রাজা কুন্তিভোজের ঔরসজাত কন্যা ছিলেন না; সেইজন্যেই হয়ত এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, জেনেও দুর্বাসার সেবায় কুমারী কুন্তীকে নিয়োগ করছিলেন।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কর্ণ যদি দুর্বাসার পুত্র হয়, তাহলে মহাভারতের প্লটে একটা ভালো রকমের জট পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রথম জট, পরশুরাম কর্ণকে ক্ষত্রিয় অপবাদ দিয়ে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান ফিরিয়ে নিতে পারেন না, কারণ দুর্বাসার পুত্র হলে কর্ণ কিন্তু আর ক্ষত্রিয় থাকছেন, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে উঠছেন। অবশ্য তিনি ক্ষত্রিয়দের শিক্ষা দেন না, একথাটাও যে পরশুরাম ঠিক বলেছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর পুত্র দেবব্রতকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণের বেলায় তিনি কেন এর ব্যতিক্রম করলেন, সেটা পরশুরামই ভালো বলতে পারবেন।
আরো একটা ব্যাপার আছে। নারদের ব্যাখ্যা মতে, যে কীট কর্ণের উরুতে দংশন করেছিল, সে আসলে ছিল একজন অসুর। মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রীকে অপরহরণ করার চেষ্টা করেছিল, বলে ভৃগু তাকে কীট হয়ে যাবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। যেটা সবসময় হয়, অপরাধ করার সময় কারোই মনে থাকে না যে এর ফলে অভিশাপ নেমে আসতে পারে, কিন্তু যখন সত্যি সত্যি অভিশাপ নেমে আসে, তখন সেই অভিশাপ খণ্ডন করার চেষ্টা করে। এই অসুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। অসুরের কাকুতি মিনতিতে নরম হয়ে ভৃগু বলেছিলেন, উত্তরকালে, কোন এক সময় পরশুরামের সঙ্গে তার দেখা হবে, আর তখনই তার কীট দশা কেটে যাবে। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। পরশুরামের চোখের সামনেই, সেই কীট অসুরে পরিণত হয়ে আকাশপথে উড়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনা অবধারিতই ছিল; এখানে কর্ণের দোষটা কোথায়? পরশুরাম কর্ণকে অভিশাপ দিতে গেলেন কেন?
তিনি ইচ্ছে করলে, অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, তিনি চাইলে ধ্যানযোগে কর্ণের সত্যিকারের পিতৃ-পরিচয় জেনে নিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে যেটা হত, কর্ণ প্রয়োজনের সময়ে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে পারতেন, যেটা তিনি পরশুরামের অভিশাপের কারণে করতে পারেননি। তাতে যেটা হয়েছে, অর্জুনের কাছে তাঁর পরাজয় মেনে না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। এর আগে ইন্দ্রের দেয়া একাগ্নি বানটাও খরচ হয়ে গিয়েছিল, ঘটোৎকচকে বধ করতে গিয়ে। এরই মধ্যে সহজাত কবচ কুন্ডলাটাই হারিয়ে বসেছেন। গোটা মহাভারত জুড়ে অর্জুনকে বড় করে, এবং কর্ণকে খাটো করে দেখানোই আয়োজন।
এরকম আরেকটা অদ্ভুত ঘটনার ঘটতে দেখি, যখন মহারাজ পান্ডু মৃগয়া করতে গেলেন। কিন্দম নামের এক ঋষিকে তিনি হত্যা করেছিলেন। মহাভারতে, যদিও বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তিনি ভুল করে মেরেছেন, কিন্তু কথাটা সত্য নয়। এই কিন্দম মুনি আসলে একটা মৃগীর সঙ্গে সঙ্গম করছিল, যেটা ভয়াবহ ধরনের অনাচার এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে, কেউ যদি, এমনকি সেই কেউ যদি একজন ঋষিও হয়, রাজার কর্তব্য তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া। মহারাজ পান্ডু সেই কাজটাই করেছেন। কিন্দমের মত একজন বিকারগ্রস্থ ঋষির অভিশাপ কার্যকর হবার কথা ছিল না, এবং আমার ধারণা সেটা হয়নি।
পঞ্চপান্ডব পান্ডুরই সন্তান। এই দেবতাদের ওরসে জন্ম-টন্ম এইসবই গাঁজাখুরি ব্যাপারই। তাছাড়া, আমরা যদি মেনে নিই, কর্ণ দুর্বাসারই সন্তান, তাহলে তাঁর দেবতাদের ডেকে এনে গর্ভসঞ্চার করার ব্যাপারটা এমনিতেই মিথ্যে হয়ে যায়। মহাভারতেরই এক জায়গায় বলা আছে, মহারাজ পান্ডু সন্তান লাভের জন্য যজ্ঞ করছিলেন।
বিকৃত কামাচারী হলেও, কিন্দম একজন ব্রাহ্মণ; সেই যুগে ব্রাহ্মণ হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। রাবণকে হত্যা করার কারণে, রামকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল, কারণ রাবণ যাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। অভিশাপ জনিত কারণে, পান্ডুর মধ্যে একটা ভয় হয়ত ছিল, কিন্তু তাঁর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না, একথাটা ঠিক নয়। যদি তাই হত, তাহলে তিনি যজ্ঞ করতে যেতেন না। ঘটনারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি আছে, একটার সঙ্গে আরেকটা ঠিক খাপ খেতে চায় না।
সমস্ত অলৌকিকতাকে যদি অস্বীকার করি, তাহলে বলতে হবে, পরশুরাম আদৌ কর্ণকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন কিনা, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ত্রেতা যুগে পরশুরাম জন্মেছিলেন। সেই পরশুরাম, দ্বাপর যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন - এটাকে মেনে নেয়া যায় না। অনেকেই হয়ত বলবেন, তিনি তো চিরঞ্জীবী - সবযুগেই বেঁচে আছেন, এমনকি এখনো বেঁচে আছেন। সেক্ষেত্রে, এখন কেউ মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় গিয়ে হাজির হলে পরশুরামের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার কথা; কিন্তু নিশ্চিত জানি, এরকম কারো সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।
এক্ষেত্রে, পুরানবিদ নৃসিং প্রসাদ ভাদুড়ির কথাটা অনেক যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন, পরশুরাম, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ -এঁরা আসলে এক ব্যক্তি নন। এরা একেকটা ঘরানার মত; যারাই এঁদের ধারাকে অনুসরণ করে, তারা সেই ঘরানার নামেই পরিচিত হয়। অর্থাৎ, দ্বাপর যুগে আমরা যে পরশুরামকে দেখছি, তিনি আসলে ত্রেতা যুগের পরশুরাম নন; তিনি পরশুরামের এক বিখ্যাত শিষ্য।