‘মেঘনাথ’ থেকে ‘মেঘনাদ’

পার্থ সারথি চন্দ্র


Nov. 23, 2024 | | views :9742 | like:3 | share: 2 | comments :0

হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি বিদ্বেষে নিজের নাম বদলে ফেলেছিলেন মেঘনাদ সাহা।

আজ ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার পথিকৃত মেঘনাদ সাহার ১২৯ তম জন্ম বার্ষিকী। তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ‘তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত ‘সাহা আয়নীভবন সমীকরণ’ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয় - সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে ক’জন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর - অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম।

 ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার ‘তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ’ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। নরওয়ের বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত ‘থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোফিজিক্স’ বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এ’কথা। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে - সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্স সহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সাথে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সাথে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য।

গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান - সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাশ করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয় - ক্রমশঃ পৌঁছে গেছেন এই বিষয়ের শিখরে। 

উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয় মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও থেমে থাকেননি  তিনি।

 সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, সে-বছরও পাঁজিতে ছিল অক্টোবরের আকাশ জুড়ে মেঘ, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। এই ৬ অক্টোবর ঢাকার বংশাই নদীর ধারে শ্যাওড়াতলি গ্রামে জগন্নাথ সাহার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হল। জগন্নাথ সাহা মুদির দোকানি ও হাঁটুরে ব্যবসায়ী, অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। তবুও কিন্তু এই প্রথম তাঁর সন্তান হচ্ছে না, এর আগে স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দুই ছেলে, দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। এদিন প্রসববেদনা উঠতেই গ্রামের ধাই এসে হাজির, সেকালে বসতঘরের বাইরে আলাদা করে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আঁতুড়ঘর তৈরি করা হতো, তো, সেই ঘরে ভুবনেশ্বরীকে আনা হল। আর তখনই আকাশ উথালপাথাল করে বজ্রবিদ্যুৎ গায়ে মেখে শুরু হল ঝড়। ঝড়ের দাপটে উড়ে গেল আঁতুড়ঘরের খড়ের চাল। সেই বজ্রনির্ঘোষ ঘনঘটার মধ্যেই জন্ম হল ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার। ঝড়-বাদলা-মেঘ নিয়ে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাকুমা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মেঘনাথ’। কিন্তু পরে স্কুলের খাতায় তাঁর এই নাম ঠিক করে রাখা হয় ‘মেঘনাদ’। পরবর্তীকালে মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর সব চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল নায়ক ‘মেঘনাদ’। এই প্রিয় হয়ে ওঠাটা শুধু নামের মিলের জন্য নয়, নায়ক মেঘনাদের জেদ, অনমনীয়তা ও বীরত্বের জন্য।

বাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না, বলা ভালো জীবনে যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা প্রয়োজন আছে এমন কোন ভাবনাই ছিল না জগন্নাথের। মুদির ছেলে মুদি হবে, তিনি বুড়ো হলে ছেলেরা তাঁর মতো ব্যবসা সামলাবে, এটাই তো ভবিতব্য, এর আর ভাবাভাবির কী আছে! কাজেই বড়ছেলে জয়নাথের মেট্রিকের গণ্ডি আর পেরনো হল না। ঢাকায় ছুটতে হল ব্যবসায়ীর গদিতে ব্যবসার কাজ শিখতে আর খিদমত খাটতে। মেঘনাদের কপালে এই ভবিতব্যই নাচছিল। পরিবেশে, পরিবারে কোথাও পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল না, উৎসাহ দেওয়ারও কেউ ছিল না, তবু পড়ুয়ার স্বভাব নিয়ে কেমন করে যেন জন্ম নিয়েছিলেন মেঘনাদ। পড়তে না পেলে তিনি কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। পড়ার জন্য খুব ভোরে উঠতেন। এসময় ভোররাত্তিরে জোরে জোরে পড়তে গিয়ে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মারও খেয়েছেন অনেকবার। তবুও, পড়াশোনা থেকে কেউ তাঁর মুখ ফেরাতে পারেনি। এই রকম একটি পরিবেশ থেকেই শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেশক্তির প্রবলতায় উঠে এসেছিলেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা।

বাবা জগন্নাথ সাহা ও মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান ছিলেন মেঘনাদ। জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি। ছোটবেলা থেকেই তাই রীতিমতো আর্থিক অনটেনর মধ্যে তাকে মানুষ হতে হয়েছিল। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়। গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনও সুযোগ ছিল না৷ কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় তা সফল হয়।

ছোটবেলায় গ্রামের সরস্বতী পুজোয় তিনি দেবীর কাছাকাছি চলে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে এক নির্বোধ গোঁড়া পুরুতের কাছে চরম অপমানিত হয়েছিলেন।

 নিম্নজাতের ধুয়ো তুলে তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে সমস্ত দেবদেবীর পুজোর ওপর তিনি শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন, এমনকি বিদ্যার দেবীর ওপরেও, কিন্তু বিদ্যার ওপরে নয়।

কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গিয়েছিল সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। মেঘনাদের ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের ভাবগতিক এমনই ছিল। এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল মেঘনাদের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে। 

সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বৈদিক ধর্মের প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা সামাজিক বিভেদের প্রতি বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে তিনি পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন।

 ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা জানিয়েছিলেন, যে দিন তাঁর বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

তিনি নাস্তিক হলেও, সেই নাস্তিকতা শুধুই অপমান থেকে আসেনি, এসেছিল জ্ঞান থেকে। তিনি সমস্ত ধর্মের বই আত্মস্থ করে তারপর বিজ্ঞানের স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছেন, ধর্মের পরস্পরবিরোধী দর্শন নিয়ে নয়।

 তাই আমাদের দীর্ঘদিনের পঞ্জিকার অনুমানমূলক জ্যোতিষগণনার পরিবর্তে তাতে জ্যোতির্বিদ্যার প্রবেশ ঘটিয়ে পঞ্জিকা সংস্কার করেন। বিশ্ববিজ্ঞানের সব কিছুই বেদে আছে, এই কথা যে বেদবাদীরা বলেন, তাঁদের বিরোধীতা করায় চরম প্রতিবাদের মুখে পড়েন মেঘনাদ, কিন্তু তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিজ্ঞান আর দর্শন কখনই এক নয়, হতে পারে না। মাইকেলের কাব্যের নায়ক মেঘনাদের মতই কোনদিনই কোন চাপের কাছে, কোন বিরুদ্ধতার কাছে মাথা নত করেননি তিনি।

এরপর তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায়। সে সময় মাসিক ৪ টাকার সরকারি বৃত্তি পান, বৃত্তির টাকা ও জয়নাথের পাঠানো পাঁচ টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ভর্তি হন। এরপর বৈশ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তিও তিনি লাভ করেন।

এদিকে সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার আসবেন শুনে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তার সম্মুখে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল করবে নির্ধারণ করে। সে মিছিলে মেঘনাদও যোগ দেন। ফলে পরদিন তাকে স্বদেশী আন্দোলন এ জড়িত থাকার জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পাশাপাশি তার সরকারী বৃত্তিও বাতিল করা হয়।


পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে মেঘনাদকে তাদের স্কুলে ভর্তি বিনাবেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন।

সহপাঠি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও উপরের শ্রেণির প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ, আচার্য হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন।

১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি করেন এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন।

মেঘনাদ তার সমস্ত গবেষণা ফলাফল গুলো একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রি প্রদান করে। একইবছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার সুযোগ পান।

১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কলেজ চালু করার পর সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ উভয়েই গণিত বিভাগের যোগ দিতে বলেন দেন। যদিও পরবর্তী কালে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে পরবর্তীতে যোগ দেন। এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লণ্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। দুইবছর ধরে দেশের বাইরে গবেষণা করার পর মেঘমাদ সাহা ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ সেসময় না থাকায় তিনি ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতবিদ অমিয় চরন ব্যানার্জি এর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৫ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। এরপর তিনি মারা যাবার আগে অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে দ্বায়িত্বপালন করেছেন।

১৯১৭ সাল। ব্রিটিশশাসিত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড চেম্সফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন স্থাপন করলেন। কমিশনের প্রধান হিসেবে বসানো হল এম ই স্যাডলারকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন কেমন চলছে তার রিপোর্ট তৈরি করাই স্যাডলারের দায়িত্ব। যদিও কমিশনের আসল উদ্দেশ্য অন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে নজর রাখা। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রিটিশ সরকারের চোখে বিপ্লবী তৈরির আখড়া। স্যাডলার একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট ৬৭১ জনকে বিলি করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আরও দাবিদাওয়া আলাদা করে লিখে জানানো যাবে। স্যাডলার জানতেন, উত্তরপত্রে কড়া নজর থাকবে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের।

উত্তরদাতাদের মধ্যে একজনের উত্তরপত্র ছিল বেশ দীর্ঘ। পঠনপাঠনের সমস্যা ছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যময় পরিবেশের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। উত্তরপত্রে লেখা ছিল, “যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় তা হলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণির (আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণি বলে অভিহিত করছি, যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বলা হয়) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্রেরা। কোনও গণতান্ত্রিক শ্রেণির ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র এক ঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয়।” উত্তরদাতা বছর কুড়ির এক লেকচারার মেঘনাদ সাহা। মাত্র দু’বছর আগে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন এবং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছেন।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টে মেঘনাদ সাহার মতোই পিছিয়ে পড়া বা ‘নিচু জাত’-এর ছাত্রদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। কিন্তু তাঁর ও মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদি পার্থক্য ছিল, যা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর রিপোর্টে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্য আলাদা আর্থিক তহবিল গড়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। 

শীলের রিপোর্টে যুগ্গি, বারিক, সুবর্ণবণিক, নমঃশূদ্র, সাহাদের ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ বা কোথাও ‘লোয়ার কাস্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

 সেখানে মেঘনাদের রিপোর্টে এরা প্রত্যেকেই এক ছাতার তলায়, গণতান্ত্রিক শ্রেণি। নিজের রিপোর্টে পৃথক তহবিল গড়ে তোলাকে একদমই প্রশ্রয় দেননি মেঘনাদ। তিনি সবার সমান অধিকারের প3ক্ষে। মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বর্তমান ভর্তুকিপুষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সরাসরি বিপক্ষে। তিনি সেই সময়েই বুঝেছিলেন, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভেদ টেনে এবং ভর্তুকি দিয়ে কোনও এক বিশেষ শ্রেণির উন্নতির সম্ভাবনাকে মেরে ফেলায় দেশের সত্যিকারের উন্নতি সম্ভব নয়। 

২৮ বছর পরে, দেশভাগের সময়েও মেঘনাদ সাহার গলায় ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টেরই সুর। তখন তিনি আর ২০ বছরের লেকচারার নন। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। কিন্তু ল্যাবরেটরির বাইরে এসেও তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর সাম্যের গান। স্বাধীনতার বছর দুই আগে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকায় মেঘনাদ লেখেন, “দেশভাগের ফলে ভারতে থাকা মুসলমানরা হিন্দুরাজের পদদলিত হয়ে থাকবে এবং সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত হবে বলেই মনে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকেও একটা কড়া জাতীয়তাবাদের রেখা দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হবে, যা সংখ্যালঘু শ্রেণির মধ্যে ডেকে আনবে সীমাহীন দারিদ্র্য।” পরের বছর ফের একই পত্রিকায় লেখেন, 

“সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে, অশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে হলে, রোগ-জরা-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।”

 ‘আওয়ার ন্যাশনাল ক্রাইসিস’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে মেঘনাদের মূল বক্তব্য ছিল, সবাইকে কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না। 

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি' নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে।

এই ভুল সংশোধন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু। তাদের এই অনূদিত প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।

১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেন।

নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি “আবিষ্কার” নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।

 মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারও মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে৷

তিনি ভারতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে আধুনিক গবেষণার জন্য ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য ১৯২৭ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটি তাকে এফআরএস নির্বাচিত করে।


তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে 'তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব' প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত 'সাহা আয়নীভবন সমীকরণ' নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

তিনি ও তার সহপাঠী এবং সহকর্মী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের 'স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' জার্মান থেকে ইংরাজি অনুবাদ করেন যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ভারতের নদী নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ভারতে পদার্থবিদ্যার বিকাশ ও প্রসারের জন্য ১৯৩১ সালে 'ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া' প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও ১৯৩৪ সালে ভারতে পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন 'ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি'ও প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগেই ভারতে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব সায়েন্স' এর সূচনা হয়, যা বর্তমানে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি' (আই. আই. টি.) নামে বর্তমানে পরিচিত।

১৯৫২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে ভারতীয় লোকসভার কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র (বর্তমানে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র) হতে নির্বাচিত সাংসদ হন।

কিন্তু কেমন ছিলেন ব্যক্তি মেঘনাদ? তাঁর ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায়, স্পষ্টবক্তা হিসেবে ‘কুখ্যাতি’ ছিল মেঘনাদের। আসলে কাজের জায়গায় কোনও রকম কুঁড়েমি তিনি পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা তাঁকে ভয় পেত। 

কিন্তু কড়া শিক্ষকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এক ছাত্রদরদি নরম মনের মানুষ। ব্রজেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়,

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় জাপানি বোমাতঙ্ক ছড়িয়েছে, অধ্যাপক সাহার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। সকালে চা খেয়ে পড়াশোনা, গবেষণার কাজ শুরু করায় অভ্যস্ত ছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। কিন্তু অধ্যাপক সাহার বাড়ির রান্নার লোক অনেকটাই দেরি করে আসতেন। ছাত্রের অসুবিধের কথা ভেবে নিজে হাতে চা তৈরি করে খাওয়াতেন তিনি। তবে হঠাৎ করে রেগে যাওয়াও ছিল মেঘনাদের স্বভাবের একটি অঙ্গ। আসলে, অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী মানুষটি সারা জীবনই বঞ্চনা ও গঞ্জনার শিকার - যা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর স্বভাবেও। এমনকি নিজের বিবাহেও সহ্য করতে হয়েছিল গঞ্জনা। 

মেঘনাদ সাহার বউমা বিশ্ববাণী সাহার লেখা থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালে রাধারাণী রায়ের সঙ্গে বিবাহ হয় মেঘনাদের। বিয়েতে তাঁর পাঞ্জাবির তলা দিয়ে ছেঁড়া গেঞ্জি দেখা যাচ্ছিল। পাত্রের দুর্দশা দেখে বিয়েতে প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন রাধারাণীর ঠাকুমা। আসলে গবেষণায় মগ্ন মানুষটি তখনও জীবনে বিশেষ টাকাকড়ি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বিদ্যাচর্চায় খামতি থাকেনি। গবেষণাগার থেকে ফিরেও বইয়ের জগতে ডুবে যেতেই পছন্দ করতেন। বাড়িতে ছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। 

মেঘনাদ সাহার তৃতীয় কন্যা চিত্রা রায় জানিয়েছেন, অধ্যাপক সাহা যখন গবেষণার কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতেন, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’ থেকে পড়ে শোনাতে হত তাঁকে। অধ্যাপক সাহার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে জায়গা পেয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের বিশাল সম্ভার - যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাক্সিম গোর্কি, নুট হামসুন, লিয়ো টলস্টয়ের লেখা বইপত্র। অধ্যাপক সাহার এই সাহিত্যপ্রেম দানা বেঁধেছিল ইলাহাবাদে থাকাকালীন। ইলাহাবাদে সেই সময়ে একটা বাংলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যমণি ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছিলেন যোগেনচন্দ্র গুপ্ত। এঁদের সান্নিধ্য অধ্যাপক সাহার কাছে ছিল বিজ্ঞান ও রাজনীতির বাইরে এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতো। সাহিত্য পাঠ ও চর্চা ছাড়াও দেশবিদেশের পত্রিকা সংগ্রহে তাঁর উৎসাহ ছিল। বাড়ির ছোটদের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ম্যাগাজ়িন থেকে বিভিন্ন ছবি দেখাতেন, অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি পড়ে শোনাতেন। ছোটদের জন্য কলমও ধরেছিলেন কয়েক বার, যা প্রকাশিত হয় যোগেনচন্দ্র গুপ্তের ‘শিশুভারতী’ পত্রিকায়। সাহিত্য ছাড়াও অধ্যাপক সাহা উৎসাহী ছিলেন ভাষাতত্ত্ব চর্চায়। বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আকর্ষণের সূত্রপাত ঢাকার স্কুল থেকে। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশন আয়োজিত এক পরীক্ষায় তিনি সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে জার্মান ভাষার সঙ্গে পরিচয়। এর পরে সারা জীবনই যখন সুযোগ পেয়েছেন বিভিন্ন ভাষা চর্চা করে গিয়েছেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজা শঙ্কর গুহর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাষা চর্চা করতেন নিয়মিত। সেই বিষয়ে একাধিক বই সংগ্রহ করাটাও তাঁর নেশা ছিল। 

‘দেশ’ পত্রিকাকে (১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিত ডেভিড ডিভরকিন জানিয়েছিলেন, মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ়ের জন্য মনোনীত করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯২৭-এর পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটন। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় ভাটা পড়ার কারণেই হোক বা দেশীয় বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায়, নোবেল প্রাইজ় তিনি পাননি। তাঁর জীবনযাপনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষীও ছিলেন না তিনি। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে জাতিভেদ, অসাম্যকে জয় করা এবং তথাকথিত উঁচু তলার মানুষদের তৈরি করা বিভাজন রেখাকে মুছে ফেলা। আমৃত্যু সেই কাজটাই করে গিয়েছেন মেঘনাদ নিষ্ঠার সঙ্গে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞান সংগঠক মেঘনাদকে না পেলে ভারত বিজ্ঞান গবেষণায় সাবালক হয়ে উঠত না।

কংগ্রেসের চরকা কাটার নীতির বিরোধিতার কারণে দেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না, যা বাধা সৃষ্টি করেছিল মেঘনাদ সাহার কর্মকাণ্ডে। স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকারের পারমাণবিক শক্তি কমিশনেও তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংগঠক হিসেবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করা, প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরিও তাঁর সাহসী পদক্ষেপের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়াও দেশীয় উপাদানে নিজের বিটা স্পেকট্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক সাহা, যার সাহায্যে ভারতীয় খনিজ পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা জরিপ করা, এ দেশে জীববিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্রিক বিজ্ঞান বা নিউক্লিয়ার সায়েন্সের প্রয়োগ তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়। 

১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আচমকাই মৃত্যু এসে থামিয়ে দিয়েছিল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোরের লেখায় আছে, ‘ড. জ্ঞান ঘোষের ফোনে অধ্যাপক সাহার অসুস্থতার খবর পাই। ওয়েলিংটন নার্সিংহোমে পৌঁছে জানতে পারি সব শেষ।’ 


বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, তিনি সময়ের আগে জন্মেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত হয়ে উঠতেই পারেনি তৎকালীন ভারত। তাই বিজ্ঞান বা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, ভারতীয় বিজ্ঞানের তিন নক্ষত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আচার্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মেঘনাদ সাহা আজও শুধুই অধ্যাপক সাহা। এ ক্ষেত্রেও তিনি ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের ‘পিছিয়ে পড়া’ বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

বিপ্লবী পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা - প্রতিবাদের এক শক্তিশেলের নাম। বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ সাহা স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। ছয়বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। সারাজীবন লড়াই করেছেন জাতপাত, দারিদ্রের বিরুদ্ধে। আজ মেঘনাদ সাহার জন্মদিবস। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, চ‍্যানেল হিন্দুস্তান, কোলকাতা ২৪×৭ ডট কম, ব্লগ ডট মুক্তমনা ডট কম, উইকিপিডিয়া, ড. চিত্রা রায়, ‘ডিসপার্সড রেডিয়েন্স, কাস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স ইন ইন্ডিয়া’ : আভা শূর, ‘মেঘনাদ সাহা : দ্য সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড দ্য ইনস্টিটিউট বিল্ডার’: শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স - ২৯ (১), ১৯৯৪, দেশ পত্রিকা - ১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929