মানব প্রকৃতির মধ্যে মন্দভাবটা ঐতিহ্য ও শিক্ষার দ্বারা পরিমার্জন ঘটিয়ে যথার্থ মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটানোকে স্বাভাবিক ভাবে সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। এতদ্ব্যতীত যে স্থুলতা অবিকৃত তাকে তাহাই অপসংস্কৃতি। পুরোণ পুঁথি পত্রে নর নারীর যথেচ্ছ নাচগান, মেলামেশা ও যৌন সম্পর্ক ও পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে কাহিনীর ছড়াছড়ি। এমনকি মধ্যযুগেও এমন অবারিত মেলামেশার সুযোগ ছিল।
তারপর ধীরে ধীরে সমাজব্যবস্থায় বিধি নিষেধ কঠোর হলেও গোপনে মেলামেশার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
বৈদিক যুগে নারী নিজেই নিজের বন্ধু বা সঙ্গীকে পছন্দ করার সুযোগ পেয়েছিল। এখনও এদেশের আদিবাসীদের মধ্যে সেই ধারা প্রচলিত আছে।
বিগত পাঁচ ছয় শতাব্দী জুড়ে সমাজে নরনারীর অবাধ মেলামেশা নিয়ে কঠোর বিধি নিষেধ বলবৎ থাকলেও, বর্তমান সমাজে এই প্রাচীন বিধি নিষেধ কে অগ্রাহ্য করার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। আসলে মধ্যযুগে যে বিধি নিষেধ আরোপিত ছিল, অর্থাৎ রক্ষণশীল সমাজের রীতি নীতিকে তুড়ি মেরে একটা স্বাভাবিক প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটছে। কালের তালে আগত আবহের সাথে রক্ষণশীল সমাজ যদি সহিষ্ণুতা দেখায় তবে নরনারীর বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা হয়তো শোভনতা প্রাপ্ত হবে। উচ্ছৃংখলতা শব্দের অর্থ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
স্বাভাবিক ভাবে দেখা যাচ্ছে, অবাধ মেলামেশা, মানসিক বা জৈবিক টানে যুগ যুগ ধরেই ছিল। যেটা সমসাময়িক সমাজে অনুমোদিত নয়। সেটাই গোপন অভিসার হিসেবে প্রচলিত। প্রকৃত পক্ষে জৈবিক প্রেরণা, বা অনেকটা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৌতুহল বা আকর্ষণের নিরীখে। আসলে জৈবিক টানকে প্রতিহত করার তাগিদে সোজা পথের সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় গোপন পথে জৈবিক প্রকৃতি চরিতার্থ করা। এটাকে পুরোপুরি অপসংস্কৃতির দোহাই না দিয়ে জীবের স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাটাকেও কিছুটা মান্যতা দেওয়া যেতে পারে।
পর্ব- ২
বেদ হলো আর্য্য গোষ্ঠীর জীবন বোধ সংক্রান্ত চিন্তাধারার প্রথম প্রকাশ। যার দ্বারা আধিপত্য কায়েমেরও চেষ্টা হয়েছে, ওই গোষ্ঠীর দ্বারা। লোকায়ত হলো এদেশিয় আদিম অধিবাসীদের জীবন বোধের চিন্তাধারা। কালক্রমে আর্য্য অনার্যর মিলনে যে শঙ্কর জাতের সৃষ্টি হয়, তাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে বাঁধাই ছিল বৈদিক দর্শন। আর্য্যরা তাই আদিবাসীদের লোকায়ত দর্শনকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।
গান বাজনা, নাচ গান, পোশাক আশাক, ইত্যাদি যুব সম্প্রদায়ের আবেগের পরিস্ফুটন। ফলে সমাজে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
কারন যুব সম্প্রদায়ের রুচির সাথে তথাকথিত সমাজের ধারক ও বাহক বয়স্কদের মিল খায় না। শুরু হয় সামাজিক সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির সংঘাত।
তারুণ্যের প্রভাব ও রুচি কতটা পরিমান প্রাধান্য পাবে বা কালক্রমে এই ধারা ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তাতে ভবিষ্যত সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির নিরিখে কেমন রূপ ধারণ করবে, এটা একটা প্রশ্নই বটে।
সংস্কৃতিকে কোন গণ্ডির মধ্যে বাঁধা যায় না। প্রাকৃতিক ভাবে তা সতত পরিবর্তনশীল। বর্তমান যুবসমাজই বহন করে নিয়ে যাবে পর্যায়ক্রমে আগত প্রজন্মের জন্য। তাই সংস্কৃতির প্রশ্নে সামাজিক সহিষ্ণুতার প্রশ্ন বার বার উঠেছে, উঠবে।
অস্বাভাবিক আতিশয্যের ফলে কিছুটা বাড়াবাড়ি হতে পারে, কারন রুচির পরিবর্তন তো কালানুক্রমিক। পরিবর্তন যুগকে প্রতিভাত করলেও সবটা বজায় রাখা কঠিন। সুরুচি, শোভনতা, সুন্দরতার রূপান্তর ঘটে, যদি উন্মাদনায় পৌঁছায় ধৈর্যশীল হতে হবে। আতিশয্য, উন্মাদনা স্থায়িত্ব পেতে পারে না, সংস্কৃতি নিজেই নিজের রূপ ধারণ করে।
আতিশয্যের প্রকাশই রুচিকে পীড়িত করে। আতিশয্য ছাড়া ফুর্তি নাকি পূর্ণতা পায় না। নারীর পোশাক-আশাক, ধূমপান, চুলছাঁটা, ছেলেদের লম্বা চুল রাখা এগুলো নাকি অপসংস্কৃতির লক্ষণ। কেন? ধূমপান তো মোঘল আমলেও প্রচলিত ছিল। নিকট অতীতে দু-দশক পূর্বেই এদেশে মেমসাহেবদের ধূমপান করতে দেখা গেছে। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপূর্ণ বাড়িতে নারী গড়গড়াও টানতো। সেখানে প্রান্তিক গরীব শ্রমিক শ্রেণী হুঁকো বা বিঁরি টানতো। উপর তলার নরনারী বিদেশী মদে, আর নীচের তলা শস্তার মদে ডুবে থাকে। আঙ্গুল ওঠে শুধু মধ্যবিত্ত সমাজের বেলায়।
উনিশ শতকে এসে মদ্যনিবারণী সভা রাশ টানার চেষ্টা করেছে। যে কারনে আজকাল মধ্যবিত্ত সমাজেই নারীদের অভ্যাস বশতঃ মদ্যপান ও ধূমপানে অপরাধবোধ কাজ করে।
তাই বলা যায় রুচির আতিশয্য যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা সীমা অতিক্রম করে, ততক্ষণ আতঙ্ক বা আপত্তি থাকা উচিৎ নয়।
যদিও অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান নরনারী উভয়ের ক্ষেত্রেই স্বাস্থহানিকর। তাই মাত্রার নিরীখে মদ্যপান ও ধূমপান যদি সাময়িক আরাম বা আনন্দের কারন হয় আপত্তি থাকা উচিৎ কি?
পর্ব - ৩
বিগত শতাব্দীতে কিশোর ও যুবসম্প্রদায় ছিল তৎকালীন সমাজের একান্নবর্তী পরিবারের আওতায়। মানসিক মুক্তি ইচ্ছানুরূপ ছিল না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সবাই ছিল বাল্য অবস্থা থেকে বিশেষ পরিচিত বা আত্মীয়। ফলে ভয় ব্যপারটা মনের মধ্যে সদা জাগ্রত থেকে একটা অলিখিত চাপ প্রয়োগ করতো। ব্যতিক্রমী হওয়ার সাহস সবার সব ক্ষেত্রে কঠিন ছিল। ব্যতিক্রম চোখে পড়লেই গুরুজনরা আঁতকে উঠতেন, গেল গেল রব উঠতো। বোধগম্য হতোনা কতদূর পর্যন্ত নির্দোষ হৈ-হুল্লোড় অনুমোদিত না হলে এ প্রজন্মের রোষানলে পড়া যায়। চলতো প্রথা লঙ্ঘনের, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা নিরবধি।
বর্তমানে ব্যতিক্রমী পথটা শহরই দেখিয়েছে। যেহেতু নানা ভাষাভাষি, নানা মত, নানা সংস্কৃতির একত্র বসত, এক মিশ্রিত সমাজ। তাই সামাজিক গণ্ডিটা লঙ্ঘন সহজ। গুরুজনের তীক্ষ্ণ নজরকে এড়িয়ে চলার অফুরাণ সুযোগ। এ সবের বিরুদ্ধতা, প্রতিস্পর্ধার বাসনাটাকে উসকে দেওয়ার ফল মোটেই আশাপ্রদ হবে না। এই গণ্ডি অতিক্রম বিগত শতাব্দীর বশংবদতার প্রতিবাদ। বর্তমান প্রজন্মের স্বতন্ত্র জীবনীশক্তির প্রভাবে স্বাভাবিকতার প্রকাশই এমন প্রতিবাদী হওয়ার কারন। এরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর, নবযৌবন দূত, তাই ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
বন্ধনহীন মেলামেশায় কখনোও থাকে ভালোবাসা, কখনোও বা ভালোবাসার অভিনয়ের মাধ্যমে উন্মাদনা লাভ। কারন অনেকেরই ভবিষ্যৎ অস্বচ্ছ।
গ্রামাঞ্চলে চাষবাসের উপর নির্ভরশীল প্রজন্মের পর প্রজন্ম আস্থাশীল। কিন্তু শহরাঞ্চলে কাজ কর্মের কোন স্থিরতা না থাকায় দিশাহীন ভবিষ্যত। যে কারনে সংসার বাঁধার ইচ্ছে রূপায়নের স্থিরতা না থাকায় উন্মাদনার মাধ্যমে সমাজে কর্মহীন বেকার যুবক-যুবতীরা ক্ষণিক উত্তেজনার মাধ্যমে প্রেমের ক্ষতিপূরণ করে নেয়। যারা সচ্ছল পরিবারের সন্তান সংসার বাঁধার আগেই যতটা সম্ভব দেদার অর্থ বিলিয়ে, পছন্দমত বহু সঙ্গিনীর সান্নিধ্য লাভ করে, ফুর্তির স্বাদ গ্রহণ করে নিতে চায়।
এই মুক্তমন নারী পুরুষের সখ্যতা সময় বিশেষে শোভনতার মাত্রা অতিক্রম করে, তবুও আতিশয্যটা বাদ গেলে অবশিষ্টাংশ সেই সহজ, মুক্ত, সখ্য, সমাজের পক্ষে হয়তো ভালো হবে।
বর্তমান সমাজের ছেলেমেয়েদের এই অত্যধিক অনর্গল উদ্দাম মেলামেশাকে অপসংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ওরা হাজার উদাহরণ হাজির করছে মধ্যযুগ বা প্রাক ‘অশোক’ যুগ বা তারও আগের সংস্কৃতিকে উদাহরণ হিসেবে। এমন কি পুরাণ বা মহাকাব্যে ছড়িয়ে থাকা ভুরিভুরি উদাহরণকে।