কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, এ গল্পের শিরোনামের মানে কি?
তাকে অকপটে জানাই, আমি জানি না।
তাহলে এ লেখার এমন নাম দিলাম কেন?
এর একটা ইতিহাস আছে।
ইতিহাসটি হলো আমার পাশের গ্রামেই থাকে এক যুবক। বেকার। হ্যাঁ, এটাই ওর কাছে ওর বড় পরিচয়। কিন্তু আমাদের কাছে ও একজন যুক্তিবাদী। নানান ক্রাইসিসে মানুষের মাঝে যুক্তিবাদের প্রসারে আত্মনিবেদনকৃত। সাপের কামড়ে ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সচেতনতায়। জ্যোতিষীকে চ্যালেঞ্জে। জণ্ডিস তোলা, ডাইনির কু নজর, জ্বীন ভূতের দাবীদারকে পাবলিকলি এক্সপোজ করার সাহসিকতায়। ভণ্ড গুরু পীরবাবাদের ভণ্ডামি উন্মোচনে। সব সময় সাথে পাবে ওকে।
কিন্তু বড় দুঃখের কথা। তাকে আজ দেখলাম এক ভিন্ন রূপে। সম্পূর্ণ বদলে গেছে সে। অর্থের নেশায় উন্মত্ত।
সে এখন এক জ্যোতিষী। ঠিক জ্যোতিষী নয়, জ্যোতিষ শাস্ত্র পড়া, "বিজ্ঞানভিত্তিক" পথপ্রদর্শক, আসলে স্টোন বিক্রেতা। ডায়ামণ্ড, রুবি,এমর্যাল্ড,সাফ্যায়ার, ব্লু, পিঙ্ক, ইয়োলো। একই কাটিংয়ের কত নাম। সব ব্যবসা। মাছের মত সাইজ বাড়লে রেট বাড়ে, এরও তেমন, সাইজ আর খদ্দেরের সামাজিক স্তর সমানুপাতে দাম। খদ্দের যত শাঁসালো, ফাঁড়া তত বেশি, বিজ্ঞানের কপচানির সাথে লাভের অঙ্কের উচ্চলম্ফন। নিশ্চিত এক আয়ের পথ।
আমি আশ্চর্য্য হয়েছিলাম।
বাম নেতার রামের দলের পতাকা নিয়ে তাদের মিছিলে জয়শ্রীরাম স্লোগান দিতে দেখেও এত অবাক হই নি।
আমাকে দেখে ও লজ্জা পেল না, ভয় পেল না, সংকুচিত হলো না, পালিয়ে গেল না।
কাজেই তার কাছে গেলাম। কথা বলবো। কিন্তু আমার আগে ও-ই প্রথম শুরু করলে, আগুন ঝরা লেখাগুলো এখনো লিখে যেতেও পারি। কিন্তু যুক্তিবাদী আন্দোলনে জ্যোতিষ নিয়ে যা পড়াশুনা, অভিজ্ঞতা আছে, অন্ধবিশ্বাসীগুলোকে মুরগী করে স্টোন বিক্রি করে যাবো। এটাই আমার ব্যবসার রেসিপি। ধর্মান্ধ, আকাঠ, গবেট, বি. এ, এম.এ, ডক্টরেট, ডিগ্রীওয়ালা শাঁসালো মাস্টার, প্রফেসার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার ক্লায়েণ্টের বাড়ি গিয়ে জ্যোতিষের আফিং-এ আরো ডোজ বাড়িয়ে দু হাজারের স্টোন বিশ হাজারে বেচবো।
কারণ ব্যবসা হাবিবুল্লাহ।
এবার আমি সত্যি সত্যি কী বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না।
সে-ই আমাকে বোঝালে, আসলে হয়েছে কী, আমার যে শেঠ, তিনি বম্বের এক বড় জহুরি। আবার তিনি এক বড় মৌলানা, ওয়াজি হুজুরও বটে। তার বেশ শাঁসালো মুরিদানও ( শিষ্যও) আছে। সেখানে ঢঙ একটু আলাদা। জমজমের জলে শোধিত আসল জেমসের আল্লাহ লকেট, আলী লকেটা, আয়েষা সুরমা। অনেকটা ঠিক হনুমান যন্ত্র বা দেবতার বিভূতি। মুরিদানের বাড়ি ওয়াজও করেন, ব্যবসায়ের জমিও চাঢ করেন। জাকির নায়েক ঢঙে। মুখস্থ টুখস্থ ভালোই করেছে। আমি নিজেও কোরাণের আয়াত টায়াত, সুরা টুরা মুখস্থ করে একটা পার্ফর্ম্যান্স দেখিয়েছি। একটা সিজনেই পঁচিশ হাজার থেকে লাখ খানেক, কখনও বা লাখ দুয়েক আয়। হুজুরের কমিশন 20% থেকে লাভ অনুযায়ী 30%। বাকিটা আমার। বড় কথা হল আমার বসই ওয়াজে কায়দা করে বাজারি স্টোন, জ্যোতিষের বিরুদ্ধে কোরাণের কত আয়েত ঝাড়লো। অথচ সে আর মারাঠী ব্রাহ্মণ, এক ধর্মগুরু, মণিলাল, জহুরি বাজারে স্টোন মার্চেণ্ট দুনিয়ায় রাজ করে। ডাইরেক্ট শ্রীলঙ্কা বা মাদাগাস্কারের মাইন থেকে জেমস এনে এখানে কাটিং করে। এর এক টুকরোও বাদ যায় না। সবচেয়ে ধনীর ঘরে যায় সবচেয়ে বড়টা, গরীব গুর্বো, ছাপোষার ঘরে যায় নিচে পড়ে যাওয়া কুড়ানো চুনীগুলো। ঠিক যেমন বড় ইলিশ খায় বড় লোকে, চুনোপুঁটি খায় ছাপোষায়। কিন্তু আমার বস আর মণিলাল জুটি গুরুগিরিও করে, ব্যবসাও করে।
তাকে কেউ এ বিষয়টা তুললেই পরিষ্কার বলে দেয়- " ব্যবসা হাবিবুল্লাহ।" আমি জানি না, এর মানে কী।
বড় লোকের বিটি! গান শিখেছে, টিভিতে দুবার গান টান গেয়ে দুটো হাততালি পেয়েছিল, আর তাকে কেউ কেন ডাকে না! দেখাও হাত, নাও একটা স্টোন। বাপের বহুদিনের কারবার, ইদানিং আউটপুট তেমন দেখতে পাচ্ছে না, বিশ্বস্ত লোকের রেফারেন্স পেলে সেখানেও দশ আঙুলে দশটা স্টোন সাজানোর প্রজেক্ট অবশ্যই নেওয়া যায়।
ব্যর্থ প্রেমের কেস গুলো একটু সিমপ্যাথি থেরাপির সাথে স্টোন দিলে তো দরদামই করতে হয় না। জ্যোতিষ দুনিয়ায় এমনই হাজার এপিসোড। আর গরীব গুর্বো মধ্যবিত্তের দৌড় ঐ চল্লিশ পঞ্চাশ তক। তবে তাদের বাড়ি ঝাড় ফুঁক দোয়া তাবিজ করে পাঁচ দশ হাজার হাতানো একেবারেই রুটিন জব।
মাসে পঞ্চাশ ষাট মার্জিন তো আছেই। একা পারি না, বিভিন্ন শহরে সেলার বসিয়েছি। কোনো কোনো বৎসরে কোম্পানির টার্ন কোটি ছাপিয়ে যায়।
কুসংস্কারের চাষে জল সার দিয়েই আমার আয়।
আমার পেশার ক্লায়েণ্ট ঐসব অন্ধ গবেটগুলো। ওরাই আমার রিসোর্স। আজ আমার বাড়ি, গাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের ওরাই যোগানদার।
এবার
আমি একটা গল্প শোনালাম, আমার এই হঠাৎ ধনী বন্ধুটিকে।
আবদুল্লা আল মাসুদ। ঢাকায় একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন এই মুফতি। কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। জেনেছেন কোরাণ মিথ্যা। মিথ্যার ভিতের উপর ধর্মের বিশাল ইমারত। জানালেন সে মিথ্যা। কিন্তু ধর্ম চিরকালই ভয় পায় আলোকে, সত্যকে। বরং বলা যায় সত্যের আলোয় তাদের অন্ধকার সাম্রাজ্য তছনছ হওয়ার ভয় সদা সর্বদা। তাই মস্তিষ্কবিহীন পাহারাদার সদা সর্বদা নিয়োজিত। সত্য যে বলতে চাইবে, ঘাড় থেকে তার মাথাটি কেটে নেওয়ার বিধান কার্যকর করার হাজার জেহাদি, হাজার মূর্খ, হাজার নীরবে-অন্যায়- সহ্য- করে- যাওয়া- জনগণ। এরা অভিজিৎকে মারে, বাবু ওয়াশিকুরকে মারে, অনন্ত বিজয়কে মারে, আরেফিন দীপনকে মারে, গৌরী লঙ্কেশকে মারে। হত্যা করে সাজাহান বাচ্চুকে, জাফর ইকবাল স্যারকে। হামলা করে আসিফ মহিউদ্দিনকে। হামলা করে রাফিদা আহমেদকে। হত্যা করে গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকার, এম এস কুলবার্গি, পাকিস্তানের খুররম আর কত নাম বলবো। সব তো জানিও না। নীলয় নীল কিংবা সাজাহান বাচ্চুকে তো দিনের আলোয় মারে। আসিফ মহিউদ্দিনকে দেশ ছাড়া করে। দেশছাড়া করে তসলিমাকে।
কাজেই সাজানো সংসার, সুখের সাম্রাজ্য ছেড়ে, মাতৃভুমি ছেড়ে পাড়ি দিতে হল মাসুদ ভাইকে অনিশ্চিত জীবনে পাশের দেশে। এলেন কলকাতায়। কী অসহনীয় একাকী নিরাপত্তাহীন জীবন।
তবু তিনি বলে চলেন, " অদ্ভুত অন্ধকার চারিদিক। সেখানে এক ঝাঁক সাহসী তরুণ আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে চলেছে জোরকদমে। আমি তাদেরই একজন।"
এখানে সত্যকে পাথেয় করলে ধর্মান্ধরা খুনের চেষ্টায় থাকে।
তবুও তিনি অকপটে ঘোষণা করেন নিজের পরিচয়, আমি মানি না আল্লাহর অস্তিত্ব। জানালেন মিথ্যা কোরাণ, মুহাম্মদের মিথ্যাচার। আমি এক্স- মুসলিম। আমি ইসলামকে ত্যাগ করেছি, আমি মুরতাদ।
আর মুরতাদের জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে সমস্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধরা।
তবু তিনি তার পথে অবিচল। শিরদাঁড়া এতটুকু নোয়াবার নাম নেই। এত অসহায়তার মাঝেও তিনি আওড়াতে পারেন ম্যাক্সিম গোর্কির বাণী, " ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকবে আক্রোশের আগুন, আর তার তেজে বাঁকা এ মেরুদণ্ড সোজা হয়ে ওঠে"।
তার একটি গল্প শোনাই। মিজানুর আজহারি নামের তার এক সহপাঠী ছিল। সে এখন জাকির নায়েকের শিষ্য। থাকে মালয়েশিয়ায়। কোটি কোটি টাকার মালিক।
মাসুদ ভাই যদি চাইতেন, এই একাকীত্বের নিরাপত্তাহীন অসহায়ত্বের জীবন না কাটিয়ে এই রকম কোটি কোটি টাকার মালিক হতেন, কারণ আজহারির থেকে ইসলামিক জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে মাসুদ ভাই অনেক উপরে। কিন্তু তিনি সুখের জীবন ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন সত্যের পথ, যে পথে প্রতি মুহুর্তে আছে
মৃত্যুকে আলিঙ্গন।। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসাই জীবন, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে। তাহলে আর ভয় কিসের?
এ গল্পের শেষটায় কিন্তু আমি নিজে আরও আশ্চর্য্যান্বিত।
বন্ধুটির সাথে বহুদিন যোগাযোগ রাখতাম না। ও তখন থেকে পাকাপাকি বম্বের বাসিন্দা। হঠাৎ এই কদিন আগে, মানে গত বৎসর লকডাউনের আগে একবার বাড়ি এসেছিল। আমার সাথে দেখা করতে এলো। এটা সেটা কথার পর জানালো, জানো ওসব বুজরুকির কারবার ছেড়ে দিলাম। আগে আমার যুক্তি ছিল, আমি স্টোন সাপ্লাই না করলেও অন্য কেউ তো করবেই, কারণ এর বাজার আছে, অন্ধবিশ্বাসী খরিদ্দার আছে।
এখন ভাবলাম, যে করে করুক, আমি জ্যোতিষীদের আর স্টোন সাপ্লাই করবো না। অন্তত এ ব্যবসায়ের একটা সাপ্লায়ার তো কমলো! আর উদ্যোগ থাকলে অনেক কিছুই করা যায়। কলকাতায় স্টোন-জুয়েলারি স্বর্ণ কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেছ? ওটার আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টার। হাওড়া সন্ধ্যাবাজার, বড়বাজারে কলাকার স্ট্রীট, জোড়াসাঁকোয়, ক্যামাক স্ট্রীটে আর কাকুড়গাছিতে শোরুম দিয়েছি। ডোমজুড়ে একটা কারখানাও করেছি।
আজ আমায় পাবে একাডেমির সামনে গজিয়ে ওঠা দরগা ভাঙার আন্দোলনে, মুক্তমনা হত্যায় রাষ্ট্রের সমর্থনের বিরুদ্ধে রাজপথ অবরোধে, যুক্তিবাদী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতায়।
ও তো বকবক করছিল। আমি দেখলাম একটা ছেলে ঠিক আলোর বৃত্তে ফিরে এসেছে।
আমি বললাম, কিন্তু ঐ যে বলছিলে, মনসুর হবিবুল্লা না কী যেন?
হো হো করে অট্টহাস্য দিয়ে বললে, মনসুর হবিবুল্লাহ নয়, ব্যবসা হবিবুল্লাহ। কিন্তু প্লিজ, এখনও মানে জিজ্ঞেস কোরোনা।