যুক্তিবাদীর চোখে গীতা শ্রীমদ্ভাগবত-পুরাণ সমীক্ষা
সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 21, 2024 | | views :999 | like:2 | share: 3 | comments :0
আমি দেখছি। অনেকেই গীতাকে একটি দর্শনের বই ধর্ম গ্রন্থ কেউবা সাম্প্রদায়িক বলে থাকে। কিন্ত ভাগবত পুরাণ ছাড়া গীতার মাহাত্ম্য বোঝা যায়। আমরা অনেকেই শ্রীমদ্ভাগবদগীতা পড়েছি! কিন্ত বিশেষ করে যখন যুক্তিবাদীরা গীতা পড়ে 9/32 নিয়ে, যখন সমালোচনা করে তখন শুধুমাত্র একটি শ্লোক ধরেই করে। কিন্ত কিছু মানুষ এখানেও গীতার শ্লোক নিয়ে অপপ্রচার করে। সেখানেই অন্যতম হলো গীতার 9/32 শ্লোক যেখানে নারীকে বেশ্যা পাপযোনি তার থেকে শূদ্র সন্তান বলা হয়। তখন সেটা আরো চরম ভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠে এখানেই কিছু মানুষের মিথ্যাচার চলে। তারা বলে গীতা বোঝা কি অত সহজ তাহলে গীতার 9/32 কি বোঝাতে চাইছে আমরা জানার চেষ্টা করবো এখন..
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ |
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যাস্তি পরাং গতিম্ || ৩২
এখানে মূলত যে সংস্কৃত শ্লোক গুলি গুরুত্বপূর্ণ
পাপযোনয়ঃ = বলতে নীচকুল জাত [তাহলে জাতিভেদ ও চলে আসছে, তার সাথে নীচ কুলজাত এই নীচ কুল বলতে কি এর জন্য ¹(গীতা 1/41) পড়তে হবে সেখানে বলা আছে যে বর্ণসংঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। ] এবার [ বর্ণসংঙ্কর কি? তার জবাব হলো ¹(গীতা 1/40) সেটা হলো ! ব্রাহ্মণ কন্যা যদি ব্রাহ্মণকুল ছেড়ে অন্য বৈশ্য শূদ্র কুলে বিবাহ কে বর্ণসংঙ্কর বলে। তার সাথে সেই কুলস্ত্রীগণকে অসৎ চরিত্র ব্যভিচারী বলেছে আর যদি সেই ব্রাহ্মণ কন্যা শূদ্র পুরুষ কে বিবাহ করে তার দ্বারা যদি কোনো সন্তান কে জন্ম দেয়! সেখানেই গীতা বলছে অবাঞ্ছিত প্রজাতি, ভাবা যায়! আমরা গীতা থেকে এক নতুন বিবর্তনবাদ এর অনুসন্ধান পেলাম আর সেইসব প্রজাতির নাম জানলে অবাক হবেন? আইন শাস্ত্র যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, সেই প্রজাতির নাম বলেছে।
যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার ১ ম অধ্যায়ের ( ৯১-৯৫ )² নং শ্লোকে দেয়া আছে
১ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + ব্রাহ্মণ কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান ব্রাহ্মণ
২ ) ব্রাহ্মণ পুত্র + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান মুৰ্দ্ধাবিষিক্ত ৩ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + বৈশ্য কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান অম্বষ্ঠ
৪ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + শূদ্র কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান নিষাদ / পারশব
১ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + ব্রাহ্মণ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান সূত
২ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান ক্ষত্রিয়
৩ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + বৈশ্য কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান মাহিষ্য
৪ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + শূদ্র কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান উগ্র
১ ) বৈশ্য পুত্র + ব্রাহ্মণ্ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান বৈদেহক
২ ) বৈশ্য পুত্ৰ + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান মাগধ
৩ ) বৈশ্য পুত্র + বৈশ্য কন্যা -- উৎপন্ন সন্তান বৈশ্য
৪ ) বৈশ্য পুত্র + শূদ্ৰ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান করণ
১ ) শূদ্ৰ পুত্ৰ + ব্রাহ্মণ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান চন্ডাল
২ ) শূদ্র পুত্র + শূদ্র কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান শূদ্র
তাহলে আমরা পৃথিবীর সব থেকে আজব প্রজাতির নাম জানতে পারলাম। যে বর্ণসংঙ্কর ফলে উৎপাদন করা অবাঞ্ছিত প্রজাতি গুলি কি! এবং যত বেশি নিজ কুল ছেড়ে নীচু কুলে বিবাহ করবে ততবেশি পাপী হবে। এবং নরকে যাবে।¹
এবং এই প্রশ্ন ¹(গীতা 1/42) শেষ করে দেয়। সেখানে বলা [ যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং তার ফলে অবাঞ্ছিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুলর্মজনিত দোষে ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায় ] বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছে গীতা আরো পরিষ্কার এই 42 শ্লোক সংস্কৃত (জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বত) অনেক বলে না? {সনাতন) ধর্ম বলতে পুরাতন যা ছিল তাই থেকে যাবে! সেটা হলো জাতিভেদ সেখানে বলা হচ্ছে। জন্ম থেকে জাতি জন্ম থেকে বর্ণ জন্ম থেকে কর্ম আর এইসব যারা মানে না। তারা বিভিন্ন পাপযোনয়ঃ = জন্ম নিয়ে নীচকুল জাত হয়।
বৈশ্যাস্তথা = বলতে অনেকেই ( বৈশ্য ) এর কথা বলে। কিন্ত আসলেই কি তাই? আসলে না। ¹(গীতা 9/32) সেখানে [ বৈশ্যা ] বলতে আসলে হলো { বেশ্যা } এর উত্তর আপনি ¹(গীতা 18/41) ¹(গীতা 18/44) দুটির সংস্কৃত শ্লোক চেক করতে পারেন। যে সেখানে বৈশ্য শব্দ কেমন এসেছে। চাইলে আপনি শঙ্কর ভাষ্য চেক করতে পারেন। সেখানে বৈশ্য নয়। বেশ্যা আছে তাহলে পরিষ্কার হয়ে গেলাম বৈশ্য শব্দ নয় বেশ্যা আছে সেখানে।
শূদ্রাস্তেহপি = বলতে শূদ্র। সেখানে আর আলাদা আলাদা অনুবাদ আর দেখতে হবে না। সবাই এখানে আর গোজামিল করেনি। তাহলে পুরো শ্লোক এর অনুবাদ হবে এমন
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ |
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যাস্তি পরাং গতিম্ || ৩২
হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী,বৈশ্যা,শূদ্র আদি নীচকুল জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করবে।¹
তার মানে এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলতে চাইছে! যে যদি কৃষ্ণকে না মানে তাহলে ( বেশ্যা শূদ্র আদি নীচ জাত ) থাকবে। আশ্রয় করলে মুক্তি পাবে। কিন্ত শ্রীমদ্ভাগবত-পুরাণ কি বলছে। ¹(গীতা 9/32) কে ধরে।
³আভীরঙ্কা যবনাঃ খসাদয়ঃ |
যেহন্যে চ পাপ যদুপাশ্রয়াশ্রয়াঃ
শুদ্ধ্যন্তি তস্মৈ প্রভবিষ্ণবে নমঃ || ২৷৪৷১৮
কিরাত, হূণ, আন্ধ্র, পুলিন্দ, পুল্কস, আভীর, কঙ্ক, যবন ও খস প্রভৃতি নীচজাতিগণ ও অন্যান্য মহাপাপাসক্ত ব্যক্তিগণ যাঁর (ভগবানের) আশ্রিত ভক্তগণের শরণ গ্রহণ করলেই পবিত্র হয়ে যায় সেই সর্বশক্তিমান ভগবানকে বাব বাব প্রমাণ।
তাহলে এখানে যে সব নীচ জাতি সম্পর্কে জানতে পারলাম। সেখানে বলছে যে ভগবানের আশ্রিত ভক্তগণের শরণ গ্রহণ করলেই পবিত্র হয়ে যায়।
না করলেই সে ডাইরেক্ট নীচ মহাপাপী। এবং এখানেই শেষ নয়। সেই ভগবান আবার সর্বশক্তিমান তাহলে কেন এই জাত ব্যবস্থা জন্ম থেকে? এবং কোনো শূদ্র জ্ঞানী হলেও সে তার শূদ্র ধর্ম ত্যাগ করতে মানা করেছে। ¹(গীতা 3/35) ¹(গীতা 18/47'48) এখন যদি শূদ্র অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে বিদ্যাণ হয়ে! ধর্মীয় শাস্ত্রের ভুল এর সমালোচনা করে আর সেই ইশ্বর কি বলেছে তা আপনার চিন্তার বাইরে। ¹(গীতা 4/40) কি বলেছে।
অজ্ঞশ্বাশ্রদ্দধানশ্ব সংশয়াত্মা বিনশ্যতি |
নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্ননঃ || ৪০
অজ্ঞ ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনই ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না। সন্দিগ্ধ চিত্ত ব্যক্তি ইহলোকে সুখভোগ করতে পারে না এবং পরোলোকেও সুখভোগ করতে পারে না।
তার মানে কেউ শাস্ত্রের ভুল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে পারবে না ! যদি করে তাহলে ইহলোকে এবং পরোলোকে ভয়ঙ্কর দুঃখে থাকবে কোনো সুখে থাকবে না। এর মধ্যে যদি সেই ব্যক্তি ইহলোকে ইশ্বরের নিন্দা করে তাহলে তো খবর আছে।
³কর্ণৌ পিধায় নিরয়াদ্যদকল্প ঈশে
ধর্মাবিতর্যসৃণিভিরস্যমানে |
ছিন্দ্যাৎ প্রসহ্য রুশতীমসতীং প্রভুশ্চে-
জ্জিহ্বামসূনপি ততো বিসৃজেৎ স ধর্মঃ || ৪৷৪৷১৭
যদি যথেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা ধর্মরক্ষাকারী পূজনীয় প্রভুর নিন্দাবাদ করে তবে নিজের ক্ষমতায় তাদের দণ্ড দেওয়া সম্ভব না হলে কান বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যাবে, আর যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে বলপ্রয়োগে সেই অমঙ্গল - শব্দ - উচ্চারণকারীর জিহ্বাকে ছেদন করে ফেলবে। এই ধরনের পাপের প্রতিকারকল্পে নিজের প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করবে — এই - ই ধৰ্ম
হালে পরিষ্কার হলো গীতার ও ভাগবত পুরাণ এর অনুসন্ধান গীতার একটি শ্লোক ¹(9/32) এর মানে কত বড়ো এখন কি বলছেন। সেই সর্বশক্তিমান ইশ্বরের নিন্দা করলে ভক্তগণ আপনাকে জিহ্বাকে কেটে হত্যা করবে। তাহলে কেন স্ত্রী বেশ্যা শূদ্র ইশ্বরের দাসত্ব বহন করবে। এখানেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। যে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। আসা করি জানার কোনো শেষ থাকলো না। শুধু নিজেই রেফারেন্স চেক করে নেবেন বই থেকে....
রেফারেন্স :
1) শ্রীমদ্ভাগবদীতা যথাযথ- শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী / ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট
2) যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার- সুমিতা বসু ন্যায়তীর্থ / কলকাতা সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার ২০০৭
3) শ্রীমদ্ভাগবত-মহাপুরাণ- গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর