আরজ আলী মাতুব্বর: সত্যের অভিযাত্রী

জাহিদ রুদ্র


Dec. 3, 2024 | | views :812 | like:0 | share: 0 | comments :0

“বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই; জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন”

'প্রায় ৫০-৬০ হাজার বছর আগের নিয়ান্ডারথাল মানুষেরাই প্রথম প্রশ্ন তোলে জীবন-মৃত্যু নিয়ে? মানুষ কোত্থেকে আসে? বেঁচে থাকে কেন? মারা যায় কেন? শুধু মানুষ নয়। প্রকৃতিকে নিয়েও তারা প্রশ্ন করা শুরু করেছিল। নদী প্রবহমান কেন? বাতাস কি? পাহাড় এলো কোত্থেকে? সূর্য আলোকিত কেন? সহস্র বছর আগের অবিকশিত ও আদিম বুদ্ধি দিয়ে আদিম মানুষেরা ভেবে নিয়েছিল তাদের প্রতিটি সমস্যার সমাধান। প্রাণীজগতের সব প্রাণীই নিজেদের যেকোন সমস্যায় নিজ নিজ বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই আধুনিক যুগেও প্রাণীদের চোখে মটরগাড়ীগুলো শব্দকারক ও দূর্গন্ধযুক্ত একটি বিদঘুটে প্রাণী ছাড়া কিছুই নয়। একটি যন্ত্র সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণের জন্য আমরা প্রাণীদেরকে দোষ দিতে পারি না। কারণ যন্ত্রকে যন্ত্র মনে করার জন্য যে জ্ঞান, মেধা, মণীষা, অভিজ্ঞতা থাকা দরকার তা তাদের নেই। জীব জগতের কোটি বছরের ইতিহাসে মনুষ্যেতর প্রাণীগুলো কখনো যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেনি, বা করতে চায়নি। বানর, কয়েক প্রজাতির পাখি এবং অন্যান্য কয়েকটি মাত্র প্রাণী অবশ্য যন্ত্রের ব্যবহার করে। উঁচু ডাল থেকে ফল পাড়তে লাঠি, শত্রু তাড়াতে ঢিল, খাদ্য ভাঙতে পাথর ইত্যাদির ব্যবহার তারা করে থাকে। কিন্তু তাদের যন্ত্র সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা অতটুকু প্রাথমিক অবস্থাতেই থেকে গেছে। আর কোন অগ্রগতি হয়নি এবং তা সহজাত প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কারণ যন্ত্রের ঐ সীমিত ব্যবহারটুকুর বেশি তাদের প্রয়োজন হয়নি। তাই যন্ত্রের আবিষ্কার বা উৎকর্ষের জন্যও কোন রকম অভ্যন্তরস্থ আগ্রহ তারা বোধ করেনি। কিন্তু মানুষ মানবেতর নয়। ক্রমাগত নিজেকে পেরিয়ে যাওয়ার এক অদম্য আগ্রহ মানুষকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। ফলে মানুষ নিরন্তর তার পূর্বতন অনভিজ্ঞতা, অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদতা, সীমিত যান্ত্রিক শক্তি প্রভৃতিকে পরিত্যাগ করেছে এবং সাগ্রহে বরণ করেছে ভবিষ্যতের নতুনত্ব, জ্ঞান, আবিষ্কার, মনন। তাই অন্যান্য পশুদের জীবন যাত্রা এখনও আদিম যুগের ন্যায় থাকলেও মানুষের ক্ষেত্রে তা পাল্টে গেছে। মানুষ এগিয়ে এসেছে বর্তমানের কুসংস্কারহীন প্রযুক্তিময় পৃথিবীতে।'


দার্শনিকরা কখনও ফুরিযে যায় না; বরং সময় ও সমাজ তাঁদেরকে ধারণ করে। সময়ের সমান্তরালে তাঁরাও বহমান। একটা সমাজকে প্রগতিশীল হতে হলে দার্শনিক দরকার। দর্শন আসে জীবনবোধ থেকে, দর্শন আসে প্রশ্ন ও চিন্তার স্বাধীনতা থেকে। অথচ আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করতে জানে না, চিন্তা করতে জানে না। বাঙালির জীবন খুব সংকীর্ণ। কোনোভাবে পঞ্চাশটা বছর কাটাতে পারলে মৃত্যুর প্রহর গুনে তাঁর দিন কাটে। জীবনের বিকাশ ও জীবনবোধ তাঁর কাছে অনর্থক। লালনের মতো দার্শনিককে আমরা এখনও পাগল বানিয়ে রেখেছি। একটা সমাজকে কেবল লালনের গান দিয়ে সুচিন্তক বানানো সম্ভব। লালন বাংলার মাটিতে বেড়ে ওঠা মানুষ, এখানকার পরিবেশ ও জীবনের সাথে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আরবদের জীবনীর বদলে বাংলা বইয়ে লালনের জীবন পাঠ অনেক বেশি জরুরী ও প্রাসঙ্গিক। লালনের জীবন কোনো পয়গম্বরের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেই লালন আমাদের কাছে উপেক্ষিত। আমরা লালন দর্শনে চর্চা করি না।


আরজ আলী নামের একজন মানুষ এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন তা প্রথম জানতে পারি ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে। সত্যের সন্ধানে বইটা পড়ি পিডিএফ আকারে ঠিক তারিখ মনে নেই তবে সালটা ২০১৫-১৬ হবে। যেহেতু নামটা আগে শুনেছি তবে তাঁর বই পড়ার সুযোগ হয় নি। যদিও কলেজে পড়ার সময় হেগেল, কনফুসিয়াস, দেকার্ত, মার্কস, এঙ্গেলস, মাও, বার্ট্রান্ড রাসেল পড়েছি। সময় সুযোগে তাঁদের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জেনেছি এবং অভিভূত হয়েছি কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর পড়া হয়নি। সক্রেটিস বা প্লেটো বাঙালির খুব পরিচিত নাম। সক্রেটিস পড়ছিলাম ক্লাস টেনে ইংরেজি সাবজেক্টে একটা পাঠ ছিল, তখন।


বাট্রান্ড রাসেল খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, জাঁ-পল সার্ত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা নিজ দেশে অনেক সম্মান পেয়েছেন। দার্শনিক নিটশে বলেছেন, ‘ঈশ্বর মৃত’। কিন্তু নিটশে পড়ানো হয় পৃথিবীর সব দেশে। আরজ আলী মাতুব্বরকে একজন বিজ্ঞানী ও লৌকিক দার্শনিক অভিধায় ভূষিত করা হয়, তাঁর লেখা হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একদিকে বলা যায় তিনি যুক্তিবাদী দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী, আবার অন্যদিকে বলা যায় তিনি আধুনিক চার্বাকবাদী।


আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন। শুধু প্রশ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে কৌতুহল বা কোনোরকম প্রশ্নের উদয় হলে তিনি ‘বস্তুবাদ’ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করতেন। একটি প্রবাদ আছে "স্বশিক্ষিত লোক মাত্রেই সুশিক্ষিত।" সে হিসেবে 'স্বশিক্ষিত' আরজ আলী মাতুব্বর অবশ্যই একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আরজ আলী মাতুব্বর বিশ শতকের একজন অনন্য ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞানে আস্থাবান যুক্তিবাদী আরজ আলী বাঙালির মানসমুক্তির সহায়।


আমাদের সমাজ আরজ আলীকে ধারণ করে না। আরজ আলীকে নিয়ে চর্চা হয় না। দেশে হাতেগোনা কিছু মানুষই হয়ত আরজ আলী নামের সাথে পরিচিত। অথচ আরজ আলী সবার পাঠ্য হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মতো মুখস্ত থাকা উচিত আরজ আলীর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী। প্রসঙ্গক্রমে কেউ যদি আরজ আলীর জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে দু একটা লাইন লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে তবে তাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। নাস্তিক-আস্তিকের প্রশ্নে ভেসে যায় কমেন্টবক্স। এখানে চিন্তার স্বাধীনতা নেই, প্রশ্নের স্বাধীনতা নেই। ধর্ম নামক জাতাকলে পিষ্ঠ সবাই। সেসবের বিপরীতে আরজ আলী চিন্তা করার সাহস যেগায়, প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দেয়।


আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। আরজ আলীর রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দার্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। মানবকল্যাণ ও বিশ্বধর্ম আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান, পাঠাগার স্থাপন ও রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি নিজ দেহ ও চক্ষু মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। মাতুব্বর বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হকসহ অসংখ্য সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো।


তাঁর বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার কথা তিনি একাধিক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তার লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)। আরজ আলী মাতুব্বর তার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে। বইটি তাকে এলাকায় ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল।


তাঁর সত্যের সন্ধান গ্রন্থে আরজ আলী মাতুব্বর যে মৌলিক প্রশ্নগুলি উল্লেখ করে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে: ‘১. আমি কে? ২. প্রাণ কি অরূপ না স্বরূপ? ৩. মন ও প্রাণ কি এক? ৪. প্রাণের সহিত দেহের সম্পর্ক কি? ৫. প্রাণ চেনা যায় কি? ৬. আমি কি স্বাধীন? ৭. অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে? ৮. প্রাণ কিভাবে দেহে আসা যাওয়া করে?’..... ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রশ্নে আরজ আলী মাতুব্বর জিজ্ঞেস করেছেন ‘স্রষ্টা কি সৃষ্টি হইতে ভিন্ন?’ ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?’


কেবল দার্শনিক চিন্তায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ বোধের আর এক প্রকাশ ঘটেছে তার এরূপ কর্মে যে, তিনি জীবিত অবস্থাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানুষের হিতার্থে তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে উইলের মাধ্যমে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজকে দান করে গেছেন। প্রতি বছরই ১৫ই মার্চ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মদিন পালন করা হয়। এত বছর পরে আরজ আলীকে নিয়ে কেউ উৎসাহ দেখাবে তা হয়ত তিনিও ভাবতেন না। ঠিক এভাবেই আরজ আলী সময়ের সমান্তরালে বহমান। শত বা সহস্র বছর পরেও আরজ আলী আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবেন।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929