কলেজে শূদ্র ছাত্রদের প্রবেশাধিকার বিতর্কে বিদ্যাসাগর: একটি পর্যালোচনা
শিবাশিস বসু
Nov. 18, 2024 | | views :886 | like:0 | share: 0 | comments :0
আমরা দেখেছি, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনও বর্ণের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার ছিল না। অধ্যক্ষরূপে কর্মভার নেওয়ার পর বিদ্যাসাগর প্রথমে কায়স্থ এবং পরে যেকোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দু ছাত্রের প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করলেন সংস্কৃত কলেজে।
তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের এই বাস্তববাদী পদক্ষেপটির যথাযথ মুল্যায়ন না করেই একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করতে বসে যান যে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিদ্যাসাগর শূদ্রদের শিক্ষার বিরোধী ছিলেন! বিনয় ঘোষ সরাসরিভাবে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ না আনলেও মন্তব্য করেছেন, "এক্ষেত্রেও দেশাচারের কাছে তিনি নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।" এই প্রসঙ্গে একই রকম মন্তব্য করেছেন অলোক রায়ও - “কিন্তু সেকালের সামাজিক রীতিনীতি-সংস্কার সম্পুর্ণ অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয় নি।"
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ১৮৫১-৫৮ মোট সাত বছরের মতো অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এই সময় তিনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও তাদের তাৎপর্য বিশাল। সে সময়ে পাঁজি-পুঁথি দেখে অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকতো। বিদ্যাসাগর কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সচিবকে লিখলেন, তিথি মেনে নয়, সপ্তাহান্তে রবিবার দিন ছুটি থাকবে। কলেজে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হত না। ফলে ছাত্ররা যখন খুশি ভর্তি হত, আবার যখন খুশি ছেড়ে যেত। তাছাড়া কলেজে আসারও কোনও সময় নির্দিষ্ট ছিল না। বিদ্যাসাগর প্রথমে প্রবেশ দক্ষিণা দুই টাকা ও মাসিক বেতন এক টাকা নির্দিষ্ট করলেন। ছাত্র-শিক্ষক সকলের জন্য কলেজে আসার সময় - সাড়ে দশটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। উপস্থিতির হিসাব রাখবারও ব্যবস্থা হল।
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের যে আমূল সংস্কার করেন, কৃষ্ণকমল তাঁর 'পুরাতন প্রসঙ্গ' গ্রন্থে তার পরিচয় দিয়েছেন - ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনও বর্ণের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনি ব্যবস্থা করলেন, বর্ণনির্বিশেষে হিন্দু ছেলেমাত্রই কলেজে পড়তে পারবে। শিক্ষা সংসদের সচিব ডঃ মৌয়াটের চিঠির উত্তরে ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দের ২৮শে মার্চ তিনি লেখেন, "I see no objection to the admission of other castes than Brahmanas and Vaidyas or in other words, different orders of Shudras, to the Sanskrit College. But as a measure of expediency, I would suggest that at present Kayasthas only be admitted." এই যে দুই-পা এগোনোর জন্য এক-পা পিছিয়ে যাওয়া, এর কারণটিও বিদ্যাসাগর ব্যাখ্যা করলেন ওই চিঠির অষ্টম অনুচ্ছেদে, "The reason why I recommend the exclusion of the other orders of Shudras at present, is that they, as a body, are wanting in respectibility and stand lower in the scale of social considerations, their admission, therefore, would I fear, prejudice the interests of the Institution." একই কারণে ১৮৫৫ সালের ২১শে নভেম্বর তিনি সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের ছাত্রকে সংস্কৃত কলেজে পড়বার অনুমতি দেন নি, কারণ "Admission from that class will I am sure not only shock the prejudice of the orthodox Pandits of the Institution but materially injure to its popularity as well as respectability. Personally I have always been opposed to the exclusive system as will appear from my former reports to the late Council on the subject of admitting applicants if other castes than Brahmanas and Vaidyas, I would have been glad to admit the son of the memorialist" শেষ লাইনটার মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের মনোভাব ও অসহায়তা, বোধকরি দুটোই স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ নীতিগতভাবে শূদ্রদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার খুলে দেওয়ার তিনি সম্পুর্ণ সপক্ষে কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা করতে গেলে হিন্দু সমাজে প্রতিক্রিয়ার যে ঢেউ উঠবে তাতে শিক্ষা প্রসারের মুল প্রচেষ্টাটাই বানচাল হয়ে যাবে।
Causality, অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাপারটা আপনারা সবাই বোঝেন। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। কিন্তু কাজটা যেখানে হল, কারণটাকেও যে সেখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন তো কোনও কথা নেই, বরং প্রায়শই মনে হয় - হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে।
সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজ একই প্রাঙ্গনে অবস্থিত হলেও দুই বিদ্যায়তনের সামাজিক স্তরভেদ ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কয়েক যোজন তফাত। সংস্কৃত কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই ছিল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য এবং তুলনামুলকভাবে আর্থিক সঙ্গতিহীন। পক্ষান্তরে, হিন্দু কলেজে এবং মেডিকেল ছাত্ররা ছিল ধনী জমিদারদের সন্তান বা ইংরেজ আমলে আত্মপ্রকাশ করা নযা বেনিয়াদের সন্তান। হিন্দুকলেজ এবং সম্ভবত একই কারনে মেডিকেল কলেজেও জাতিভেদ ছিল না, "কুলকৌলিন্যের মানদণ্ড দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষাধিকার স্বীকৃত হত না।" এমনকি সংস্কৃত কলেজের রক্ষনশীল ধ্যানধারণার পণ্ডিতমশাইরা হিন্দু কলেজের পাশ্চাত্যভাবাপন্ন শিক্ষকদের সুনজরে দেখতেন না। অর্থাৎ পাশাপাশি অবস্থিত হলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুটি কলেজের পরিবেশে পঞ্চাশ বা একশো বছরের পার্থক্য ছিল।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আজ ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে একজন ব্রাহ্মণের ছেলে বা মেয়ে কোনো দলিতের মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করলে হয়তো প্রবল সমালোচনা হবে, হয়তো বা একঘরেও হতে পারে। কিন্তু একই কাজটা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান বা হরিয়ানাতে করলে অনার কিলিং হতে দেরি লাগবে না।
সতীদাহ রদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবার জন্য ১৮৩০ সালের ১৭ই জানুয়ারি কলিকাতায় যে ধর্মসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। কাজেই হিন্দু কলেজ বা মেডিকেল কলেজের ছাত্রশিক্ষকদের মাইন্ডসেট দিয়ে সংস্কৃত কলেজকে বোঝা যাবে না। ১৮৫১ সালে জাতিভেদের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি বিদ্যাসাগর শিক্ষাপরিষদের নজরে আনলে পরিষদ তাঁকে রিপোর্ট দিতে বলেন। ২০শে মার্চ বিদ্যাসাগর তাঁর রিপোর্ট দেন। "তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য, শূদ্রদের চেয়ে কোনও অংশে উচ্চস্তরের মানুষ নয়, অতএব সংস্কৃত কলেজে সব জাতির ছাত্রদের প্রবেশাধিকার না থাকবার কোনও কারণ থাকতে পারে না। তিনি এও অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে কলেজের পণ্ডিতরা প্রায় সবাই এই উদার সংস্কার বিধানের বিরোধী। পরিষদকে তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন যাতে প্রবেশাধিকার সম্বন্ধে কড়াকড়ি না করা হয় এবং শুরুতে অন্ততঃ কায়স্থ সন্তানদের ভর্তি করবার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে ধীরে ধীরে সমস্ত জাতিভেদগত নিষেধ দূর হতে পারে। কলেজের পণ্ডিতরা, যাঁরা বেশিরভাগই বিদ্যাসাগরের শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে লাগলেন। ... কলেজে সর্বজাতির ছাত্রদের প্রবেশাধিকার দিতে তিনি দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন এবং পণ্ডিতদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তাঁরাও যদি সমানে তাঁর বিরোধিতা করার প্রতিজ্ঞা করে থাকেন তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।" এই কথা অনেকেই বলেছেন যে, কায়স্থদের ভর্তি করবার সিদ্ধান্ত গৃহিত হতেই বেশ কয়েকজন অধ্যাপক লিখিত প্রতিবাদ করেন। বদরুদ্দীন উমর লিখছেব, "হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সকল বর্ণের ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তির প্রশ্ন যখন ওঠে তখন রক্ষণশীলরা ভয়ানকভাবে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতা এত প্রবল ছিল যে, ইচ্ছে সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকলের জন্য উন্মত্ত করার প্রস্তাব কতৃপক্ষের কাছে দিতে পারেন নি।" বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলালও বলেছেন, বিদ্যাসাগর শিক্ষা-সভায় আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে "কলেজের প্রধান প্রধান অধ্যাপকগণ ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন।"
ইতিহাস অচেতন এইসব তথাকথিত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের কে বোঝায় যে ভারতবর্ষের মতো ধর্মপ্রধান দেশে যেখানে রানী রাসমণি জাতে শুদ্র বলে মন্দির স্থাপন করার জন্যও হিন্দুদের কাছে জমি পান নি, এবং মন্দির তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করবার জন্য কোনো ব্রাহ্মণ পূজারী পাচ্ছিলেন না, সেখানে একই সময়ে বিদ্যাসাগর যদি শূদ্রদের পুরোপুরিভাবে জন্য সংস্কৃত কলেজের দরজাটা তখনই খুলে দিতেন, তা তো কার্যকর হতই না, এমনকি হয়তো সংস্কৃত কলেজটাই উঠে যেত ! এই প্রসঙ্গে পাঠকপাঠিকাদের মনে করিয়ে দিতে চাই ১৬ই আগস্ট, ১৯৯২ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী চুনি কোটালের আত্মহত্যার পর তাঁর জীবনসঙ্গী মন্মথ শবর পুলিশকে বলেছিলেন, "কী প্রবল উচ্চবর্ণীয় ঘৃণায় এক বাঙালী ব্রাহ্মণ অধ্যাপক চুনিকে প্রতি মুহূর্তে মনে করাতেন যে, স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াশোনার অধিকার কোনও লোধা মেয়ের থাকতে পারে না।" মনে করিয়ে দিতে চাই, কয়েকবছর আগেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সরস্বতী কারকেট্টার অবমাননার কথা। মনে করিয়ে দিতে চাই, অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মুর প্রতিদিনকার সংগ্রামের কথা। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে কেন তিনি সেই সময় শুধু কায়স্থদের ভর্তির সুপারিশ করেছিলেন তা তৎকালীন হিন্দু ধর্মের জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ির প্রাবল্য সম্পর্কে যাঁদের পরিস্কার ধারণা আছে, তাঁরাই বুঝতে পারবেন। ধীর প্রক্রিয়ায় সামাজিক বাধা কাটিয়ে সংস্কৃত কলেজে সকল জাতির ভর্তির ক্ষেত্রে কোনও আপত্তিই যে তাঁর ছিল না, চিঠিতে স্পষ্ট করেই তিনি তা ব্যক্ত করেছিলেন। এটাই বিদ্যাসাগরের প্রাজ্ঞতা। তিনি জানতেন সামাজিক বিপ্লব রাতারাতি হয় না - এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। তাই তিনি "১৮৫১, জুলাই মাসে প্রথমে কায়স্থ, পরে ১৮৫৪, ডিসেম্বর মাসে যে-কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দুকে সংস্কৃত কলেজে পড়ার অবাধ অনুমতি দিলেন।" এইভাবে সম্ভ্রান্ত ঘরের সমস্ত হিন্দু ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে পঠনপাঠনের অনুমতি দিয়ে বিদ্যাসাগর স্রেফ জাতিগত সংস্কারের বদ্ধ শিলাখণ্ডটিকে উৎপাটিত করে প্রগতির গাড়ির চাকাটা গড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পরবর্তী চালকদের আশায়। বলতে পারি অগ্রবর্তী যুগের পথ চলবার সোপান তৈরী করে গিয়েছিলেন তিনি। আমরা কি আজও তা পরিপূর্ণভাবে পেরেছি?
তথ্যসূত্র :
বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
উনিশ শতকে নবজাগরণ: স্বরূপ সন্ধান, অলোক রায়, অক্ষর প্রকাশনী
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, প্রকাশনা বিভাগ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, চিরায়ত প্রকাশন
বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন
রোহিত, চুনি এবং একলব্যেরা, সুমন দে, এবেলা.ইন
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স।