মহাভারতের গল্পের কি শেষ আছে? যেন পেঁয়াজের খোসা! প্রতিটি খোসার নিচে অপেক্ষা করছে নতুন গল্প, নতুন রহস্য। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে চমকপ্রদ সব উপাখ্যান। শকুনির কথাই ধরা যাক ! কৌরবদের সেই কুখ্যাত মামা - বাসুদেব কৃষ্ণের পর মহাভারতের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটন পটিয়সী ! যদি শকুনি না থাকতো, দুর্যোধনের প্ররোচিত হত না, আর কোন প্রকার প্ররোচনা ছাড়া কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধ
কি হতে পারতো?
এই শকুনিকে নিয়েও কিন্তু এক হৃদয় বিদারক কাহিনী আছে, যা শুনতে হলে ধীরে ধীরে সেই গল্পের গভীরে যেতে হবে। ফাঁকফোঁকরও চোখে পড়বে। শকুনির জীবন এক করুন উপাখ্যান। একটি রাজ্যের রাজপুত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত রাজ্যশাসন তার কখনোই করা হয়নি। আশ্রিত থেকেই তার জীবনের একটি বড় অংশ কেটে যাবে।
গান্ধারীর গল্প আমরা সবাই জানি—অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তার বিয়ে এবং শতপুত্রের জননী হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এর পেছনে যে আরও গভীর এক কাহিনী লুকিয়ে আছে ! গান্ধার, আজকের কান্দাহার, আফগানিস্তানের ছোট্ট রাজ্য, যেখানে রাজা সুবল শাসন করতেন। একদিন, পরাক্রমশালী রাজ্য হস্তিনাপুরের দেবব্রত ভীষ্ম এসে সুবলের কাছে তাঁর ভ্রাতৃষ্পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের জন্য গান্ধারীর বিয়ের প্রস্তাব দেন। সুবল মনে মনে অস্বীকৃত হলেও, ভীষ্মের শক্তি ও হস্তিনাপুরের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাধ্য হয়ে এই প্রস্তাবে রাজী হন। গান্ধারীকেও রাজী হতে হয়।
এরপর, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী সুখে বসবাস করতে থাকেন - গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। সেটা হলে আমাদের দ্বিতীয় গল্পে প্রবেশ করা হত না। গান্ধারীর রাশিফলে বলা ছিল যে তাঁর প্রথম স্বামী বিবাহের পরপরই মারা যাবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী এড়ানোর জন্য গান্ধারীর ছোটবেলায় একটি ছাগলের সঙ্গে তাঁর প্রতীকী বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছিল। এই ঘটনা জানাজানি হলে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন; তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করেন, যদিও তাঁর প্রতারিত বোধ করার বিশেষ কোন কারণ ছিল না। এমন ঘটনা কেবল প্রাচীন যুগে নয়, পঞ্চাশ বছর আগেও উপমহাদেশের অনেক স্থানে ঘটেছে। এই অবস্থায় ভীষ্ম কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না, এমন তো হতে পারে না ! এর পরে যা ঘটবে সেটাই আমাদের তৃতীয় গল্প।
তবে গল্পে ঢোকার আগে একটা কথা বলে নিতে হয়। যদি ভীষ্ম সেই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হত না ! যাই হোক, আসল ঘটনায় ফিরে আসি। ভীষ্ম, রাজা সুবল ও শকুনি সহ গান্ধারীর সব আত্মীয়কে হস্তিনাপুরে ডেকে আনেন। ক্ষমতাবান আত্মীয়ের এই আমন্ত্রণ এড়াতে পারলেন না রাজা সুবল, সবাই এলেন হস্তিনাপুরে। এরপরেই ঘটল ভয়ানক ঘটনাটা ! ভীষ্ম এদের সবাইকে সরাসরি কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন ! এদের মধ্যে রাজা সুবল এবং রাজকুমার শকুনিও ছিলেন।
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এইরকম নিষ্ঠুর একটা আদেশ কাযর্কর হবার আগে কিংবা পরে গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল, সেটা অবশ্য পরিষ্কার জানা যায় না। একটা সম্ভাবনা হতে পারে যে গান্ধারী এই ঘটনার কিছুই জানতেন না। যদি জানতেন, হয়তো সে সময় তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন। গান্ধারীর ছাগলের সঙ্গে বিয়ের গল্প এবং সেই ঘটনার গোপন রাখা—এটা দেখে ভীষ্মের ক্রুদ্ধ হবার সঙ্গত কোন কারণ নেই। ভীষ্ম আগেই জানতেন যে রাজা সুবল গান্ধারীর বিয়েতে রাজী ছিলেন না; বিশেষ করে শকুনির কাছ থেকে তিনি হয়ত বিপদের আশংকা করেছিলেন। আমার ধারণা, ভীষ্ম গান্ধার রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে হস্তিনাপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, এটি কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ ছিল না। বরং, এর মাধ্যমে তিনি এক রক্তাক্ত ভবিষ্যতের পটভূমি নির্মাণ করেছিলেন।
কুটুম্ব বাড়ির সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, এইটুকু মেনে নেওয়া গেলেও, পরবর্তীতে ভীষ্মের তরফ থেকে যে সিদ্ধান্ত এলো, সেটা রীতিমত নৃসংশ। ভীষ্ম কেন এইরকম একটা কাজ করতে গেলেন, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারাগারে গান্ধার থেকে যারা এসেছেন, তাদের একসাথে রাখা হত এবং সবার জন্য মাত্র এক মুষ্ঠি চাল বরাদ্দ দেয়া হত, যা দিয়ে কেবল একজন মানুষের উদরপূর্তি করা যেত। ফলস্বরূপ, একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল এক মুষ্ঠি চাল দিয়ে সবার পক্ষে জীবন ধারণ সম্ভব নয়, তাহলে অন্তত একজন বেঁচে থাকুক। শকুনিকেই সেই একজন হিসাবে নির্বাচিত করা হল, এবং শেষ পর্যন্ত শকুনিই বেঁচে রইলেন।
রাজা সুবল মারা যাবার আগে শকুনি বলে গেলেন, তাঁর অস্থি দিয়ে শকুনি যেন পাশা খেলার গুটি বানিয়ে নেয়, যে গুটি সবসময় শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে। এখন সুবলের অস্থি দিয়ে গুটি বানালেই যে সেই গুটি শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে, এই ব্যাপারটাকে যদি আমরা কষ্টকল্পনা বলেও বিবেচনা করি, এমন তো হতে পারে যে কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শকুনি আসলে এই পাশা খেলাটা এমনভাবে রপ্ত করছে যে অন্য কারো পক্ষেই তাকে হারানো নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল এবং আমার ধারণা, পাশা খেলার এই দক্ষতাটা সে তার পিতা রাজা সুবলের কাছ থেকেই শিখেছিল। রাজা সুবলের অস্থি দিয়ে পাশার গুটি বানানোর কথা বলে আসলে এই ব্যাপারটাকেই হয়ত বোঝানো হয়েছে।
এর পরের ঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা। গান্ধারী হস্তক্ষেপে শকুনি মুক্তি পেলেন, কিন্তু যে শকুনি মুক্তি পেলেন, তিনি আর সেই আগের শকুনি নেই। তিনি তাঁর পিতার, তাঁর পরিবারের, তাঁর বোনের অবমাননাকর পরিস্থিতির বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এই প্রতিজ্ঞা থেকে আমৃত্যু এক বিন্দু বিচ্যুত হননি। গান্ধারী কুরুবংশ ধ্বংসের জন্যে কৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিলেই, এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে শকুনির অবদানও খুব একটা কম ছিল না। পাশা খেলায় হারিয়ে পান্ডবদের বনবাসে পাঠানো থেকে শুরু করে, ভীমকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা থেকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যে যে ঘটনাগুলো কুরুবংশের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল, এই প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে শকুনির প্ররোচনা ছিল। দুর্যোধন শকুনির হাতের একটা পাপেট ছিল মাত্র।
তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে শকুনিকে আমরা সাধারণ পাঠকেরা এত অপছন্দ করি, সেই শকুনি কিন্তু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আগেই স্বর্গে পৌঁছে গেছিলেন। তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছিল, সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তাঁর গীতা শোনার প্রয়োজন হয়নি। তার মধ্যে অর্জুনের মত কোন ধর্মসঙ্কট ছিল না। তিনি তাঁর লক্ষ অর্জনে এতটাই অবিচল এবং আন্তরিক ছিলেন যে তাঁকে স্বর্গে ঠাই না দিয়ে ঈশ্বরের অন্য কোন উপায় ছিল না।