বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা - মিথ-মিথ্যার মিশেল

দেবোত্তম চক্রবর্তী


Nov. 20, 2024 | | views :875 | like:0 | share: 0 | comments :0

অলস, কল্পনাপ্রবণ বাঙালি যা জানে তা হল শিকাগোয় ১৮৯৩এ এক ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে বিবেকানন্দ ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স’ বলে ভাষণ শুরু করে পেয়েছিলেন জগৎজোড়া খ্যাতি। অথচ এর চাইতে হাস্যকর দাবি আর কিছুই হতে পারে না। বাঙালি সেই সম্মেলনে অন্য ভারতীয় বা বাঙালি প্রতিনিধিদের নাম জানে না, বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা পড়ে দেখার পরিশ্রম করে না এবং সমস্ত তথ্য যাচাই করে নেওয়ার সময় নষ্টও করে না।

 

শিকাগোতে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন বলে যেটি প্রচার করা হয় আদতে সেটি ছিল কলম্বাসের মৃত্যুর চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশ্বমেলা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় কুড়িটি সভা বা সম্মেলনের। অধ্যাপক নিমাইসাধন বসু ‘বিবেকানন্দ: প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন ধর্ম মহাসম্মেলন যে হচ্ছে এই সংবাদই অনেকে জানত না, এমনকি কলম্বিয়ান প্রদর্শনী দেখতে গিয়েও ধর্ম মহাসম্মেলনের কথা কেউ জানতে পারেনি। আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ ধর্ম মহাসম্মেলন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানত না বা শোনেনি।

 

১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসভার প্রথম দিনের অধিবেশনে অভ্যর্থনার উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন “সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর হইয়া আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি”। অর্থাৎ বহু ধর্মাবলম্বীদের দেশ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে নয়, হিন্দুধর্মের একজন হিসেবেই নিজেকে প্রচার করেছিলেন তিনি।

 

ওইদিন একই বক্তৃতায় স্বামীজী বলেন, “যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি”। কিন্তু এই সম্মেলনেই আমরা দেখতে পাই তিনি অবলীলাক্রমে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, বেদসমূহকে ‘অনাদি ও অনন্ত’ বলেছেন, এমনকি পূর্বজন্মের ওপরও আস্থা প্রদর্শন করেছেন। এই কি ‘সর্বধর্মসমন্বয়’-এর রূপ? 

 

প্রকৃতপক্ষে শিকাগো ধর্মসভার প্রথম বক্তৃতাটিতে স্বামী বিবেকানন্দ ঝড় তুলে দিয়েছিলেন বলে যে ধারণা আমাদের মধ্যে সুপ্রচলিত, তার অন্যতম ভিত্তি হল বিবেকানন্দ স্বয়ং এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রকাশিত বিবেকানন্দের জীবনী গ্রন্থগুলি। 

১৮৯৩ সালের ২ নভেম্বর আলাসিঙ্গা পেরুমলকে বিবেকানন্দ লেখেন, "মজুমদার বেশ বলিলেন, চক্রবর্তী আরও সুন্দর বলিলেন। খুব করতালিধ্বনি হইতে লাগিল। তাঁহারা সকলেই বক্তৃতা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন। আমি নির্বোধ, কিছুই প্রস্তুত করি নাই। দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করিয়া অগ্রসর হইলাম। ডক্টর ব্যারোজ আমার পরিচয় দিলেন। আমার গৈরিক বসনে শ্রোতৃবৃন্দের চিত্ত কিছু আকৃষ্ট হইয়াছিল, আমেরিকাবাসীদিগকে ধন্যবাদ দিয়া এবং আরও দু-এক কথা বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিলাম। যখন আমি ‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ বলিয়া সভাকে সম্বোধন করিলাম, তখন দুই মিনিট ধরিয়া এমন করতালিধ্বনি হইতে লাগিল যে, কানে যেন তালা ধরিয়া যায়। তারপর আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম; যখন আমার বলা শেষ হইল,তখন হৃদয়ের আবেগে একেবারে যেন অবশ হইয়া বসিয়া পড়িলাম" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পত্রাবলী, ৭৪ সংখ্যক পত্র, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৯)। সেই গ্রন্থগুলিতে আমরা এও পড়ি যে, ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স’ বলে তিনি বক্তৃতা শুরু করলে শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ও করতালিতে বিপুল অভিনন্দন জানায় বলে ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড’-এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। 

কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে শিকাগোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ Chicago Daily Tribune, Chicago Herald বা Chicago Inter Ocean-এ এমন কোনও কথা ছাপাই হয়নি। এমনকি আমেরিকার চারটি বিখ্যাত সংবাদপত্র New York Times, New York Herald, New York Daily Tribune ও Boston Evening Transcript-এ ১২ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে অনেক খবর থাকলেও বিবেকানন্দের নামও উল্লেখ করা হয়নি, বক্তৃতার লিপি তো দূরের কথা। 

১৮৯৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘দ্য নিউইয়র্ক হেরাল্ড’-এ ‘The doctrine of the Swami’ শীর্ষক বিবেকানন্দ সম্পর্কিত একমাত্র সংবাদেও এমন কিছু বলা হয়নি। শুধু আলাসিঙ্গা পেরুমলকে ভ্রান্ত তথ্য দিয়েই বিবেকানন্দ ক্ষান্ত হননি, সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ নিউইয়র্ক হেরাল্ড’-এর ‘কাল্পনিক’ ভূয়সী প্রশংসার সেই খবর ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৩ চিঠির আকারে ছাপেন এবং তারপর থেকেই শুরু হয় মিথ ও মিথ্যার এই সুপরিকল্পিত নির্মাণ।

লরেন যে লরেনকে চিনবে এতে আর প্রশ্ন কেন!

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929