ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সেকাল ও একাল
দ্বৈপায়ণ ঘোষ
Nov. 19, 2024 | | views :285 | like:0 | share: 0 | comments :0
Wildlife (Protection) Act, 1972 বা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ তর্কাতীত ভাবে এই পৃথিবীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণ আইন। এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ নামক ভৌগলিক ভূখণ্ডের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করলে প্রেক্ষিত বুঝতে খানিকটা সুবিধা হবে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, আর্যদের আগমন ইত্যাদির সময়ের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্য নিদর্শনে বন্যপ্রাণ ও গৃহপালিত প্রাণীদের সাথে মানুষের সম্পর্কের ও সহাবস্থানের প্রমাণ পাই। কিন্তু সেগুলোকে আইনের প্রামাণ্য দলিল বলা যায় না। আমরা প্রথম এই ধরণের নথিবদ্ধ আইন পাই মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়। এই সংরক্ষণের মূল কারণ অবশ্যই আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকেই ভারত ভূখণ্ডের একটা ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। সাথে সাথে তার সৈন্য বাহিনীও শক্তিশালী হতে থাকে। ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্রের সাথে সাথে এই সময় থেকে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার জনপ্রিয় হতে থাকে। হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই হাতিকে গৃহপালিত করার ব্যবস্থা চালু থাকলেও মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকেই যুদ্ধে হাতির ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর সেই বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তাই সাম্রাজ্যের জন্য হাতির নিরন্তর যোগান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এই যোগান অক্ষুণ্ণ রাখতেই অশোকের শাসনকালে হাতি ও হাতির জন্য সংরক্ষণের আইন প্রণীত হয়, যেখানে মৌর্য সাম্রাজ্যে আটটা সংরক্ষিত ও চিহ্নিত হস্তি-বন বা আধুনিক পরিভাষায় Elephant Sanctuaryর উল্লেখ ছিল। বন্য হাতির ক্ষতি করলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। এমনকি প্রাকৃতিক কারণে মৃত হাতিদের দাঁত সরকারের কাছে সমর্পণ করার আইনও ছিল, যা আধুনিক WPA, 1972 এরও বিধান। পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের কালে বন্যপ্রাণ নিয়ে মিশ্র সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। এই সময় শিকারকে বাদশাহি আদব কায়দার অংশ হিসেবে অনেক সময় প্রাধান্য দেওয়া হলেও বিশেষ বিশেষ সময় বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে শিকার নিষিদ্ধ করা হত।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথা ধরেই ব্রিটিশ ভারতের শুরুর থেকেই ব্রিটিশ ও দেশীয় শাসকদের মধ্যেও শিকার ছিল আভিজাত্যের আবশ্যিক প্রতীক। আজ ভারতের অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলই সেই সময়ের কোনো না কোনো দেশীয় শাসকের ব্যক্তিগত শিকার খেলার জায়গা, বান্ধবগড়ের জঙ্গল যেমন ছিল রেবার রাজপরিবারের শিকার ভূমি, গিরের জঙ্গল সেই রকমই জুনাগড়ের নবাবদের খেলার জায়গা। শিকার সেই সময় শাসক ও অভিজাতদের মধ্যে কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করে, তা বুঝতে আমাদের কয়েকটা তথ্যই যথেষ্ট। বিংশ শতকের গোরায় ভারতের জঙ্গলে আনুমানিক এক লাখ বাঘ ছিল, ১৯৭৩ সালে প্রজেক্ট টাইগার শুরু হওয়ার সময়ের গণনায় তা কমে দাঁড়িয়েছিল তিন হাজারের মত। শিকারের ব্যাপকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫, এই ৫০ বছরে শুধুমাত্র ভারতবর্ষে কম করে ৮০ হাজার বাঘ শিকার করা হয়। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ দশ দিনে ৩৯টি বাঘ শিকার করেন। কর্নেল জফ্রে নাইটিঙ্গল ভারতবর্ষে প্রায় ৩০০ বাঘ শিকার করেছিলেন। দেশীয় রাজ-পরিবারগুলোও বিদেশী শাসকদের থেকে এই প্রশ্নে পিছিয়ে ছিলনা। রেবার রাজা নিজে মধ্য ভারতে ১০৯টা বাঘ শিকারের নজির রেখেছেন। শুধু বাঘ নয়, শিকারের ফলে আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে শেষ টিকে থাকা সিংহের সংখ্যাও কমতে কমতে গিরের জঙ্গলে ২০টায় এসে দাঁড়ায়। সরকারি হিসেবে ১৮২০ থেকে ১৮৭০ এর মধ্যে গুজরাটে ১৫০০ এর বেশি সিংহ শিকার করা হয়। সেই অবস্থায় ভারতের শাসক ও অভিজাতদের একাংশ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তিত হয়। ১৮৭৯ সালের ১০ই মে জুনাগড়ের নবাব মহব্বত খানজি দ্বিতীয় গিরের জঙ্গলে সিংহের শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়, যা ছিল আধুনিক ভারতের প্রথম বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন। এর আগেও ১৮৫৫ সালের ভারীয় ফরেস্ট চার্টার, ১৮৬৫ সালের ভারতীয় বন আইন, ১৮৭৮ সালের ভারতীয় বন আইনও কখনোই সেই অর্থে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কথা বলা হয়নি। এরপর ১৯২৭ সালে ভারতীয় বন আইন প্রণীত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টায়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম বন-নীতি আসে। পর্যায়ক্রমে ১৯৭২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর পৃথিবীর সংরক্ষণের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইন, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ প্রণীত হয়। এই আইনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হল:
১) ভারতীয় সব রকম বন্যপ্রাণের শিকার ও তা নিয়ে ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়। এই ধরনের অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত হয়।
২) ভারতের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভাগ, সংরক্ষণের স্তর, সংজ্ঞা দেওয়া হয়।
ফলে ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের নতুন দিশা আসে, কয়েক'শ বছর ধরে ধ্বংস হতে থাকা ভারতের বন ও বন্যপ্রাণ আবার একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এর পরপর ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮৬ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভারতের সংরক্ষণকে আরো শক্তিশালী করে।
কিন্তু এই আইনগুলোর কথা বললেই সবটা বলা হয়না। আইনগুলোর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ঠিক যেখান থেকে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেখান থেকেই এই সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। সংরক্ষণ আইনগুলো Wildlife First নৈতিকতায় ভর করে তৈরি হওয়ায় তা ভারতের জঙ্গলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এখানের আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষের জীবন ও সংরক্ষণে তাদের ভূমিকাকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ের যে আইনের কথা আমরা শুরুতে আলোচনা করছিলাম, তাতেও বনবাসী উপজাতিদের সন্দেহজনক ও বন্যপ্রাণের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে করা হত। ব্রিটিশ ও স্বাধীন ভারতের আইনগুলোও সেই পরম্পরা মেনে বারবার সংরক্ষণের নামে বনবাসী উপজাতিদের তাদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং করেই চলেছে। বহু ক্ষেত্রেই উচ্ছেদ করা মানুষদের প্রাপ্য পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি। কখনো অভিজাতদের খেয়াল, কখনো পুঁজিবাদী দুনিয়ার মুনাফার লোভ পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণকে শত শত বছর ধরে ধ্বংস করে আসলেও আইনগুলো আদিবাসীদেরকে বারবার বন্যপ্রাণের ধ্বংসের জন্য দায়ী করে চলেছে। সংরক্ষণের নামে মানুষকে উচ্ছেদ করতে আইনগুলো যতটা আগ্রহী, ধ্বংসাত্মক উন্নয়নের হাত থেকে পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণকে রক্ষা করতে ততটা আগ্রহ দেখা যায়না।