সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে এসেছি জলের অপর নাম জীবন। কিন্ত আমরা এই জল নিয়েই এমন অনেক কিছু জানিনা যেগুলো আমাদের জেনে রাখা উচিৎ।
আমাদের শরীর কে নিরোগ সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাদ্যের সাথেই পরিস্রুত পানীয়জল এর প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী। এই পরিস্রুত পানীয়জল নিয়েই সামান্য আলোচনা করবো।
প্রথমেই আমাদের জেনে রাখা ভালো এই "পরিস্রুত পানীয়জল" এর নামে বাজারে যেসব বোতল ভর্তি মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করা হয় সেখানেই রয়েছে গপ্পো। কারন, এটি প্রায় ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ প্রতারণা। একমাত্র ঝরনার জল বা স্প্রিং ওয়াটার, যাতে নানান প্রাকৃতিক খনিজ লবন মিশে থাকে তাকেই বলে "মিনারেল ওয়াটার"। বিদেশে এই মিনারেল ওয়াটার বোতলে কোন পাহাড়ের কোন ঝরনার জল থেকে সংগৃহিত সেটা লেখা থাকে। কিন্ত দুর্নীতিতে প্রথম সারিতে থাকা আমাদের দেশ ভারতে এসব আশা করাই বৃথা। তাছাড়া বাজারজাত ১০/২০/৩০ টাকার পানীয়জল এর বোতলের জল কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেটা আমরা কতজন জানি? কিছুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যেখানে দেখেছিলাম, জনৈক ব্যাক্তি ২০ লিটারের জার এ সাধারণ কলের জল ছাঁকনির মধ্যে ছেঁকে ভর্তি করে বিক্রি করছিল আর সাধারণ কলের জলে যে কত প্রকার ব্যাকটেরিয়া আছে সেসব খোঁজ কতজন রাখেন। দুঃখ এটাই এইসব প্রতারণা দিনের পর দিন চলে আসছে কিন্তু প্রশাসনের নজরদারীর অভাবে এবং টাকার কুমির বনে বসে থাকা লোভী দের আন্ডারটেবিল ঘুষ দেওয়ার কারনে অনেক কিছুই ধামাচাপা পরে যায়।
তথ্য বলছে গোটা পৃথিবীর মতন মানব শরীরও ৭০ ভাগ অংশ জল দ্বারা পূর্ণ এবং শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ এই জলের ওপরে নির্ভরশীল। শরীর থেকে দূষিত Toxin ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ বের করতে জলের গুরুত্ব অনেক। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আজ প্রায় প্রতিটি পরিবারে নানান রোগ যার সংখ্যাগরিষ্ঠই কিন্ত জলবাহিত রোগ। জলের গুণ মাপা হয় প্রধানত তিন ভাবে। ১) Cluster Size, ২) pH Value, ৩) ORP Value। বর্তমানে এই দ্রুতগতির জীবনে আমাদের শরীরে এতোটাই Acid Base জমা হয়ে গেছে যে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ সঠিক অক্সিজেন ও পুষ্টি পাচ্ছে না। পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি শিশু যখন জন্মায় তখন থেকে শিশুটি যতদিন মায়ের দুধ পান করে ততদিন তার শরীরের pH থাকে 7.4 ( Neutral)। তারপর থকেই শুরু হয় নানান সমস্যা। "No Disease Can Survive in An Alkaline Body" এই তথ্য দেওয়ার জন্য " Dr. Otto Heinrich Warburg " কে ১৯৩১ সালে " Nobel " পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
যদি আপনি শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া স্টেশনের ভেতরের কলে জল পান করেছেন তাহলে নিশ্চই জানেন ঐ জলে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে যা আসলে পানীয়জল পারিস্কার করার জন্য ব্যবহৃত ক্লোরিন। ক্লোরিন যুক্ত পানীয়জল দীর্ঘসময় ধরে পান করাও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক লিটার পানীয়জলে আধ মিলিগ্রাম ক্লোরিন মিশিয়ে কমপক্ষে এক ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপরেই সেটা পানযোগ্য হয়। জলের সাথে ক্লোরিন বিক্রিয়া করে হাইপোক্লোরাইট অ্যাসিড ও হাইপোক্রোরাইট তৈরি করে। এই হাইপোক্লোরাইটই হল জীবাণুনাশক। বাজারে যে জিওলিন পাওয়া যায় তাতে থাকে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট। এক গ্লাস বা ২০০ মিলি.জলে ৩-৪ ফোঁটা জিওলিন মেশালেই চলে। ক্লোরিন কিন্ত সব ধরনের জলবাহিত জীবাণু কে ধ্বংস করতে পারে না এবং এটি দীর্ঘসময় ধরে শরীরে প্রবেশ করলে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রচন্ড গরমে রঙ্গিন ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিয়ে গলা ভেজাতে কে না চায় কিন্ত এই ঠান্ডা পানীয়ই কিন্ত বিপদ বাড়ায় অনেক। সাল ২০০৩ এ C.S.E. সংস্থা ল্যাবোরেটারি তে বেশ কয়েকটি রঙ্গিন পানীয়র পরীক্ষা করে জানিয়েছিল এতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত কীটনাশক ( Pesticides, Insecticides) রয়েছে যা শরীরে বড় ধরনের রোগ সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ক্লোপাইরিপস্, হেপ্টাক্লোর, লিনডেন ইত্যাদি।
এই রিপোর্ট সামনে আসার পরেও যে অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তার প্রমাণ ২০০৬ সালে ফের C.S.E. সারা দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি নামী কোল্ড ড্রিংক বা সফট ড্রিংক এর স্যাম্পেল নিয়ে পরীক্ষা করে জানায় এসবে কত পরিমাণে বিষাক্ত জিনিস রয়েছে।
জল যদি আপনি ফুটিয়ে খেতে পারেন সেটা সবচেয়ে ভালো। কমপক্ষে ২০ মিনিট জল ফুটিয়ে সেটা ভালোকরে ছেঁকে তারপর ঠান্ডা করে পান করুন। এড়িয়ে চলুন ফ্রিজ রাখা পানীয়জল বের করেই পান করা এবং বরফ শীতল জল একেবারেই পান করবেন না। চেষ্টা করুন পানীয়জল এর অপচয় বন্ধ করার। মনে রাখবেন এই পৃথিবীতেই এমন অনেক স্থান আছে যেখানে মানুষেরা সামান্য জলের জন্য হাহাকার করেন।