অমৃত আসলে কী?

Guitar K Kanungo


April 10, 2025 | | views :42 | like:0 | share: 0 | comments :0



পুরাণ বলছে, অমৃত এমন একটা বস্তু, যেটা পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠেছিলেন। একথার আরেকটা মানে হল—দেবতারা অমৃত পান করার আগে পর্যন্ত অমর ছিলেন না। পুরাণ আমাদের একথাও বলছে, একটা সময় পর্যন্ত দেব-দানবের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ হত এবং সেই যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক দেবতাই মারা যেতেন। দেবতাদের হাতে অনেক দানব আহত, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী হলেও, তাদের গুরু, শুক্রাচার্য্য, মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে তাদের বাঁচিয়ে তুলতেন। ফলত দেবতারা বেশ কিছুটা নিগ্রহের ভেতর দিয়েই যাচ্ছিলেন।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে, এদিকে আবার দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের উপর নেমে এলো দুর্বাসার অভিশাপ। অহংবোধে তাড়িত হয়ে, ইন্দ্র দুর্বাসার দেয়া উপহার অবজ্ঞা করার ফলে শ্রীহীন, তথা শক্তিহীন হয়ে পড়লেন। নিরুপায়, অসহায় দেবতারা এবার ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ভগবান বিষ্ণু সবই জানতেন। তিনি দেবতাদের সমুদ্র মন্থন করবার নির্দেশ দিলেন। বললেন—মন্থনের ফলে যে অমৃত উঠে আসবে, সে অমৃত পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠবেন। দানবেরা আর দেবতাদের সাথে পেরে উঠতে পারবে না।

সমুদ্র মন্থন কিভাবে হয়েছিল, সে গল্প আমরা মোটামুটি সবাই জানি, তবে মন্থনের দড়ি হিসাবে বাসুকি নাকি অনন্ত নাগ ব্যবহৃত হয়েছিল, এই নিয়ে পুরাণ সমূহে কিছুটা বিরোধ আছে। তবে মন্থনের শেষ পর্যায়ে যে অমৃত নিয়ে ধন্বন্তরি উঠে আসেন, সেটা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু নিজেও এই মন্থনকাজে অংশ নিয়েছিলেন। দেব-দানবের 'অমানুষিক' টানাটানির এক পর্যায়ে, মন্দার পর্বত ক্ষিরোদ সাগরের অভ্যন্তরে ডুবে যেতে থাকলে, ভগবান বিষ্ণু নিজে কুর্ম তথা কচ্ছপ অবতারে পর্বতের নিচে অবস্থান করে মন্দার পর্বতকে ধারণ করে থাকেন। অমৃতের পাশাপাশি, মন্থনের ফলে হলাহলও উঠে এসেছিল, যেটা পান করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেন।

এই মন্থনের ফলে দেবী লক্ষ্মী (এবং অপ্সরারা) সহ আরও বেশ কিছু সামগ্রী উঠে আসে। কামধেনু সুরভি, ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবা, কৌস্তুভ মণি ইত্যাদি সেসব সামগ্রীর অন্যতম। কিন্তু আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে, অমৃত হাতে যিনি উঠে আসেন, তাঁর নাম ধন্বন্তরি এবং পরবর্তীতে তিনি দেবতাদের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত হবেন। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, ভগবান বিষ্ণুর আদেশে মন্থন শুরু করবার আগে বিপুল পরিমাণ নানান প্রকারের লতাগুল্ম ইত্যাদি ক্ষিরোদ সাগরে ফেলা হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল মন্থন। এই লতা-গুল্ম ফেলে দেবার কথাটাও আমাদের বিশেষ করে মনে রাখতে হবে।

ঠিক এইখানে আমরা আরেকবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের আলোচনায় ফেরত যাব। শুরুতে আমরা বলেছি—দেব-দানবের যুদ্ধে নিহতদের, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। এই ক্ষমতাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের, তবে শুক্রাচার্য যে একজন সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকা ভেষজ চিকিৎসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মৃতদের বাঁচাতে না পারলেও, তিনি তাঁর আবিষ্কৃত কোন এক পাঁচন তথা ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে আহত দানবদের নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। রামায়ণে সুষেণ নামের এক বৈদ্যের পরামর্শে আমরা হনুমানকে গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী নামের ঔষধী গাছ আনতে ছুটতে দেখব।

যুদ্ধে আহতদের সরিয়ে তোলার জন্যে দেবতাদের এরকম একজন চিকিৎসক এবং একরকম একটা পাঁচনের প্রয়োজন ছিল। ধন্বন্তরি হলেন শুক্রাচার্যের দেবকুল সংস্করণ, আর অমৃত হল শুক্রাচার্যের আবিষ্কৃত পাঁচন। যে পদ্ধতিতে মন্থনের কথা বলা হয়েছে, যে পদ্ধতিতে অমৃত উঠে এসেছে—একটু মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ঠিক একই পদ্ধতিতে ভেষজ চিকিৎসকরা পাঁচন তৈরি করে থাকেন। তফাৎটা কেবল এই—দেবতারা যেখানে যে কাজটা ক্ষিরোদ সাগরে করে থাকেন, আজকালকার দিনের ভেষজ চিকিৎসকরা সেই কাজটা হামানদিস্তায় করে থাকেন। আনুষাঙ্গিক উপকরণ কিছুটা ভিন্ন, উপাদান এবং পদ্ধতি অনেকটাই একই রকম।

আরেকটা কথা—দেবী লক্ষ্মী, অপ্সরা এবং সুরভীর উঠে আসা—এসব পৌরাণিক বাগাড়ম্বর; এসবকে আমাদের এক পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, অমৃত নিয়ে দেবী লক্ষ্মীও উঠে আসতে পারতেন। তিনি পরবর্তীতে ভগবান বিষ্ণুর বক্ষলগ্না হবেন। অতএব, তাঁর সেই যোগ্যতা ছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঠিক সেইভাবে ঘটেনি। যে অমৃতের জন্য এতো আয়োজন, সেই অমৃত নিয়ে যিনি উঠে এসেছেন তিনি আর স্বয়ং ধন্বন্তরি—যিনি একজন চিকিৎসক। যদি অমৃত একবার পান করলেই সবাই অমর হয়ে যেত, তাহলে ধন্বন্তরির উঠে আসবার প্রয়োজন ছিল না। আসলে, মন্থনের নানান বর্ণনার মধ্যে অমৃত আসলে কী, তার ইঙ্গিত দেয়া আছে। আমাদের সেই ইঙ্গিতগুলিকে বুঝতে হবে।

তবে সব কথা শেষ হবার পরেও একটা কথা আছে। পুরাণ বলেছে, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র পেয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছ থেকে। যদি এই বিদ্যাকে আমরা ভেষজ বিদ্যা বলে ধরে নিই, তাহলে অবশ্য একটা প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকেই যায়। সমুদ্র মন্থন ছিল এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেবতারা মহাদেবের কাছে গেলেন না কেন এই বিশেষ জ্ঞানের জন্য? তাহলে তো সমুদ্র মন্থনের মত এক বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করার প্রয়োজন হতো না ! দেবতাদের রক্ষার্থে যিনি নীলকণ্ঠ হতে পারলেন, তিনি নিশ্চয়ই দেবতাদের কাউকে এই জ্ঞান খুব সহজেই শিখিয়ে দিতে পারতেন।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন—হনুমান গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনে শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দেননি। একই কাজ দেবতারাও করছেন।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929