গল্পের ফাঁকফোঁকর : যিনি রিপুকেই দমন করতে পারলেন না তিনি আবার মহর্ষি হলেন কি করে?
Guitar K Kanungo
Jan. 21, 2025 | | views :65 | like:8 | share: 0 | comments :0
দুর্বাসা মুনিকে চেনেন না, এমন পাঠক খুব কমই আছেন, বিশেষত তিনি যদি হিন্দুধর্মাবলম্বী হন। সীমাহীন ক্রোধ এবং যখন-তখন যাকে-তাকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত ছিলেন এই ঋষি। দেবতা-মানুষ, কেউই তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। এমনকি যিনি তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন, সেই বেচারা নারীটিও রক্ষা পাননি তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে মুনিঋষিদের সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, অনেকটা মহর্ষি বশিষ্টের মতো, দুর্বাসার ক্ষেত্রে উল্টোটাই হচ্ছে কেন? কেন তিনি নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ক্রোধের কারণেই কুখ্যাত হচ্ছেন? কেন এই বৈপরীত্য? অনেক ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভাবনা-চিন্তা না করেই দুর্বাসা অভিশাপ দিয়ে দিচ্ছেন এবং তা ফলে যাচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে?
কে ছিলেন এই দুর্বাসা? ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে, রুদ্র তথা শিবের অংশ থেকে দুর্বাসার জন্ম। একবার প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে শিবের একটি বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়। শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন, এতটাই ক্রুদ্ধ হন যে দেবতাগণের তো দূরের কথা, স্বয়ং পার্বতীও শিবের ধারে কাছে আসতে পারছিলেন না। পার্বতী বললেন, এইভাবে চলতে থাকলে শিবের সঙ্গে তাঁর ঘর করা সম্ভব হবে না। এদিকে পার্বতীকে ছাড়া শিবের এক মুহূর্তও চলছিল না। শিব ক্রোধ সংবরণ করলেন। ঠিক এই সময়, সপ্তর্ষিদের একজন মহর্ষি অত্রির পত্নী অনুসূয়া সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন। শিবের বরপ্রাপ্তির ফলস্বরূপ, তাঁর প্রশমিত ক্রোধের সবটুকু নিয়েই অনুসূয়ার গর্ভে জন্ম নিলেন উগ্রতপা ঋষি দুর্বাসা।
রুদ্রের অংশে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই দুর্বাসার এত ক্রোধ—এই যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রথমত, মহর্ষি অত্রি এবং তাঁর স্ত্রী অনুসূয়া হয়তো শিবের মতো একজন পুত্র চেয়েছিলেন, সেটা হতেই পারে, কিন্তু সেই পুত্র প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে জন্মাবে এবং ত্রিভুবনে ব্যাপক ঝামেলা করবে, এটা নিশ্চয়ই তাঁরা চাননি। দ্বিতীয়ত, শিব যদি সাধ্বী অনুসূয়ার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েই তাঁকে পুত্রপ্রাপ্তির বর দিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ সেই সন্তানের মধ্যে ভরে দেওয়া নিঃসন্দেহে সঠিক কাজ হয়নি। সমুদ্র মন্থনের পর যখন সমস্ত বিষ উঠে আসে, তখন তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ হন। একইভাবে, তিনি ক্রোধিত হতেই পারেন, কিন্তু সেই ক্রোধকে সংবরণ করার উপায় মহাদেবের অজানা ছিল, একথা বিশ্বাস করা কঠিন।
তাঁর এই ক্রোধের কারণে একজন মহাপ্রাণ তপস্বী হিসেবে যতটুকু সম্মান তাঁর পাওয়া উচিত ছিল, তা সবসময় যে তিনি পেয়েছেন, এমনটা বলা যাবে না। কোনো গৃহস্থের বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটলে সেই গৃহস্থ তাঁকে সম্মান দেখাতেন বটে, কিন্তু সেই সম্মান মূলত ভয় এবং আতঙ্ক থেকেই। তাঁর ক্রোধের পাশাপাশি উদ্ভট সব আবদার গৃহস্থের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিত। শাস্ত্রে যদি ব্রাহ্মণ বধের অনুমতি থাকত, তবে দুর্বাসা হয়তো অনেক আগেই খুন হয়ে যেতেন।
দুটো ঘটনার কথা বলি।
একবার তিনি মহারাজ কুন্তিভোজের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন এবং জানালেন, কিছুদিন সেখানে থাকবেন। তটস্থ কুন্তিভোজ হাত জোড় করে সম্মতি জানালেন। কিন্তু দুর্বাসা তো দুর্বাসাই; উপদ্রব না করলে তাঁর চলে না। তিনি কুন্তিভোজকে জানালেন যে যতদিন তাঁর প্রাসাদে থাকবেন, তাঁর আদর-আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কুন্তিভোজ ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার করলেন।
দুর্বাসার থাকার ব্যবস্থা করা হলো; কন্যা কুন্তীকে তাঁর সেবায় নিযুক্ত করা হলো। কুন্তী বুঝলেন, মহাবিপদ। দুর্বাসা গভীর রাতে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দলবল নিয়ে এটা-সেটা খেতে চাইছেন। দিন নেই, রাত নেই - এটা কর, ওটা কর ; এটা আন, ওটা আন। কুন্তী শেষ পর্যন্ত সবদিক সামলে দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন। এর ফলস্বরূপ, কুমারী অবস্থায় কুন্তীর গর্ভে এক সন্তানের জন্ম হয়, যে সন্তানকে জন্মের পরমুহূর্তেই ত্যাগ করতে হয়েছিল।
পরের ঘটনাটি স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়ের পরপরই কৃষ্ণ ও রুক্মিণী একদিন দুর্বাসার আশ্রমে উপস্থিত হন তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য। দুর্বাসা খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন। এক পর্যায়ে কৃষ্ণ-রুক্মিণী দুর্বাসাকে আমন্ত্রণ জানালেন দ্বারকায় আসার জন্য। দুর্বাসা রাজি হন, তবে শর্ত দেন যে কৃষ্ণ ও রুক্মিণীই তাঁর রথ টেনে নিয়ে যাবেন। আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছেন, তাই পিছিয়ে আসার উপায় নেই। কৃষ্ণকে বাধ্য হয়ে দুর্বাসার অন্যায় আবদারে রাজি হতে হয়।
দুর্বাসার ইচ্ছে অনুযায়ী, কৃষ্ণ ও রুক্মিণী রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রুক্মিণী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে কৃষ্ণ, রথ না থামিয়ে (পাছে দুর্বাসা অসন্তুষ্ট হন), পায়ের বুড়ো আঙুলের খোঁচায় মাটি ফুঁড়ে গঙ্গাকে বের করে আনেন। রাণী রুক্মিণী সেই জল পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। তবে জল পান করার আগে রুক্মিণী কেন দুর্বাসাকে সেই জল নিবেদন করেননি, এই কারণে দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হলেন এবং অভিশাপ দিলেন এই যুগলকে। সেই অভিশাপের ফলে রুক্মিণীকে অনেকটা সময় কৃষ্ণের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল।
এই অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে দুর্বাসা অনেক সময় দুষ্টুলোকেদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। এবার অবশ্য বাসুদেব কৃষ্ণ দুর্বাসাকে একটি শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেবেন।
পাণ্ডবদের বনবাস চলছে। দুর্যোধন দুর্বাসাকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালেন আতিথ্য গ্রহণের জন্য, কারণ দুর্বাসার প্রায় দশ হাজার শিষ্য ছিল, যারা সর্বদা তাঁর সঙ্গে যেত। পাণ্ডবরা নিজেরাই কুটির বানিয়ে বনের ফলফুল আর পশুপাখি ধরে কোনোমতে জীবনধারণ করছিলেন। তাদের পক্ষে দশ হাজার মানুষকে আপ্যায়িত করা সম্ভব ছিল না। দুর্যোধন এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিলেন, যাতে দুর্বাসার ক্রোধ পাণ্ডবদের ওপর পড়ে এবং অভিশাপ নেমে আসে।
দুর্বাসা সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে শিষ্যদের বিশাল বহর নিয়ে হাজির হলেন পাণ্ডবদের কুটিরে। দ্রৌপদীর কাছে একটি জাদুকরী পাত্র ছিল, যেখান থেকে যেকোনো সংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো যেত, তবে সেটি করা যেত দ্রৌপদীর খাদ্য গ্রহণের আগে পর্যন্ত। দুর্বাসা ঠিক সেই সময়ের পরে হাজির হয়েছেন, যখন দ্রৌপদী ইতিমধ্যেই খাওয়া শেষ করেছেন। দ্রৌপদী মহাবিপদে পড়লেন এবং প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ এসে দ্রৌপদীর সেই পাত্রের তলায় পড়ে থাকা একটি ভাতের কণা মুখে পুরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই স্নানরত দুর্বাসা এবং তাঁর শিষ্যদের সমস্ত ক্ষুধা মিটে গেল। তারা আর দ্রৌপদীর কুটিরের দিকে না এসে পালিয়ে গেলেন।