পুরু আর আলেকজান্ডার। মহাবীর আলেকজান্ডারের কথা কে না জানে? জানা পৃথিবীর অনেকটাই জয় করে ফেলেছিলেন এই যুবক। অনেকেই বলেন, হোমারের নায়ক একিলিসের ঐতিহাসিক সংস্করণ ছিলেন তিনি। অন্যদিকে, পুরু আমাদেরই একজন, পৌরব নামের এক রাজ্যের রাজা। এই প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যটি ঝিলাম ও চেনাব নদীদ্বয়ের মধ্যেভাগে অবস্থিত ছিল, যা আধুনিক পাঞ্জাব এবং বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত।
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সাথে বিতস্তার তীরে পুরুর প্রথম দেখা হয়। দেখা হয় বলতে, আসলে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয় লড়াই করবার জন্য। আলেকজান্ডার ভারতের কথা শুনেছেন; তিনি এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ভারত দখলে নিতে চান। রাজা পুরু তাঁর গতিপথ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে যান। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত দুর্দমনীয় গ্ৰীক বাহিনীর কাছে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান। পুরুকে গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে হাজির করা হয়।
এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, আলেকজান্ডার বয়সে তরুণ হলেও অত্যন্ত সুশিক্ষিত একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর পিতা মেসেডোনিয়ার রাজা ফিলিপ সেই সময়ের পৃথিবীর সবচাইতে শ্রেষ্ঠতম শিক্ষকের দ্বারা পুত্রের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মহাজ্ঞানীদের শিক্ষক নাম খ্যাত এরিস্টটল ছিলেন মহামতি আলেকজান্ডারের শিক্ষক। যাই হোক, পুরুকে তাঁর সামনে আনা হলে, আলেকজান্ডার পোরাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কীভাবে তিনি তার সাথে আচরণ করতে চান।
পুরু পরাজিত হলেও সগর্বে উত্তর দিয়েছিলেন, একজন রাজা আরেকজন রাজার সঙ্গে যে সৌজন্যতা এবং মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করে, তিনি আলেকজান্ডারের কাছ থেকে সেইরকম আচরণ প্রত্যাশা করেন। আলেকজান্ডার প্রতিপক্ষের এই জবাবে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর তাঁর সেই মুগ্ধতার মাত্রা এতটাই ছিল যে তিনি পুরুকে কেবল তাঁর নিজের রাজ্যই ফিরিয়ে দেননি, বরং বায়াস অবধি দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ভূমির অধিকারও দান করেছিলেন পুরুকে। পুরু খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ৩১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে মারা গিয়েছিলেন।
এই গল্প আমরা কম-বেশী সবাই শুনেছি। পুরুর বীরত্ব এবং আলেকজান্ডারের সৌজন্যে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যেও যে একটা ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে, সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারিনি। প্রথম কথা হল, এই ঘটনা যে আদৌ ঘটেছিল কিনা, সেটা কে লিখে গেছে? খুব সম্ভবত গ্রীকরাই লিখে গেছে। তারা কি পুরুকে মহিমান্বিত করার জন্যে এই ঘটনা লিখে রেখেছে? নিশ্চয়ই নয়; আমি নিশ্চিত, পুরুর এই উত্তর উপস্থিত আলেকজান্ডারের সহযোগীদের মধ্যে তীব্র হাসির উদ্রেক করেছিল। যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছিল, তখন তো আর 'জেনেভা কনভেনশিন' নামের কোনো কূটনৈতিক প্রবিধি প্রচলিত ছিল না! আলেকজান্ডার নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিলেন, আর ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই পুরু তার রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।
কিন্তু এই ঘটনার সবচাইতে বড় ফোঁকড়টির কথা এখনো বলা হয়নি। ধরে নিলাম, এই ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। পুরুকে সত্যিই গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে ধরে আনা হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে উল্লেখিত কথাবার্তাগুলো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যেহেতু পুরুকে তার রাজ্য আবারো ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে তাদের মধ্যে আরও কথাবার্তা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, পুরু এবং আলেকজান্ডার কোন ভাষাতে কথা বলছিলেন? আলেকজান্ডার প্রাচীন গ্ৰীক ভাষায় কথা বলতেন। অন্যদিকে, পুরু সংস্কৃত অথবা অন্য কোনো প্রাকৃত ভাষায় কথা বলতেন। আলেকজান্ডার সংস্কৃত জানতেন না, পুরু গ্ৰীক জানতেন না। তাহলে?
তাহলে কি সেখানে একজন দোভাষী উপস্থিত ছিলেন, যিনি দুটো ভাষায় জানতেন? যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তৎকালীন ভারতবর্ষের সঙ্গে অন্য সভ্যতাসমূহের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; নইলে একাধিক ভাষায় পারদর্শী অনুবাদকদের প্রয়োজন হত না।