বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে আমি বুঝি, মনকে বিজ্ঞান নির্ভর করে তোলার প্রয়োজনে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠা।
বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে, তাকে প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞানের কোনো একটি বা একাধিক শাখায় পান্ডিত্য থাকতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি তিনি যদি প্রথাগত শিক্ষায় বিশেষভাবে শিক্ষিত নাও হয়ে থাকেন, তাতেও তিনি বিজ্ঞানমনস্ক হবার ক্ষেত্রে অযোগ্য নন। বিজ্ঞানমনস্ক প্রথাগত শিক্ষা নির্ভর নয়।
কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং অর্জিত শিক্ষা তিনি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেন, তবে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যেতে পারে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানের এক বা একাধিক শাখায় প্রথাগত শিক্ষার এক বা একাধিক ডিগ্রি অর্জন করা সত্ত্বেও কেউ যদি, তার অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করেন, তবে তাকে কখনোই বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না। কাজেই বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে, কোনো ব্যক্তিকে প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অথবা প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষকতা করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
তাহলে কি বিজ্ঞানমনস্ক হবার ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষার কোনো গুরুত্বই নেই? অবশ্যই আছে। তবে তা উল্লেখিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্ধারিত মুল্যয়নে নম্বর প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে অর্জিত বিজ্ঞান শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের উপর। প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করলে, একজন ব্যক্তির বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার পথ সুগম হয়। অন্যদিকে নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিষয়টা অপেক্ষাকৃত কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত প্রত্যকে ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে নির্ধারিত বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। তিনি সেইটুকু শিক্ষার ভিত্তিতে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পারেন। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান বিষয় উচ্চশিক্ষা লাভ না করেও।
একজন ব্যক্তির বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে।
এই সকল পরিবেশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসী হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শৈশব থেকেই সেই সকল চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন। তখন তার বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। তার মানে এই নয় যে সেই ব্যক্তির পক্ষে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা অসম্ভব।
ভুলে গেলে চলবে না ইউরোপে রেনেসাঁ বা ভারতে নবজাগরণের পথিকৃৎ মহামানবেরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজেই বেড়ে উঠেছেন। সেই সমাজের মধ্যে থেকেই তাঁরা আমাদের প্রগতিশীলতার পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের লড়াই আজকের তুলনায় সহস্রগুণ কঠিন ছিল। তবুও মানব কল্যানে তাঁরা আমৃত্যু আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁরাই তো আমাদের প্রেরণা। তাঁরা যদি তীব্র প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন, তবে আজ এত অনুকুল পরিবেশে আমরা কেন নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার লড়াই, সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার লড়াইটা লড়তে পারবো না?
আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে হবে। বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে সেই শিক্ষা। ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের অর্জিত শিক্ষা অপরের মধ্যে। তবেই আমরা পারবো কুসংস্কার মুক্ত এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে। যেখানে মানুষ বাঁচবে 'মানুষ' হয়ে।