গল্পের ফাঁকফোঁকর: মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম।
Guitar K Kanungo
Dec. 19, 2024 | | views :287 | like:4 | share: 2 | comments :0
জৈবিকভাবে দেখতে গেলে মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম হওয়ার উপায় নেই। এমনকি যাদেরকে 'টেস্টটিউব' বেবি নামে ডাকা হয়, তাদেরও জন্ম হয় শেষ পর্যন্ত মাতৃজঠরেই। পৃথিবীতে অবতার কিংবা মেসাইয়াদের জন্মকে অলৌকিক করে তোলার একটা প্রবণতা প্রায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে, কিন্তু যীশু বলি আর কৃষ্ণ, এরা কেউই মাতৃজঠর এড়িয়ে জন্মাতে পারেননি।
কিন্তু পুরাণগুলিতে মাতৃজঠর এড়িয়ে সন্তান জন্ম দেবার বেশ কিছু ঘটনার কথা বলা আছে। এইসব গল্পের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত গল্পটি গ্রীক পুরাণে বলা হয়েছে—জ্ঞানের দেবী এথেনার জন্ম নিয়ে। এথেনা বারোজন অলিম্পিয়ান দেব-দেবীর মধ্যে অন্যতম এবং তিনি দেবরাজ জিউসের কন্যা। মজার ব্যাপার হলো, তিনি কোনো মাতৃজঠরে জন্মাননি। তিনি জিউসের মাথা ফেটে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেন এরকম হয়েছিল সেই গল্পটা বেশ মজার—এবার সেটা বলি; ফাঁকফোঁকরের আলোচনাটা একটু পরে হবে।
হেরা নয়, জিউসের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল মেটিস। দৈববাণী হয়েছিল মেটিসের গর্ভজাত সন্তানের হাতে জিউস ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। এই দৈববাণী শুনে জিউস ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ছল করে মেটিসকে আকারে ছোট হয়ে যেতে বললেন। মেটিস সেটা হতেই জিউস তাকে চট করে গিলে ফেললেন। কিন্তু গিলে ফেললে কী হবে, মেটিস সেই সময় গর্ভবতী ছিলেন। এদিকে মেটিসকে গিলে ফেলার পর থেকেই জিউসের প্রবল মাথাব্যথা হতে থাকল। এই মাথাব্যথা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আরেক অলিম্পিয়ান দেবতা হেফাস্টাস জিউসের মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করেন। সেই আঘাতের ফলে জিউসের মাথার খুলি ফেটে সেখান থেকে এথেনা বেরিয়ে আসেন—পূর্ণবয়স্ক অবস্থায়, কবচ-কুন্ডল পরে থাকা অবস্থায়।
গোটা ব্যাপারটাকে কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ব্যাখ্যা করা যায় যদি এই গোটা ব্যাপারটাকে একটি 'মেটাফর' হিসাবে দেখা যায়। এথেনার এইভাবে জন্মানোটা আসলে প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধির আবির্ভাবের প্রতীক। গ্রীকরা বোঝাতে চায়, প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধি আবশ্যিকভাবে মনসিজ, কোনো প্রকারের জৈবিক প্রজননের মাধ্যমে এর সৃষ্টি করা চলে না। এইটুকু না হয় মেনে নেওয়া গেল, ধরেই নিলাম এটা আসলে একটা মেটাফর; কিন্তু যখন বলা হয়, কামাতুর কোনো এক দেবতার বীর্যস্খলনের ফলে নির্গত বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হচ্ছে—সেটাকে কল্পবিজ্ঞান নাম দিয়ে, কিংবা সেটাকেও কোনো একটা মেটাফর হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এরকম ঘটনা হিন্দু এবং গ্রীক পুরাণে অজস্র পরিমাণেই আছে।
আচার্য দ্রোণের জন্মের কথাই ধরা যাক। একদিন মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গা নদীতে প্রাত্যহিক আচার সম্পন্ন করছিলেন। এমন সময় তিনি ঘৃতাচী নামের এক অপ্সরাকে দেখতে পান। অপ্সরারা যৌনাবেদনময়ী হয়ে থাকেন, তাঁদের শরীরে কাপড়চোপড়ও বিশেষ কিছু থাকে না, আর থাকলেও সেগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে সেগুলো থাকা না থাকা বিশেষ কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। ফলে মহর্ষি ভরদ্বাজ কামাতুর হয়ে পড়লেন। কামাতুর হয়ে পড়লেও তিনি একজন সাধক পুরুষ, একজন ঋষি; রিপুকে বশে রাখাই তাঁর কাজ। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তাঁর বীর্যস্খলন হয়ে গেছে এবং স্খলিত বীর্য গিয়ে পড়ল এক পাত্রে। কালক্রমে সেই পাত্রে এক শিশুর জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয়েছিল দ্রোণ। ইনি পরবর্তীতে দ্রোণাচার্য নামে খ্যাত হবেন।
একটি শিশু জন্মানোর জন্য অসংখ্য শুক্রাণুর পাশাপাশি কিছু ডিম্বাণুরও প্রয়োজন। সেই ডিম্বাণু কোথা থেকে এলো, একটা এম্ব্রায়ো কীভাবে সৃষ্টি হলো—যা কিনা পরবর্তীতে একটা পূর্ণ মানবশিশুতে রূপান্তরিত হয়—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মজার ব্যাপার হলো, এই রকম ঘটনা মহাভারতে কেবল দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয়; মহাভারতের যুযুধান কুরু-পাণ্ডবদের পিতামহী সত্যবতীর জন্মও খুব একটা কম রহস্যজনক নয়। সেই গল্পটা বলার আগে গ্রীক দেবী এথেনাকে ঘিরে এই রকম স্খলনজনিত ঘটনার কথা বলা আছে, সেটা আগে বলি, তারপর মৎসগন্ধার গল্পে ফিরব।
এথেনার কথা আগেই বলেছি—গ্রীকদের জ্ঞানের দেবী। সম্পর্ক স্থাপনে ইনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তিনি আগ্রহী না হলে অন্য দেবতারা আগ্রহী হবেন না, এমন তো কোনো কথা নেই। একদিন হেফাস্টাস এথেনাকে 'সেডিউস' করার চেষ্টা করেন। কাম নামের রিপুটা এথেনার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তিনি ছিটকে সরে যান হেফাস্টাসের কাছ থেকে। মহাভারতে ঋষি ভরদ্বাজের যে অবস্থা হয়েছিল, হেফাস্টাসের ক্ষেত্রেও তা হলো। কিন্তু স্খলিত বীর্য কোনো পাত্রে গিয়ে পড়ল না। গিয়ে পড়ল বসুন্ধরার গায়ে। গ্রীকরা ধরণীকে গাইয়া নামে জানে। হেফাস্টাসের বীর্য ধারণ করে গাইয়া গর্ভবতী হলেন। জন্ম হলো সন্তানের, যিনি কিনা পরবর্তীতে এথেন্সের রাজা হবেন, যে এথেন্স শহরটি এথেনার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল।
এবার মহাভারতের ঘটনায় ফেরা যাক। উপরিচর বসু নামের একজন খুব বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজার মৃগয়া করতে গেলেও সঙ্গে পত্নী, উপপত্নীদের নিয়ে যেতেন। কিন্তু উপরিচর বসু একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন না যেতেই স্ত্রী গিরিকার শারীরিক বিরহে খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। এরকম অবস্থায় অন্য সবার ক্ষেত্রে যা হয়, উপরিচর বসুর ক্ষেত্রেও তা হলো। তিনি তাঁর স্খলিত বীর্য একটি পাতায় মুড়িয়ে সেটাকে সেটি এক ঈগলকে দিয়ে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে তাঁর স্ত্রী গিরিকা সেটি ধারণ করে গর্ভধারণ করতে পারেন। ঈগলটি উড়ে যাবার সময় আরেকটি ঈগল দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে ঈগলটি যে বস্তুটা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা এক নদীতে গিয়ে পড়ে। একটি মাছ তাতে গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে একটা ছেলে এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। এই কন্যা সন্তানটিই মৎসগন্ধা, যার সঙ্গে পরবর্তীতে হস্তিনাপুরের মহারাজা শান্তনুর বিয়ে হয়েছিল।
শুরুতেই বলেছিলাম গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করব। কিন্তু এক মাটির পাত্রে দ্রোণাচার্যের জন্ম হওয়া, কিংবা জিউসের মাথা থেকে এথেনার এবং উরু থেকে ডায়োনিসাসের জন্ম হওয়া—এইসব পৌরাণিক গল্পের কোথায় কোথায় ফাঁকফোঁকর আছে, সেটা বোধ হয় আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিথ গল্প হলেও সেইসব গল্পে সময়ের ইতিহাস এবং ভাবনা ইত্যাদি মিশে থাকে। কল্পবিজ্ঞানের মতো যারা পুরাণ রচনা করেন, তারা আগামীকালকে বর্তমানে ধরতে চান। মহাভারতের ঘটনাগুলিতে বিবাহবহির্ভূত যৌনতার বিষয়টাই প্রধানত এসেছে।
ভরদ্বাজের কথাই ধরা যাক। অনেক দিন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পর গঙ্গাতীরে এক সুন্দরী রমণীকে দেখে তিনি কামাতুর হতেই পারেন, তিনি সেই নারীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে যেতেই পারেন। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে এইভাবে স্বীকার করে নিলে মহর্ষি ভরদ্বাজের মহত্ব বজায় থাকে না। তাই স্খলন, পাত্র এবং দ্রোণের জন্ম ইত্যাদি কল্পনা করতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যে নারীকে ঘৃতাচী নামে ডাকা হচ্ছে, তিনিই দ্রোণের সত্যিকারের জননী। কুন্তীর মতো কুমারী মাতা বলেই হয়তো সন্তান জন্মদানের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। মাতৃজঠর এড়িয়ে যে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায় না, সেটা প্রাচীন ভারতীয়রা ভালোই জানতেন।
তবে গ্রীকদের যৌনতা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা ভারতীয়দের মতো ততটা রক্ষণশীল ছিল না, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ছিল পুরো মাত্রাতেই। সেইজন্যেই জিউসের উদ্দাম, অনিয়ন্ত্রিত যৌনতা নিয়ে ঈর্ষাকাতর হতে দেখা যায় হেরাকে। তাতে অবশ্য জিউসকে দমিয়ে রাখা যায়নি; তিনি তাঁর কমর্কান্ড চালিয়ে গেছেন পুরোদমে। হেরার ক্রোধের শিকার হয়েছেন সেইসব নারী যারা জিউসের লালসার শিকার হয়েছেন। এই ব্যাপারটিকে নৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে, অবিচারই বলা চলে। মজার বিষয় হচ্ছে জিউস বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতা বজায় না রাখলেও হেরা কিন্তু সেই কাজটা করে গেছেন গভীর নিষ্ঠার সাথে; তিনি কখনোই বিবাহ বহির্ভুত কোন সম্পর্কে জড়াননি।