স্রোতের বিরুদ্ধে চলা বিস্মৃত এক বিশ্বমানব
রাহুল রায়
Nov. 21, 2024 | | views :977 | like:0 | share: 0 | comments :0
হিন্দুরা সমুদ্র অতিক্রম করতে পারবে না। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের সৌজন্যে দীর্ঘদিন সমুদ্র ভ্রমণের ওপর সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কারন বা ইতিহাস কী সেটা তৎকালীন সমাজপতিরাই বলতে পারেন। কিন্তু এর ফলে শুধু হিন্দুরা নয়, সমগ্র মানবজাতিরই বিশাল ক্ষতি হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কথা বাদ দিলে সুদীর্ঘকাল ভারতের বিশাল অংশের মানুষ সামাজিক কারণে সমুদ্র পেরোতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসনে এদেশে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য জ্ঞানধারার বিস্তারের মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রতি সমুদ্রের অন্যদিকের সভ্যতার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। একদিকে যুগের পর যুগ থেকে চলে আসা সামাজিক শোষণ যেমন তাঁদের প্রচলিত নিয়ম নীতির প্রতি বিতৃষ্ণ ও নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল তেমনি দেশের শাসকদের চোখ ধাঁধানো উন্নতি তাঁদের মন-মস্তিষ্ককে বিশাল ভাবে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এই উন্নতির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভাবে জানতে, নিজেদের চোখে দেখতে জানতে সমুদ্র পেরোতে হতো। বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তার ক্ষমতাই বা আর কত। অন্তহীন, উচ্ছল জলরাশির সমুদ্রের দিকে তখন নব্যশিক্ষিতের দল আর সামাজিক ভ্রূকুটিকে মাথায় নিয়ে অসহায় ভাবে দেখার চেয়ে বর্হিবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হিসাবে উৎসাহ ভরা চোখে দেখতে শুরু করল। অবশেষে সামাজিক বন্ধন, দীর্ঘদিনের সব সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে একদিন একজন সমুদ্রের ওপারের অংশের দিকে এগিয়ে চলল। পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে, আত্মীয়তা করতে সে এগিয়ে চলেছিল, পেছনে পড়ে রয়েছিল একদল কুপমণ্ডুপ ও তাঁদের তৈরী চরম বিরক্তিকর কিছু নিয়ম নীতি।
ব্রিস্টল, ব্রিটেনের একটি সুন্দর নগর। সেই নগরে গত ১৮৫ বছর ধরে প্রতিবছর একজন ভারতীয় মনীষীর স্মৃতিতে তৈরী মন্দিরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি সেখানে বাসরত প্রবাসী ভারতীয়রা করেন না। নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটি যথাযথ মর্যাদা সহকারে আয়োজন করা হয় এবং সেই শহরের মেয়র সহ গন্যমান্য ব্যক্তিরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ব্রিস্টল শহরে সেই মনীষীর নামে একটি রাস্তাও আছে। ১৯৩০ সনে এই মনীষী যখন ব্রিটেন এসে পৌঁছান তখন তাঁকে দেখতে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী ছাড়া ব্রিটেনে কোনো ভারতীয়র জন্য তা হয়নি। এমনকি ১৯৯৩ সনে আমেরিকার চিকাগো শহরে ধর্মসভার পর স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও সম্ভবতঃ সেরকম উন্মাদনা সৃষ্টি হয়নি। উল্লেখযোগ্য সেই ব্যক্তিই প্রথম ভারতীয় যিনি সমুদ্র পার করে বিদেশ গিয়েছিলেন। ১৮৩০ সনের ১৯ নভেম্বর, কলকাতা থেকে ‘ফবর্স’ জাহাজে চেপে তিনি ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। বাংলার নবজাগরণের জনক হিসাবে পরিচিত সেই মনীষী ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায়।
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। রামমোহন রায় ব্রিটেনে কিন্তু গিয়েছিলেন বিজয়ী হয়েই। তাঁকে নিয়ে সেখানকার মানুষের উন্মাদনার শেষ ছিল না। সতীদাহ নিয়ে বিরোধীতা এদেশে নতুন নয়, তৃতীয় শিখ গুরু অমর দাস থেকে শুরু করে উনিশ শতকের গোঁড়ায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এই তালিকা কিন্তু খুব একটা ছোটো নয়। কিন্তু সতী দাহ প্রথাকে আইন করে বন্ধ করার পেছনে রামমোহনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
মহিলাদের এই সামাজিক কুপ্রথা থেকে মুক্ত করার জন্য ব্রিটেনের কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে রামমোহনের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কারণটা অনুধাবন করা দুষ্কর নয়।
এই শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক কুপ্রথার থেকে এই মুক্তির সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাঙ্খিত মুক্তির মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। ১৮২০-২২ এর দিকে তখন ব্রিটেনে দেশে প্রচলিত দাসপ্রথা ও ভারতের সতীদাহ প্রথা বাতিল করার ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি সেদিন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে মারাত্মক রকম উৎসাহ দিয়েছিল। রামমোহন রায়ের ছবি ও সইয়ের তখন বিশাল কদর সর্বত্র। দোকানে দোকানে সেই ছবি ও সই লাগিয়ে রাখা হতো। তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজের অভিজাতরা দূর থাকতে পারেননি। ডিউক অফ সাসেক্স রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর একটি ছবি লাইব্রেরীতে লাগিয়ে রেখেছিলেন। পত্রিকার স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর আপোষহীন ভূমিকা দেশের বাইরেও তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে ১৮২৩ সনে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষ থেকে ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর শাসকদের এই হস্তক্ষেপ রামমোহন রায় মেনে নিতে পারেননি। তীব্র প্রতিবাদ করে ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে তিনি একটি ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। পরবর্তীতে সরকার তাঁর আবেদনে সাড়া না দিলে প্রতিবাদে তিনি তাঁর ফার্সী পত্রিকা ‘মিরাত-উল-আখবার’ বন্ধ করে দেন। সমসাময়িক যুগে ইংল্যাণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে এই ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও প্রেরণাদায়ক। ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলোতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে তাই সেই ভূমিকার কথা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল।
জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্বমানবতার তর্ক নতুন নয়। একদলের যুক্তি যেখানে আগে ঘর তো পরে পর, অন্যদলের যুক্তি সেখানে পাশের ঘরে আগুন লাগলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিজের ঘরও বেশিসময় বাঁচানো যায় না। রামমোহন রায় দ্বিতীয় দলের লোক ছিলেন। কখনোই নিজেকে জাতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাননি। অস্ট্রিয় সেনারা পরাধীনতা বরণ করতে বাধ্য হলে ব্যথিত রামমোহন রায় সাংবাদিক বন্ধু বাকিংহামকে জানান যে ‘I am afraid I must be under the necessity of denying myself the pleasure of your society this evening; more specially as my mind depressed by the late news from Europe. I consider the cause of Neapolitans as my own and their enemies as ours. Enemies to liberty and friends of despotism have never been and never will be ultimately successful’। আবার স্পেনের স্বেচ্ছাচার থেকে দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর মুক্তি তাঁকে উৎফুল্ল করে তুলেছিল। সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে ইউরোপীয় বন্ধুদের নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডে নির্বাচনে শ্রমিক দলের জয়লাভ বা ফ্রান্সে উদারপন্থীরা ক্ষমতা দখল তাঁকে উৎসাহী করে তুলতো। বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স নিয়ে তাঁর অনুভূতি সবসময় ছিল বিশেষ। ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্স যেতে উদ্যোগীও হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা, উদারবাদের দেশ ফ্রান্সে যেতে পাসপোর্ট লাগে শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি কোনোমতেই স্বাধীনতার সেই দেশে কারোর অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবেন না। ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে চিঠি লিখলেন ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রীকে, ‘All mankind are one great family of which numerous nations and tribes existing are only various branches’। চিঠি পৌঁছায় ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের কাছে। রাজা সাদরের আমন্ত্রণ জানান আরেক রাজাকে। সেই ঘটনার সাত বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৪ সন থেকেই রামমোহন রায় সেই দেশের এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ফ্রান্সবাসীরা রামমোহন রায়কে সাদরে গ্রহণ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইউরোপের এই সুসভ্য দেশটির সঙ্গে রামমোহন রায়ের সুমধুর আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। ইউরোপে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেই সময়ে স্পেনের নতুন প্রণীত সংবিধানটি রামমোহন রায়কে উৎসর্গ করা হয়।
এই বছর রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের ২৫০ বছর পালন করা হচ্ছে। বলতে বাধা নেই রামমোহন রায়কে ভারতীয় নবজাগরণের জনক বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। নিজের সময়ের তুলনায় শতাধিক বছর আধুনিক চিন্তার এই মানুষটি একটি আধুনিক ভারতীয় তথা মানব সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। অবিচার, অনাচার, অত্যাচার মুক্ত একটি সমাজ।
ধর্মীয় অনাচার সহ্য করতে না পেরে পৃথক ধর্মের চিন্তা করলেন, জন্ম হয় ‘ব্রাহ্মসমাজের’, সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে নেমেছিলেন।
ভবিষ্যত সমাজের উদারীকরণে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনীকরণের গুরুত্ব বুঝতে পেরে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ্চাত্য শিক্ষার আমদানীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আধুনিক যুগে অনেকের কাছেই তাঁর ব্রিটিশের সাহচর্য দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সেই জায়গা থেকে ধারণা তৈরী করার আগে সেই সময়টাকে ভাবতে হবে। এবং পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রামমোহন রায় ব্রিটিশের তৈরী নীতির প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিলেন। সেই মানুষটিও আজ আমাদের সমাজে প্রায় বিস্মৃত। কেন্দ্র বা তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবাংলা সহ কোনো রাজ্য সরকারই তাঁর জন্মের ২৫০-তম বর্ষ পালনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে করার কারণও নেই। আজকে যারা ধর্মের নামে, জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে রাজনীতি করে তাঁদের কাছে রামমোহন রায়ের মতো মনীষীদের যে গুরুত্ব থাকবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। এই মানুষটি যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই সমাজে এরকম রাজনীতি যে খুবই অচল। তারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার্থে সমাজকে রামমোহন রায়ের প্রদর্শিত পথের ঠিক বিপরীতে নিয়ে যেতে চায়। এবার মানুষ তথা সমাজকেই ঠিক করতে হবে যে তাঁরা কোন পথের পথিক হবেন।
রাহুল রায়
স্বামীজী রোড, শিলচর