অভিশাপ ও যৌনতা: রামায়ণ-মহাভারতের বয়ান।
Guitar K Kanungo
March 24, 2025 | | views :45 | like:11 | share: 0 | comments :0
রামায়ণ
বলি আর মহাভারত, এই
দুই মহাকাব্যে অভিশাপ একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
কারণে অকারণে অভিশাপ নেমে এসেছে, এবং
কিছু ঋষির ভাবখানা এমন
যে তারা যেন কেবল
অভিশাপ দেওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে আছেন। দুর্বাসা
এঁদেরই একজন। কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে অভিশাপ দেয়ার ক্ষেত্রে একে রামে রক্ষা
নেই সুগ্ৰীৱ দোসর অবস্থা। ব্যাস
এই কাজের জন্যে কেবল দুর্বাসাকেই নয়
, বিশ্বামিত্র, দধিচী এবং নারদের মত
ঋষিকে একজায়গায় জড়ো করে ফেলেছেন।
কখনো কখনো সেইসব অভিশাপ
একেবারেই অযৌক্তিক। কিন্তু অযৌক্তিক হলেও সে অভিশাপগুলো
ফলে যাচ্ছে, এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
অবধারিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেই অভিশাপের ফল
হিসেবে।
কুরু-পাণ্ডবদের আদি পুরুষ যযাতির
কথাই ধরা যাক। স্ত্রী
দেবযানীর দাসী হয়ে আসা
রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন
করতে গিয়ে যযাতি শ্বশুর
শুক্রাচার্যের কাছ থেকে অভিশাপ
কুড়োলেন। সেই অভিশাপ যে
অসামানুপাতিক, সেকথা বলার সুযোগ খুব
একটা নেই। অভিশপ্ত হয়ে
যযাতি জরাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন—অর্থাৎ,
যে রিপুর তাড়নায় তিনি পরকীয়া প্রেমের
মতো দুষ্কর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন, সেই রিপুকে অবদমন
করার একটি সুযোগ পেলেন।
কিন্তু যযাতি কামুক পুরুষ; তিনি শুক্রাচার্যের হাতে
পায়ে ধরে সেই অভিশাপ
এড়িয়ে যাবার উপায় বার করলেন।
তারপর শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত সন্তান পুরুর সঙ্গে তিনি জরা বদল
করে সকাম প্রেমের নৈমিত্তিক
আয়োজনে মত্ত রইলেন। যেহেতু
তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে
কেবল পুরুই তাঁর জরা গ্রহণ
করতে রাজি হয়েছিলেন, সেহেতু
যযাতি এই পুরুকেই সমস্ত
রাজ্য দিয়ে গেলেন। এই
পুরুই ছিলেন কুরু-পাণ্ডবদের আদি
পুরুষ।
এই অভিশাপ দিয়ে শুক্রাচার্য কার্যত
তাঁর আত্মজা দেবযানীর গর্ভজাত সন্তানদের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়া থেকে
বঞ্চিত করলেন। অবশ্য দেবযানীর জন্যে একটি সান্তনা পুরস্কার
ছিল। উত্তরকালে তাঁর পুত্র যদুর
বংশে ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার বাসুদেব কৃষ্ণ জন্ম নেবেন। কথা
হচ্ছে, এই ব্যাপারগুলো প্রকৃতির
স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই ঘটতে
পারত। পুরুর জায়গায় যদু রাজা হলেই
যে কুরুবংশের স্থাপনা হত না, এমন
ভাবার সঙ্গত কোনো কারণ নেই।
পুরুর মাতুল বৃষপর্ব ছিলেন অসুরদের রাজা। বেশ ক্ষমতাবান নৃপতি—এতটাই ক্ষমতাবান যে স্বয়ং শুক্রাচার্য
তাঁর সভায় প্রধান পুরোহিতের
দায়িত্ব পালন করতেন। সেই
মাতুলের সহায়তায় পুরু আরেকটি রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করতেই পারতেন। কিন্তু সেটা হলো না;
গোটা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার
জন্যে সেখানে একটি পরকীয়া প্রেম
এবং একটি অভিশাপের অনুপ্রবেশ
ঘটানো হলো।
লঙ্কেশ
রাবণও এরকম একটি অভিশাপের
শিকার হয়েছিলেন। সেই অভিশাপও যৌনতা
সংক্রান্তই। মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, লঙ্কেশ রাবণ ধর্ষকামী ছিলেন।
সুন্দরী নারী দেখলেই তিনি
কামাতুর হয়ে পড়তেন এবং
সেই নারীদের ধর্ষণ করতে উদ্যত হতেন।
ধর্ষকামিতা এক ধরনের সেক্সুয়াল
ডেভিয়েশন তথা যৌন বিচ্যুতি;
এটি সহজাত নয়। কেন তিনি
এমন ছিলেন, এই নিয়ে বাল্মীকি
আমাদের কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
মায়ের কারণে তাঁর মধ্যে রাক্ষস
প্রবৃত্তি ছিল বলেই কি?
কিন্তু মহর্ষি বাল্মীকি বৈদেহী সীতাকে অলঙ্ঘনীয় করে তোলার জন্যে
আমাদের একটি গল্প শুনিয়েছেন।
যদিও সেই গল্পের মধ্যে
বিস্তর ফাঁকফোকর আছে, তবুও সেই
গল্পটা বলা যাক।
একদিন
বেদবতী নামের এক অসামান্য সুন্দরী
নারীর সঙ্গে রাবণের দেখা হয়ে যায়।
স্বভাবগত কারণেই রাবণ তার উপর
জোরপূর্বক উপগত হতে চাইলেন।
এদিকে কুশধ্বজ ঋষির কন্যা বেদবতী
ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। বেদবতী তাঁকে পাবার জন্যেই তপস্যা করছিলেন। তিনি রাবণকে প্রতিরোধ
করতে চাইলেন, কিন্তু রাবণ কিছু শুনতে
নারাজ। বেদবতী বাধ্য হয়ে নিজেকে আগুনে
বিলীন করে দিলেন, কিন্তু
বিলীন হয়ে যাবার আগে
তিনি রাবণকে এই বলে অভিশাপ
দিলেন—রাবণ যদি কোনো
নারীর সঙ্গে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন তবে তার
মৃত্যু হবে। শুধু তাই
নয়, বেদবতী আরও বললেন, তিনি
আবার জন্মাবেন এবং রাবণের মৃত্যুর
কারণ হয়েই জন্মাবেন। এই
বেদবতীই পরবর্তীতে সীতা হয়ে জন্মেছিলেন।
বেদবতীতে
উপগত হওয়ার আগ্রহ রাবণ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু
সীতাকে অপহরণের কারণ যৌনতা নয়।
প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই এই অপহরণ। অপহরণ
করতে গিয়েই রাবণ বুঝতে পারলেন,
সীতাও অসামান্য সুন্দরী বটে। বাল্মীকি আমাদের
জানাচ্ছেন, লংকায় নিয়ে আসার পর
সীতাকে পাবার জন্যে রাবণ অস্থির হয়ে
উঠেছিলেন। আগের জন্মের বেদবতিই
যে সীতা, সেটা হয়তো রাবণের
জানা ছিল না, কিন্তু
রাবণ বেদবতীর অভিশাপের কথা ভুলে যাননি।
তিনি চাইছিলেন, সীতা নিজে থেকেই
তাঁর সঙ্গে রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করুক। বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, সেই ইচ্ছা সীতার
কখনোই হয়নি। কেন হয়নি, সেটাও
ভেবে দেখার মতো। কেন ভেবে
দেখার মতো, সেটা বোঝার
জন্যে আমাদের দ্রৌপদী এবং কীচককে নিয়ে
ভারতবর্ষের এক প্রখ্যাত নাট্যকারের
নাটকটি দেখে আসতে হবে।
নাটকটির নাম আমার এই
মুহূর্তে মনে নেই; বিষয়বস্তুটা
তুলে ধরছি।
মহাভারতে
দ্রৌপদী বিরাট রাজার আশ্রয়ে থাকার সময়ে এরকম একটি
পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিরাটরাজের শ্যালক কীচক দ্রৌপদীকে কামনা
করছিলেন। ব্যাস আমাদেরকে বলেছেন, এইরকম অশ্লীল প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে দ্রৌপদী ভীমকে
দিয়ে কীচককে বধ করিয়েছিলেন। কিন্তু
ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ কারনাড (খুব সম্ভবত) তাঁর
একটি নাটকে দেখিয়েছেন, দ্রৌপদী কীচকের এই প্রস্তাবে সানন্দে
সাড়া দিয়েছিলেন। দ্রৌপদী সারা জীবন নিজেকে
বঞ্চিতই ভেবে এসেছিলেন। যে
অর্জুনকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে
ভালোবেসেছিলেন, সেই অর্জুন যখন
বিভিন্ন নারীর সঙ্গে একের পর এক
সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সেখানে তিনি পুরোটা সময়
অর্জুনের অন্য ভাইদের যৌন
লালসা মেটানোর অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে গেছেন। শারীরিক
চাহিদা দ্রৌপদীরও ছিল; কীচক দ্রৌপদীকে
সে চাহিদা মেটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
আসল
কথা হচ্ছে, যৌনতাকে এভাবেও দেখা যায়। কিন্তু
সীতাকে নিয়ে সেই ঝুঁকি
বাল্মীকি নিতে পারেননি। শুধু
বাল্মীকি কেন, কোনো কোনো
লেখক দ্রৌপদীকে কীচকের সঙ্গে মিলনের জন্যে অভিসারে পাঠাতে উৎসাহ দেখালেও, সীতাকে নিয়ে রামায়ণের মূল
কাহিনীর বাইরে গিয়ে কিছু ভাববার
সাহস দেখাতে পারেননি। ব্যাস কর্ণকে দিয়ে দ্রৌপদীকে বেশ্যা
পর্যন্ত বলিয়েছেন। দ্রৌপদী মহাভারতের প্রধানতম নায়িকা হলেও দ্রৌপদীকে অন্যপূর্বা
করে তোলার কোনো ইচ্ছে তাঁর
ছিল না, যেটা সীতাকে
নিয়ে বাল্মীকির ছিল। রাবণের সঙ্গে
মিলিত হলে সীতা অসতী
হয়ে উঠবেন এবং সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায়
উত্তীর্ণ ঘোষণা করা যাবে না।
যদিও বাল্মীকির সেই চেষ্টা শেষ
পর্যন্ত সফল করতে পারেননি।
অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সীতার সতীত্ব
নিয়ে সন্দেহ থেকেই গিয়েছিল। রাম নিজ মুখে
সে কথা স্বীকার না
করলেও রামের হৃদয়ে প্রবেশ করলে আমরা সেখানে
এই সন্দেহের বীজটিকে উপ্ত অবস্থায় দেখতে
পেতাম।
একথা
ঠিক যে, সময় বাল্মীকি
এবং ব্যাস মহাকাব্য লিখছেন, তখন সিগমুন্ড ফ্রয়েড
জন্মাননি। যৌনতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে
কিছুটা অস্বস্তি, অস্পষ্টতা ছিল। আবার সেই
সঙ্গে একথাও ঠিক, বিশেষ কোনো
উপায়ে যৌনতাকে একটি নির্দিষ্ট ছকে
বেঁধে রাখা যায়নি। যৌনতা
জনিত ঈর্ষা, যৌনমিলনের অপূর্ণ ইচ্ছা জনিত হতাশা, শারীরিক
মিলনের অপরাগত ইত্যাদি নানান জটিল মনস্তত্বকে তাঁদের
মহাকাব্যে তুলে ধরতে হয়েছে
কিন্তু একাজটা করতে গিয়ে তারা
অনেকক্ষেত্রেই নানান প্রকার অভিশাপের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। পরশুরাম জননী রেণুকার মধ্যে
হয়ত যৌন অতৃপ্তি ছিল;
তিনি গান্ধর্বদের জলকেলী দেখে তাঁর মধ্যে
সেই ইচ্ছা জেগেছিল কিন্তু সেই ইচ্ছে জাগার
ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ
হয়েছিল আমরা সেটা জানি।
ঋষি জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের আদেশ
করেছিলেন মায়ের মাথাটা কেটে নিতে। অন্য
পুত্ররা জমদগ্নির এরকম একটা অন্যায়
আদেশ মেনে নিতে রাজি
না হলেও পরশুরাম পিতার
আদেশ মেনে নিয়ে ধড়
থেকে মায়ের মস্তক আলাদা করে ফেলেছিলেন। এই
গোটা কাজটাই অনুচিত এবং অযৌক্তিক ছিল।
অভিশাপের
আলোচনায় ফিরে আসি। যৌনতা
নিয়ে হস্তিনাপুরের রাজা পান্ডুর এক
রকমের সমস্যা ছিল। এই সমস্যা
এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি
স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানী ছেড়ে
বনে গিয়ে বসবাস করতে
শুরু করলেন। সেখানে গিয়েও তিনি বিপদ এড়াতে
পারলেন না। এক মতিভ্রম
ঋষি একেবারে খোলা আকাশের নিচে
স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলেন। পান্ডু বুঝতে না পেরে মিলনরত
ঋষি দম্পতিকে হরিণ ভেবে নিয়ে
তীর নিক্ষেপ করে বসলেন। সেই
তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করার আগে পান্ডুকে
একটা অভিশাপ দিয়ে বসলেন। ঋষি
নিজে যেরকম রমনরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে চলছেন পাণ্ডুও
একদিন সেই অবস্থাতেই তাঁর
মৃত্যু হবে। খুব সম্ভবত
পান্ডুর হৃদযন্ত্রে কোন একটা সমস্যা
ছিল, রমণেক্লান্তির ধকল নেয়ার মত
শক্তি পান্ডুর হৃদযন্ত্রের ছিল না। এই
ব্যাপারটাকে কোনভাবে ব্যাখ্যা করতে না পেরে
কিন্দমমুনির অভিশাপের গল্পটার অনুপ্রেবশ ঘটানো হয়েছে।