গল্পের ফাঁকফোঁকর : নরাণাং মাতুলক্রম।

Guitar K Kanungo


Dec. 23, 2024 | | views :66 | like:5 | share: 2 | comments :0
সংস্কৃতে একটা কথা আছে - "নরাণাং মাতুলক্রম," অর্থাৎ মানুষ মাতুলদের প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ভাগ্নেদের মধ্যে মামাদের স্বভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। এই শব্দ যুগল প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল মহাভারতে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি নকুল ও সহদেবের মামা শল্যকে নিরুৎসাহিত করতে কর্ণ বিদ্রূপভরে এই উক্তি করেছিলেন। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালে বিরাটরাজের আশ্রয়ে প্রথম তিন ভাই উচ্চপদ পেলেও, নকুল ও সহদেব যথাক্রমে অশ্বরক্ষক ও গোরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কর্ণ সেই দিকেই ইঙ্গিত করতে গিয়ে এই শ্লেষোক্তি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তীতে প্রবাদে পরিণত হয়।  

তবে এই উৎস-কাহিনী বলার জন্যে এই গল্পের অবতারণা করা হয়নি। আজকের গল্প হিন্দু পুরাণের মহত্তম দুই পুরুষকে নিয়ে। এঁদের প্রথম জন মহর্ষি বিশ্বামিত্র, দ্বিতীয় জন ভার্গব পরশুরাম। দুজনের মধ্যে বিশ্বামিত্রকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে রীতিমত এডোর করি । বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মালেও তপস্যার জোরে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠেছিলেন। এই ঘটনা গোটা হিন্দু পুরাণে একবারই ঘটেছে। অন্যদিকে পরশুরাম এই পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। এই পরশুরাম ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের একজন। শুধু তাই নয়, তিনি সাত ইমমর্টালদের মধ্যে একজনও বটে। মজার ব্যাপার হল, এই দুই মহত্তম পুরুষের মধ্যে 'নরাণাং মাতুলক্রম' ব্যাপারটার একটা সম্পর্ক আছে।

প্রাচীন ভারতে কন্যকুব্জ নামের একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের গাধী নামের এক প্রখ্যাত রাজা ছিলেন। বিশ্বামিত্র ছিলেন এই গাধীর সন্তান। একজন ক্ষত্রিয় রাজকুমার। বাল্মিকী রামায়ণে বিশ্বামিত্র অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র। তিনি ছিলেন অযোধ্যার রাজপুত্র, বিশেষ করে রাম এবং লক্ষণের অস্ত্রগুরু। এই বিশ্বামিত্রই রাম এবং লক্ষণকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মিথিলায়, রাজা জনকের রাজধানীতে। এখানেই হরধনু ভঙ্গ করে রাম সীতার সঙ্গে এবং লক্ষণ উর্মিলার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিশ্বামিত্র যদি এই রাজকুমারদের মিথিলায় নিয়ে না আসতেন, তাহলে রামচন্দ্রের সঙ্গে জানকীর দেখা হত না। পরবর্তীতে সীতাহরণের ঘটনাও ঘটত না, এবং সীতাহরণের ঘটনা না ঘটলে গোটা রামায়ণটাই আসলে লেখা হত না। শুধু তাই নয়, এই মিথিলায় এসে হরধনু ভঙ্গ করেছিলেন বলে ভগবান বিষ্ণুর দুই অবতার, রাম এবং পরশুরামের মধ্যে সাক্ষাৎকারের মতো বিরল ঘটনার ঘটবার সুযোগ সৃষ্টি হত না। 

পরশুরাম ছিলেন মহর্ষি জমদগ্নির পুত্র। তাঁর মায়ের নাম ছিল রেণুকা। জমদগ্নির পিতার নাম ছিল মহর্ষি রিচিক। এই ঋচীকের স্ত্রী ছিলেন বিশ্বামিত্রের বোন, তথা রাজা গাঁধীর কন্যা সত্যবতীর স্বামী। অর্থাৎ সত্যবতী ছিলেন পরশুরামের পিতামহী। বিশ্বামিত্র সত্যবতীর ভাই। সেই হিসাবে, সম্পর্ক অনুযায়ী, বিশ্বামিত্র পরশুরামের পিতামহ। সেইজন্যেই শুরুতেই বলেছিলাম, ঋষিপুত্র হয়ে জন্মালেও, সত্যবতীর বংশধারার উত্তরপুরুষ হিসেবে পরশুরামের মধ্যে ক্ষত্রিয়ের গুণাবলী লক্ষণীয়ভাবে ছিল। শুধু কি তাই? পরশুরাম জননী রেণুকাও ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। মজার ব্যাপার হলো, পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয় বিনাশে উদ্যোগী হবেন, অন্যদিকে বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়েও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবেন।  

বিশ্বামিত্র তখনো বিশ্বামিত্র হয়ে ওঠেননি, তিনি ক্ষত্রিয় রাজা হয়ে রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন। সবার কাছে তখন রাজা কৌশিক নামে পরিচিত ছিলেন। একদিন সসৈন্যে মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজাদের এই মৃগয়া করার ব্যাপারটা ছিল অন্যতম এক বিনোদন। ঘুরতে ঘুরতে মহারাজ কৌশিক মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে এসে পৌঁছালেন। বশিষ্ঠ আগত অতিথিদের যথাবিহিত সমাদর করলেন। কিন্তু মহারাজ কৌশিক অবাক হলেন, মহর্ষি বশিষ্ঠ কীভাবে এতজন অতিথিকে এভাবে রাজোচিত সমাদর করতে পারলেন। মহারাজ কৌশিক জানতে পারলেন, বশিষ্ঠের এই অপরিমেয় প্রাচুর্যের পেছনে ছিল কামধেনু নামের একটি স্বর্গীয় গাভী।

মহারাজ কৌশিক বশিষ্ঠের কাছে সেই কামধেনুটিকে চাইলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। কিন্তু বশিষ্ঠ রাজি হলেন না। কৌশিক এবার সেই কামধেনুটিকে বশিষ্ঠের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। বশিষ্ঠের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কাছে মহারাজ কৌশিক পরাজিত হলেন। কৌশিক এই পরাজয়কে ব্রাহ্মণ্য শক্তির কাছে ক্ষাত্রশক্তির পরাজয় হিসেবেই ধরে নিলেন। বশিষ্ঠের আশ্রম ত্যাগ করে তিনি কঠোর তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যা শেষ হল প্রজাপতি ব্রহ্মা এসে তাঁকে ব্রাহ্মণ পদে উত্তীর্ণ না করা পর্যন্ত। ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিক সেদিন থেকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। জন্মসূত্রে পাওয়া নিজের বর্ণ পাল্টে ফেলার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম এবং শেষবারের মত ঘটল।

পরশুরামের ক্ষত্রিয় বিনাশকারী হয়ে ওঠার পেছনেও এই কামধেনু সংক্রান্ত গোলযোগই প্রধানত দায়ী। দুটি ঘটনাই প্রায় একইরকম। শুধু স্থান, কাল, পাত্র আলাদা। বশিষ্ঠের জায়গায় মহর্ষি জমদগ্নি; ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিকের জায়গায় ক্ষাত্রবীর্যার্জুন। তবে সংঘর্ষের ফলাফলে সামান্য তফাৎ আছে, আর সেটা হল কামধেনু জোর করে কেড়ে নিতে গিয়ে বিশ্বামিত্র পরাজিত হয়েছিলেন বশিষ্ঠের কাছে, অন্য ঘটনায় মহর্ষি জমদগ্নি ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের কাছে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, পরশুরাম ছিলেন এই ঋষি জমদগ্নির পুত্র। পিতা হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ক্ষাত্রবীর্যার্জুন তো বটেই, আরো অসংখ্য ক্ষত্রিয় রাজাকে একের পর এক হত্যা করেন এবং তা চলতে থাকে অনেক বছর ধরে।

কামধেনু কীভাবে দুই সময়ের দুইজন ঋষির অধিকারে গেল, যাদের মধ্যে বংশ পরম্পরার কোনো সম্পর্ক নেই, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি, এইরকম অসাধারণ দৈবশক্তিসম্পন্ন একটি গাভী আদৌ থাকতে পারে কিনা সেটাও প্রশ্নের বিষয়। কিন্তু এই দুটি ঘটনা থেকে যে বিষয়টি বোঝা যায়, তা হলো প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে একটি লড়াই ছিল। সেই লড়াইয়ে কখনো ব্রাহ্মণ্য শক্তি জয়লাভ করেছে, আবার কখনো ক্ষত্রিয় শক্তি। বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধ না হলে বিশ্বামিত্রের 'বিশ্বামিত্র' হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। একইভাবে জমদগ্নির সঙ্গে ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের বিরোধ না হলে পরশুরামের ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। লোভে পড়ে একজন নিরীহ, নিরস্ত্র ব্রাহ্মণকে হত্যা করার ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে ক্ষাত্রশক্তি দুর্বিনীত, বেপরোয়া, এবং দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে উঠেছিল। এদের দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, এবং ভগবান পরশুরাম সেই কাজটিই করেছিলেন।

তবে বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠা মানবজাতির জন্য অনেক বেশি প্রেরণাদায়ক। এই দুই মহাপুরুষের জন্মের ঘটনায় কিছু রহস্যের কথা বলা হয়েছে—এক স্বর্গীয় পায়েস থেকেই এঁদের দুজনের জন্ম। কিন্তু এদের জননীদের ভুলের কারণে, যার ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাবার কথা ছিল, তিনি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছেন, আর যার ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মাবার কথা, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছেন। ফলে জীবনের একটি পর্যায়ে এঁদের বর্ণ পরিবর্তনের বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত হলেও, বিশ্বামিত্রকে কঠোর তপস্যা করতে হয়েছে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবার জন্য। অন্যদিকে, পরশুরামকে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করতে গিয়ে নিজেকেই বারবার ক্ষত্রিয় করে তুলতে হয়েছে। এই নিজের বর্ণ পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে আরেক চিরঞ্জীবী হনুমান এসে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—যথেষ্ট হয়েছে, এবার তাঁকে থামতে হবে; ক্ষত্রিয়বিহীন পৃথিবী ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

   

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929