লং লিভ প্রবীর ঘোষ

চিত্রদীপ সোম


May 19, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0

১৯৯৯ সালে প্রথম দেখা। ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র তখন আমি। বাড়িতে লুকিয়ে বর্ধমান থেকে গিয়েছিলাম তাঁর সাথে দেখা করতে, বর্ধমানে যুক্তিবাদী সমিতির শাখা খোলার ব্যাপারে অনুমতি নিতে। 

আর আজ, একটু আগে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গী হলাম। দেহদান করে আসা হলো সাগর দত্ত হাসপাতালে। অবসান হলো একটা যুগের। একটা অধ্যায়ের।

আমার কাছে আজীবন গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে এই বিষয়টি যে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গীদের অন্যতম ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহুর্ত অবধি সাথে ছিলাম তাঁর। মাঝপথে হাত ছেড়ে দিইনি আরও অনেকের মতো।


প্রবীর ঘোষ। শুধু একটা নাম নয়, একটা কিংবদন্তী। উপমহাদেশের বস্তুবাদ চর্চার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবচেয়ে আলোচিত নাম। আপামর মানুষের কাছে যুক্তিবাদ শব্দটিকে জনপ্রিয় করার, ভাববাদী চিন্তার বিরুদ্ধে পালটা মগজধোলাইয়ের মূল কারিগর৷ আজও শুধু তাঁর নামটাই এক আতঙ্ক বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীদের কাছে৷ জীবিতকালে ফাঁস করেছেন অসংখ্য বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীর ভণ্ডামী৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। খোদ বিবিসি তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় সেই ১৯৯২ সালে৷ এছাড়াও দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত চিন্তাবিদদের আলোচনায় বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। ভাববাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব, জ্যোতিষ সহ বিভিন্ন বুজরুকির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বলিষ্ঠ হাতে। লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটির মতো বই, যার অনেকগুলিই বেস্ট সেলার আজও। নবনীতা দেবসেন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’সহ বিভিন্ন লেখক লেখিকা তাঁর আদলে গল্পের নায়ক বানিয়ে গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা অবলম্বনে হয়েছে জনপ্রিয় সিরিয়ালও।


কেন প্রবীর ঘোষ অনন্য? ভারতে বস্তুবাদ চর্চার ইতিহাসে প্রবীর ঘোষ একমাত্র ব্যক্তি নন। অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র আছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, ভবানীপ্রসাদ সাহু, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এরকমই কিছু উদাহরণ। কিন্তু এরা কেউই আমজনতার কাছে নিজের বক্তব্যকে নিয়ে যেতে পারেননি। উক্ত বুদ্ধিজীবীরা জনপ্রিয় ছিলেন শুধুমাত্র শিক্ষিত বিদগ্ধ মহলে। বস্তুবাদ চর্চা ছিল তাঁদের কাছে নিছকই একটা একাডেমিক চর্চার বিষয়। এরা কেউই বুজরুকদের সাথে সম্মুখ সমরে নামেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের বুজরুকি ফাঁস করেননি। চ্যালেঞ্জ জানাননি। গ্রামেগঞ্জে অনুষ্ঠান করে মানুষের কাছে বস্তুবাদী চেতনার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেননি। তাই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে তাঁরা পরিচিতিও লাভ করতে পারেননি। আমজনতার মাঝে তাঁদের চিন্তাধারাকে ছড়াতে পারেননি বিন্দুমাত্র। অন্যদিকে প্রবীর ঘোষ শুধু অ্যাকাডেমিক কচকচানির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে রূপ দিয়েছিলেন আন্দোলনের। পৌঁছে দিয়েছেলেন প্রান্তিক মানুষের কাছে৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা জেলার শহরে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছেন। হাজার হাজার অনুষ্ঠানে হাতে কলমে ফাঁস করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন অলৌকিক কৌশলের বুজরুকি। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জ্যোতিষীদের। ফাঁস করেছেন জ্যোতিষীদের অতীত বা ভবিষ্যৎ বলার রহস্য। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের। এরজন্য একাধিকবার প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে তাঁর উপর। আর এসবই প্রবীর ঘোষকে বানিয়েছে জীবন্ত কিংবদন্তী৷ বানিয়েছে সুপার হিরো। আজ সুকুমারী ভট্টাচার্য বা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের নাম যত লোক জানে তার একশোগুন বেশী লোক জানে প্রবীর ঘোষের নাম৷ জানে যুক্তিবাদী সমিতির নাম। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মানুষের নেতা’, এভাবেই তিনি যুক্তিবাদকে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মাঝে।

প্রবীর ঘোষ যখন যুক্তিবাদী আন্দোলন শুরু করেন তখন এদেশে তথা এ রাজ্যে বিজ্ঞান সংগঠন ছিল হাতে গোনা। টিমটিম করে চলতো সেসব সংগঠন। সাধারণ মানুষ নামও জানতো না তাদের বিশেষ। বিজ্ঞান আন্দোলনের জোয়ার তিনিই প্রথম আনেন এদেশে। একের পর এক জনপ্রিয় বই লিখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে, জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীদের বিভিন্ন বুজরুকি হাতে কলমে ফাঁস করে, রেডিও টিভিতে বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে নামকরা জ্যোতিষীদের নাস্তানাবুদ করে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর্টিকেল লিখে এমনই এক হাইপ তিনি তৈরি করেন যে প্রায় রাতারাতি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন৷ গড়ে ওঠে কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। প্রবীর ঘোষ ও যুক্তিবাদী সমিতি আসরে নামার আগে এ রাজ্য তথা এ দেশের আনাচে কানাচে খোঁজ মিলত নানা ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীদের। রমরম করে চলত তাদের লোক ঠকানোর ব্যবসা৷ কিন্তু আজ মাথা খুঁড়লেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীর দেখা পাওয়া ভার৷ এই কৃতিত্বের সিংহভাগই যে প্রবীরবাবুর অবদান এ কথা অস্বীকার করা যায় না৷ এছাড়াও, যে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞান সংগঠন সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলতে ভয় পেত, যারা তাদের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রেখেছিল কৃষিতে জৈব সার ব্যবহার, খাবারে ভেজাল ধরার পদ্ধতি ইত্যাদি নিরীহ বিষয়ে, যাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে না হয়, সেই সময় অসীম সাহসে ভর করে তিনি সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর লেখা বইয়ে ধর্মকে ‘ক্যানসারের চেয়েও মারাত্মক, পরমানু বোমার চেয়েও বিপজ্জনক’ বলার হিম্মত রেখেছেন। আর এমন একটা সময়ে তিনি এই কাজ করেছেন যখন চারপাশের ১০০% মানুষই ছিল ধর্মবিশ্বাসী, ঈশ্বরবিশ্বাসী। একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা মেরুদন্ডের জোর, কতটা বুকের পাটা থাকলে তবে ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে দাঁড়িয়ে একথা বলা যায়। 


শুধু কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনই নয়, তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকাকেও। দেখিয়েছেন কেন রাষ্ট্রশক্তি তোল্লাই দেয় কুসংস্কারকে, তোল্লাই দেয় ভাববাদী চিন্তাধারাকে। দেখিয়েছেন শোষিত মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে, দৈব বিশ্বাসী করে রাখতে পারলে কিভাবে অবাধে শোষন, লুন্ঠন করা যায় তাদের৷ দেখিয়েছেন ভাববাদী চিন্তা কিভাবে প্রতিহত করে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা, ঘুম পাড়িয়ে রাখে মানুষের চেতনাকে৷ কোভুর বা জেমস র‍্যান্ডির মতো প্রখ্যাত যুক্তিবাদীরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকা নিয়ে ছিলেন নীরব। কুসংস্কারের জন্য তাঁরা দায়ী করেছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদেরই। দায়ী করেছিলেন তাদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার অভাবকে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা, পুঁজির ভূমিকা নিয়ে তাঁদের এই নীরব থাকার কারণ হয় তাঁদের অজ্ঞতা, আর নয় রাষ্ট্রশক্তির কোপে পড়ার আশঙ্কা। এদিক থেকেও প্রবীর ঘোষ ছিলেন ব্যতিক্রমী৷ শুধু ভাববাদের বিরুদ্ধে নয়, তিনি মুখ খুলেছিলেন হুজুর-মজুর শ্রেণীকাঠামোর বিরুদ্ধে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সাম্যবাদের। তিনি দেখিয়েছেন শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব শোষণমুক্তি ঘটাতে পারে না, পাশাপাশি চালাতে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যাতে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী সমাজের কু-আচার, কু-প্রথা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে পারে৷ এখানেও তিনি অনন্য। 

বিতর্ক যে তাঁকে নিয়ে হয়নি তা নয়। বস্তুত বিতর্ক ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিছু বিতর্ক বা সমালোচনা যেমন ছিল যৌক্তিক, তেমনই ছিল কুৎসার, অপপ্রচারের বন্যা৷ কুৎসাকারীরা তাঁকে টেনে নামাবার, মিথ্যা অভিযোগে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টার কসুর কোনওদিনই করেনি। এরমধ্যে জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীরা যেমন আছে তেমনি আছেন যুক্তিবাদী নামধারী কিছু কুলাঙ্গারও। কারণ তাঁরা জানতেন প্রবীর ঘোষ একজন ব্যক্তিমাত্র নয়, একটা আদর্শ, একটা যুগ, একটা সংগ্রামের নাম। তাই প্রবীর ঘোষকে ‘খলনায়ক’ প্রমান করতে পারলে কুঠারাঘাত করা যাবে যুক্তিবাদী চেতনার মূলে। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে একটি গোষ্ঠী দাবী করে আসছে তিনি নাকি যুক্তিবাদী সমিতি থেকে ‘বিতাড়িত’। দাবী করে আসছে তিনি নাকি শ্লীলতাহানি, অর্থ তছরূপের অভিযোগে অভিযুক্ত৷ ভুয়ো ডিগ্রীর অধিকারী। স্ত্রীর উপর তিনি নাকি ‘নির্মম অত্যাচার’ করেন। এই সমস্ত অভিযোগে আদালতে একের পর এক মামলাও এনেছে তারা৷ একটা দুটো নয়, একের পর এক তেরোটি মামলা। কিন্তু ‘পরাজয়’ শব্দটি প্রবীর ঘোষের অভিধানে ছিল না কোনওদিনই। আদালতের লড়াইতেও জয়ী হয়েছেন তিনি। যে কটা মামলার রায় বেরিয়েছে তার প্রতিটিতেই মহামান্য আদালত তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন সমস্ত অভিযোগ থেকে। আদালতের লড়াইতে পরাস্ত হয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা রটনাকেই মূল হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে কুৎসাকারীরা। এটাই তাদের শেষ সম্বল। 

প্রবীর ঘোষ আজ আর নেই৷ কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অজস্র অনুরাগীর মধ্যে৷ বেঁচে থাকবেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে৷ যতদিন ভাববাদ বিরোধী লড়াই চলবে, যতদিন অলৌকিকতা বিরোধী লড়াই চলবে, ততদিনই প্রবীর ঘোষ ধ্রুবতারা হয়ে দিক নির্দেশ করবেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের। প্রবীর ঘোষরা মরেন না৷ মরে কেবল তাঁদের নশ্বর দেহটি।

লং লিভ প্রবীর ঘোষ।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929