ধাতব মৌলদের কথা: অ্যালুমিনিয়াম
অঞ্জনা ঘোষ
May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
পর্ব -১
সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে প্রস্তর যুগের পরে ব্রোঞ্জযুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সেই সুদূর অতীত থেকে শুরু হয়েছে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে উপস্থিত বিভিন্ন ধাতব মৌলের আবিষ্কার ও প্রাত্যহিক জীবনের মান উন্নয়নে নানাভাবে তাদের বহুবিধ ব্যবহার।
আর আজ তো শুধু প্রকৃতি থেকে পাওয়া না, গবেষণাগারেও বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু নতুন মৌল সংশ্লেষনে (synthesis) সমর্থ হয়েছেন। আধুনিক পর্যায়সারণিতে টেকনিটিয়াম (Tc- 43) এবং শেষ ২৪টি মৌল (পারমাণবিক সংখ্যা 95 -118) প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। এগুলির প্রত্যেকটিই গবেষণাগারে সংশ্লেষিত মৌল (synthetic elements)। আর এরা প্রত্যেকেই তেজস্ক্রিয় এবং অস্থায়ী মৌল। বিশদে এদের আলোচনায় পরে আসব অন্য এক পর্বে।
বস্তুত মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও ধাতুর ব্যবহার এই দু’এর সম্পর্ক এক কথায় অবিচ্ছেদ্য।
আমার এই উপস্থাপনায় আধুনিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে অতি ব্যবহৃত কিছু ধাতুর কথা রইল। কয়েকটা পর্বে রাখার চেষ্টা করছি।
পর্ব- ১
ধাতু -অ্যালুমিনিয়াম
.
পর্যায়সারণি’র জনক দিমিত্রি মেন্ডেলিফ’কে বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ইংরেজ রসায়নবিদরা তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ফুলদানি দিয়ে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি। আসলে সময়টা হল অষ্টাদশ শতক। রূপোর মত চকচকে উজ্জ্বল বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম সেসময় ছিল এক বহুমূল্য ধাতু। তার কারণ সেই সময় আকরিক থেকে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাষণের কোন সহজ পদ্ধতি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
তবে আজকের পৃথিবীতে অ্যালুমিনিয়াম(Al) বহুলতম ব্যাবহৃত ধাতুগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। পরিমানগত হিসেবে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌলদের মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম’এর স্থান ৩য়(১ম অক্সিজেন ও ২য় সিলিকন)। কিন্তু মুক্ত অবস্থায় তো অ্যালুমিনিয়াম প্রকৃতিতে থাকেনা, থাকে রাসায়নিক যৌগ অর্থাত আকরিক হিসেবে।
১৮২১ সালে ফরাসী জিয়োলজিস্ট পি বার্থিয়ার ফ্রান্সের এক প্রত্যন্ত গ্রাম লেস বক্স (Les Baux) এ লালচে মাটির মত দেখতে, বক্সাইট আকরিক আবিষ্কার করেন। এই বক্সাইট আকরিক হল হাইড্রেটেড অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al2O3, 2H2O)। এই বক্সাইট ছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম’এর আরও কিছু আকরিক যেমন ক্রায়োলাইট(Na3AlF6), কোরান্ডাম(Al2O3) ইত্যাদি পাওয়া যায় প্রকৃতিতে। তবে সারা বিশ্বেই সবচাইতে আর্থিকভাবে লাভজনক এবং সহজতম পদ্ধতিতে প্রধানত বক্সাইট আকরিক থেকেই অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাষিত হয়। বহুল ব্যবহৃত এই ধাতুর পৃথিবী’র বিভিন্ন দেশে সমগ্র বার্ষিক উৎপাদন ৬৯ মিলিয়ন টন(2022 সালের হিসাব)।
আসলে বহু শিল্পে ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত হয় অ্যালুমিনিয়াম।
এর কারণ অ্যালুমিনিয়াম ধাতু একাধারে বহু গুণের (quality) অধিকারী। অ্যালুমিনিয়াম হাল্কা ধাতু(ঘনত্ব 2.7 gm/cc) কিন্তু শক্তিশালী কারণ এর উচ্চ মানের নমনীয়তা (Malleability & ductility)। প্রসঙ্গত যদিও স্টিল অ্যালুমিনিয়ামের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী (strong) কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের শক্তি/ভর অনুপাতের (strength/weight ratio) মান স্টিলের থেকে অনেক বেশি। তাই ছোট গাড়ি, এয়ারক্র্যাফট ইত্যাদি নির্মানে এই ধাতু (ধাতুর শঙ্কর) ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম অ-ক্ষয়কারী(non-corrosive) ধাতু। যদিও অ্যালুমিনিয়াম একটি বিক্রিয়াকারী (reactive) ধাতু কিন্তু বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে ধাতুর উপরিতলে (surface) অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড’এর কঠিন ও অ-ক্ষয়কারী (hard & non-corrosive) স্তর তৈরি হয়।
আবার অ্যালুমিনিয়াম উচ্চমানের তাপ ও বিদ্যুতের পরিবাহী। এছাড়াও অবিষাক্ত (non-toxic)। একই সঙ্গে এতসব গুণের (quality) সমাহার এবং আকরিকের সহজলভ্যতা ও উৎপাদন মূল্য অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণে আধুনিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই অ্যালুমিনিয়াম ধাতু। হাল্কা, নমনীয়তা, ক্ষয়রোধকারীতা(non-corrosive), নন-টক্সিসিটি, উচ্চমানের তাপ পরিবাহীতা ইত্যাদির কারণে রান্না করার বাসনপত্র,অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, ক্যান, আধুনিক গৃহনির্মান থেকে শুরু করে এয়ারক্র্যাফটের প্রায় সব অংশই, ডানা থেকে শুরু করে ককপিটের সব যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরিতে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত হয়।
আবার উচ্চমানের নমনীয়তা ও বিদ্যুত পরিবাহীতার কারণে এবং কপারের থেকে অনেক সস্তা হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইন তৈরীতে ও ব্যাবহৃত হয়। এছাড়াও আরও বহু শিল্পে, বিভিন্ন মেশিনপত্রের অংশ(parts) তৈরিতেও ব্যাপক হারে ব্যবহার হয় এই ধাতুর। এই বিপুল হারে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে একসময় তো অ্যালুমিনিয়ামের ভান্ডারে টান পড়বে। না, এটাও খুব একটা আশঙ্কার ব্যাপার নয়। কারণ অ্যালুমিনিয়ামের পুণর্ব্যবহার (recycling rate) অত্যন্ত উঁচু মানের। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অ্যালুমিনিয়াম বিপুল হারে রিসাইক্লিং হয়। আকরিক থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাষণ করতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয় তার মাত্র 5-10% শক্তি ব্যয় হয় এই ধাতুর রিসাইক্লিং-এ। বিভিন্ন পানীয় বিক্রি হয় যে অ্যালুমিনিয়াম ক্যান গুলোতে সেগুলো তো প্রায় 100% রিসাইক্লিংযোগ্য।
এছাড়াও অ্যালুমিনিয়ামের নিষ্কাষণ ও শুদ্ধিকরণ (purification) বা রিসাইক্লিং কোন পদ্ধতির সময়েই পরিবেশে কোন গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গত হয় না। তাই অ্যালুমিনিয়াম একটি পরিবেশ বান্ধব ধাতু সবুজ ধাতু(Green metal) হিসেবে চিহ্নিত।
আগামী পর্বে আর একটি ধাতু নিয়ে আলোচনা করবো।