রামায়ণ ও মহাভারতে নৈতিকতা : একটি খন্ডচিত্র

Guitar K Kanungo


March 26, 2025 | | views :61 | like:0 | share: 1 | comments :0

রামায়ণে ঘটে যাওয়া দুটি হত্যাকাণ্ডকে আমি নীতিবিরুদ্ধ এবং গর্হিত অপরাধ বলে মনে করি। এই দুটি হত্যাকাণ্ড স্বয়ং রামচন্দ্রই ঘটিয়েছেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের অজুহাতে দ্বাপর যুগে বাসুদেব কৃষ্ণ অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, কিন্তু খুব সীমিত ক্ষেত্রেই তিনি নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেছেন।

কংস দুরাচারী ছিলেন; তাঁকে উৎখাত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। মগধরাজ জরাসন্ধের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন। নিজের পিতা উগ্রসেনকে হটিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছিলেন। অন্যদিকে, কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেছেন তাঁর একশটি অপরাধ ক্ষমা করার পর। এই দুটো হত্যাকাণ্ডের কোনোটাই কোনো প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে করা হয়নি।

রামচন্দ্রের হাত দিয়ে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। শূদ্র বংশোদ্ভূত শম্বুক ঈশ্বরের তপস্যা করছিলেন। "শূদ্রের ঈশ্বরের তপস্যা করার অধিকার নেই"—এই অজুহাতে শম্বুককে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার তীব্র বর্ণবৈষম্যের একটি প্রতীকী উদাহরণ এবং উদাহরণটা সৃষ্টি করছেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে কথিত রামচন্দ্র।

কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালীর সঙ্গে রামচন্দ্রের কোনো শত্রুতা ছিল না। যিনি মহাপরাক্রমশালী রাবণকে বগলের নিচে চেপে ধরে অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়াতেন, সেই রাজা বালীর মৃত্যুটা এতটা অসম্মানজনক না হলেও পারত। কিন্তু রামচন্দ্র পিছন দিক থেকে অতর্কিতে তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করেন।

জরা নামের যে ব্যাধের হাতে বাসুদেব কৃষ্ণ নিহত হয়েছিলেন, তিনি ত্রেতা যুগে রামের হাতে নিহত হওয়া কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালী। রামচন্দ্র বালীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন; সেই কারণে দ্বাপর যুগে এসে বালীকে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। মহাভারত আমাদের সেই খবর দিচ্ছে।

এই ঘটনা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—বাল্মীকি বালী হত্যার পেছনে যত যুক্তিই দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন না কেন, মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সেইসব যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। অবশ্য এটাও ঠিক, মহাভারতেও আমরা এমন অনেক দ্বৈরথ দেখতে পাব, যেখানে বেশ অন্যায়ভাবেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছিল। মগধরাজ জরাসন্ধ এবং কৌরবজ্যেষ্ঠ দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙেই হত্যা করা হয়েছিল।

অনেকটা একই অবস্থা ছিল লঙ্কেশ রাবণেরও। শিবের বরপ্রীতি লাভ করে রাবণ অনেকটা অমর হয়ে উঠেছিলেন। রামায়ণ যে জায়গাটাকে কিস্কিন্ধ্যা নামে চিহ্নিত করেছে, সেটা বর্তমান সময়ের রামেশ্বরমের অদূরে। রামায়ণ এটাও বলেছে, কিস্কিন্ধ্যা থেকে সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কার দূরত্ব ১০০ যোজন, অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, যে জায়গাটাতে বানরসেনারা রামসেতু নির্মাণ করেছিল, সেটার এপারে কিস্কিন্ধ্যা, ওপারে লঙ্কা।

বালীর বিক্রমের কথা রাবণ জানতেন। একদিন কিস্কিন্ধ্যায় এসে রাবণ বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। কাজটা বোকামি হয়েছিল, কারণ রাবণের জানা ছিল না—বালীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে না হতেই তাঁর শক্তি অর্ধেকে নেমে আসবে। ফলত যা হওয়ার, তাই হলো; রাবণ বালীর কাছে পরাজিত হলেন।

একটা প্রশ্ন তাই যৌক্তিকভাবেই ওঠে—রাম বালীকে বাদ দিয়ে সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে গেলেন কেন? মৃত্যুপথযাত্রী বালী স্বয়ং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। রামের সঙ্গে যখন সুগ্রীবের সাক্ষাৎ ঘটে, তখন সুগ্রীব রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি অনেকটাই সহায়-সম্বলহীন; বালীর মতো বিশেষ কোনো শক্তিও তাঁর নেই। অবশ্য কিছু অনুগত বানরসেনা এবং পবনপুত্র হনুমান রয়েছেন তাঁর সঙ্গে।

রাম চাইলেই সরাসরি বালীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য চাইতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন, যিনি কিনা নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সামর্থ্যও রাখেন না—পবনপুত্র হনুমান তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও!

হনুমানের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে। এই হনুমানের সঙ্গেও বালীর একবার একটা যুদ্ধ হয়েছিল। ব্রহ্মার বর পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর, প্রত্যাশিতভাবেই বালী একটা সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। এদিকে হনুমান বেশিরভাগ সময় তাঁর আরাধ্য দেবতা রামচন্দ্রের উপাসনায় মগ্ন থাকতেন।

এখানে অবশ্য একটা প্রশ্ন ওঠে—সীতাহরণের ঘটনা ঘটেছিল বলেই রামচন্দ্র সীতার ফেলে যাওয়া আভরণ খুঁজতে খুঁজতে কিস্কিন্ধ্যায় এসে পড়েছিলেন। এখানে আসার পরেই হনুমানের সঙ্গে রামচন্দ্রের দেখা হয়েছিল। তাহলে রামচন্দ্র হনুমানের আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠলেন কীভাবে?

এই প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া না গেলেও আমরা জানি—রাবণকে হারাতে পারলেও বালী হনুমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। হনুমান এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে তাঁর অর্ধেক শক্তি আত্মীভূত করার ব্যাপারটা বালীর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল; বালী সেটা ধারণ করতে পারছিলেন না।

এবার আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়—যদি সেটাই হবে এবং হনুমান যেহেতু সুগ্রীবের অনুগামী, তাহলে রামচন্দ্র কিস্কিন্ধ্যায় এসে পৌঁছানোর আগে হনুমানের সাহায্য নিয়ে সুগ্রীব বালীকে অপসারণের চেষ্টা করেননি কেন? সুগ্রীব কি তাহলে রামচন্দ্রের অপেক্ষায় বসে ছিলেন?

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929