ঝড় যেন থামছেই না। ক্রমাগত ধেয়ে আসছে একটার পর একটা।
জন্ম ইসতক দেখছি ঝড় ঝঞ্জা তুফান। ভিন্ন নামে জানান দেয় বিধ্বংসী উপস্থিতি। টাইফুন হারিকেন সাইক্লোন। ফনী বুলবুল আইলা আম্ফান। বহু নাম ঝড়ের। দেশ ভেদে সাগর ভেদে ভিন্ন নাম।
আটলান্টিক, ক্যারিবিয়ান সাগর, মধ্য ও উত্তরপূর্ব মহাসাগরে ঝড় হ্যারিকেন। প্রশান্ত মহাসাগরে টাইফুন। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগরের ঝড়ের নাম সাইক্লোন। যে-নামই হ’ক, তার দাপটে গ্রাম শহর বন্দর নগর তছনছ। গবাদি পশু বন্য জন্তুর মৃত্যু। হাজারে লাখে মারা পড়ে মানুষ।
‘লাখ’ শব্দটি অতিরঞ্জিত হল কি? বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা ১৯৯০ সালের ঝড়ের কথা মনে করুন। গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫০ মাইল। জলোচ্ছ্বাস ২০ ফুট উঁচু। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু।
‘ভোলা’ নামের সাইক্লোনের কথা ভাবলেই শিউড়ে উঠতে হয়। বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) আছড়ে পড়া ঝড় কেড়ে নিয়েছিল চার-পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ। বেসরকারি মতে দশ লক্ষ।
১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বেগে আঘাত হেনেছিল ফণী (৯০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়)। ঘূর্ণিঝড়টি খড়গপুরে আছড়ে পড়ে তাকে ধ্বংস করে দিয়ে হুগলির আরামবাগ হয়ে চলে যায় বাংলাদেশে।
পরের বছর (২০২০) বিধ্বংসী আইলা ঝড়ে ভারত বাংলাদেশর বড় অংশ বিধ্বস্ত। পরের বছর ভয়ানক আম্ফান। বছর না পেরোতেই ক’দিন আগে (২০২১) ঘটে গেল আরেকটি অতি ভয়ঙ্কর ঝড়, ইয়শ।
ঝড়ের পর ঝড়। শুধু ভারত-বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বঙ্গোপসাগরেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু তটে বিভিন্ন সময় আছড়ে পড়েছিল হারিকেন। ফ্লোরেন্স, হার্ভে। হাওয়াই দ্বীপের ঝড় ‘লেন’। ফিজিতে সাইক্লোন ‘জোসি’।
ঝড়ের সালতামামী নয়। মানুষ জানতে চাইছেন কেন ঘন ঘন এত ঝড়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠে জলের বর্ধিত তাপমাত্রা ডেকে আনছে বিধ্বংসী ঝড়। সাগরে জলতলের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রির (সেলসিয়াস) বেশি হলে সেখানে নিম্নচাপ তৈরি হয়। কারণটি সহজ বোধ্য।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠতে থাকে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর একটি বায়ুশূন্য অঞ্চল তৈরি হয়। শূন্যস্থান পূরণ করতে তখন পার্শ্ববর্তী এলাকার শীতল এবং ভারী বাতাস উড়ে আসে। দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা বাতাস জন্ম দেয় ঘূর্ণিঝড়ের। এক কথায় নিম্নচাপ থেকে তৈরি হওয়া ঝড়ই হলো ঘূর্ণিঝড়। গতিবগের উপর নির্ভর করে ঝড়ের চরিত্র। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম ইত্যাদি।
ঝড়ের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব? শত্রু পক্ষের ধেয়ে আসা মারণ মিশাইল আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু সাগরের বুকে জন্ম নেওয়া নিম্নচাপ আর সৃষ্ট ঝড়? প্রতিহত করবার অস্ত্র আধুনিক বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে মজুত নেই।
ঝড় ঠেকিয়ে রাখবার একমাত্র উপায়, পৃথিবী গ্রহের উষ্ণতা কমিয়ে আনা। উষ্ণতা বৃদ্ধি হেতু পৃথিবীর জলবায়ু ভীষণই বদলে গেছে। সংশোধন করে নেওয়া অর্থাৎ গ্রহের উষ্ণতা কমিয়ে আনা এখন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই কাজটাই করতে হবে। নইলে ফল মারাত্মক। সম্পূর্ণ গ্রহটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্রমাগত ধেয়ে আসা ঝড় ঝঞ্জা তুফান তারই অশুভ ইঙ্গিত বহন করে আনছে।
বিপদ মালুম হয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র তাই গেল গেল রব। মানুষের মুখে কেবল পরিবেশ দূষণের ফিরিস্তি। জল, বায়ু, মাটি, বিষাক্ত। সাথে আরেকটি বিপদ। পৃথিবী গ্রহের উষ্ণায়ন। আমাদের বাসযোগ্য ধরিত্রীর বুকে মানুষ উদ্ভিদ জলজ প্রাণী, সবার অস্তিত্বই বিপন্ন। সব মিলিয়ে পৃথিবী গ্রহ খুবই বড় অসুখে আক্রান্ত। মুল কারণ, গ্রহের উষ্ণায়ন।
‘উষ্ণায়ন’ নামেরর এত বড় বিপদ সৃষ্টি করল কে? নিঃসন্দেহে মানুষ নামের প্রজাতি। সুখ সমৃদ্ধি ভোগ্যপন্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় যথেচ্ছ আবর্জনা ছড়িয়েছে। ফলস্বরূপ পৃথিবী গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই।
কেমন করে? তাপ শক্তি নির্গত করে। আরাম আয়েশ আর ভোগ্য বস্তু উৎপাদন করতে দরকার শক্তি। শক্তি তৈরি করতে প্রয়োজন জ্বালানি। যেমন কয়লার দহনে উৎপন্ন তাপ শক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা পাই বিদ্যুৎ শক্তি (Thermal power)। বিদ্যুৎ শক্তি বিনা জীবন অচল। রাস্তায় বিজলি বাতি, বাড়িতে ফ্রিজ, ঘর ঠাণ্ডা রাখবার এয়ার কন্ডিশন মেশিন। আধুনিকতা আর প্রগ্রতির পথে চলতে জ্বালানির দহন অপরিহার্য।
শুরু হয়ছিল শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে (1760-1820)। মানব সভ্যতার অতি দ্রুত জয়যাত্রা। কলকারখানায় চলল লোহা ও অন্য ধাতু গলানো। রেল, জাহাজ, গাড়ি তৈরি হতে লাগলো। এগুলি অগ্রগতির মানদণ্ড। সভ্যতার খিদে মেটাতে প্রয়োজন হল বিপুল শক্তি।
শক্তি বা এনার্জি এল কোথা থেকে? কাঠ, জ্বালানি তেল, কয়লা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ফুয়েল দহন করে। যত বেশী পুড়তে লাগল প্রাকৃতিক জ্বালানি, ততই বৃদ্ধি পেল বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড আর চারপাশের উষ্ণতা।
বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিণাম কি মানুষ আগে বুঝতে পারেনি? ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনে ডুবে থাকা মানুষ, প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারেনি। কিন্তু বুঝেছিলেন বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়। দেড়শ বছর আগেই। সাবধানও করেছিলেন মানুষকে।
‘বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, অতএব সাবধান’ এমন বানী শুনিয়েছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল (1820-1893)। আরেক জন নোবেল প্রাপ্ত (১৯০৩) সুইডিশ বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (1859-1927) সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘বাতাসে অধিক পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বড় বিপদ ডেকে আনবে’।
কেন এমন বললেন? কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস কাজে লাগায় গাছ। বৃক্ষকুল গ্যাসটি গ্রহন করে নিজের খাদ্য বানায় (Photosynthesis), আর বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। কার্বন ডাইঅক্সাইড অপসারি বৃক্ষ সম্পদ নির্বিচারে কোতল হয়েছে বিশ্বজুড়ে। অরণ্য ধ্বংস করে শহর নগরের পত্তন হয়েছে। ফলত, প্রকৃতির বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য বেড়েছে। এতটাই যে বায়ু মণ্ডলে এর উপস্থিতি বিপদ সীমা অতিক্রম করে ধ্বংসের দামামা বাজাচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছে সংবেদনশীল মানুষজন।
ছোট্ট একটা গ্যাসের কারসাজিতে কেন গোটা নীল গ্রহটাই বিপর্যস্ত? কারণ, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসটি নিজ গুনে এটি তাপ শোষণ করে রাখে। কেমন করে? শতাব্দী প্রাচীন বৈজ্ঞানিক খুঁজে পেয়েছিলেন উত্তর। একশ আঠান্ন বছর আগে প্রমাণ লব্ধ তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন পদার্থবিদ জন টিন্ডাল।
একটা কার্বন এবং দু’টো অক্সিজেন, তিনটে মাত্র পরমানু দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাইঅক্সাইড। গ্যাসটি তার অশেষ ক্ষমতা বলে শুষে নেয় সূর্য থেকে বিকিরিত অবলোহিত (infrared light) আলো। সূর্যের আলোয় থাকে সাত রং। রঙের বর্ণালীতে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘের আলোটি লাল বর্ণের। বায়ু মণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং তাঁর চাইতে বেশী তরঙ্গদৈর্ঘ। ফল সহজেই অনুমেয়। বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না-গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে (গ্রিন হাউস গ্যাস)। অবশ্য কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও গ্রিন হাউস গ্যাস পরিবারে অন্য সদস্যও আছে। জলীয় বাস্প, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড,ওজন। তবে ভূপৃষ্ঠে উত্তাপ ফিরিয়ে আনবার সবচাইতে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন যৌগ কার্বন ডাইঅক্সাইড (ও জলীয় বাস্প)।
বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনিয়েছিলেন আরহেনিয়াস। বাতাস দু’ভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হবার সময় (selective diffusion)। দ্বিতীয়ত তাপ শোষণের (absorption) মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদান গুলোয় (দ্বিপারমানিক নাইট্রোজেন অক্সিজেন) তাপের প্রভাবে কম্পন (vibration) ঘটে। দুই পরমানুর মধ্যেকার কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমান তাপ শোষণ করতে পারে তারা। কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প শোষণ প্রক্রিয়ার (absorption) মাধ্যমে তাপ গ্রহণ করে। এদের (CO2, H2O) পরমাণু গুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত (Infrared) অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অনু তাপ মোচন (Emission) করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে (vibrate)। এই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ তাপের শোষণ–মোচন-শোষণ (Absorption-emission-absorption), কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলীয় বাস্প পৃথিবী তলে তাপ ধরে রাখে।
টিন্ডালেরর আবিষ্কারের ছত্রিশ বছর পর বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উষ্ণতা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করলেন। কী তার গবেষণা লব্ধ তথ্য? কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস কারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে জ্বালানি দহনের ফলে। নির্গত গ্যাস সঞ্চিত হচ্ছে বায়ু মণ্ডলে। ফলে গ্রহের উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। নিখুঁত ভাবে আরহেনিয়াস বললেন, ‘কার্বন ডাইঅক্সাইডের এখন (১৮৯৬) যা পরিমাণ, ভবিষ্যতে সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে আশঙ্কাজনক মাত্রায়, ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস’। এখনকার গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যও প্রায় তেমন।
উষ্ণতা বৃদ্ধি আশঙ্কা জনক। তবুও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নস্যাৎ করে দেশ বিদেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিক, ব্যবসায়ী মহল বিশ্ব-উষ্ণায়ন তত্ত্ব মানতে নারাজ। একাধিক ভ্রান্ত ধারনা প্রচার করে ক্রমাগত উষ্ণায়ন বিরোধী বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। কারণ পৃথিবীর ক্রম উষ্ণায়ণ প্রক্রিয়া প্রতিহত করলে হ্রাস পাবে ভোগ্য পন্যের উৎপাদন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসায়িক স্বার্থ।
আমরাও উষ্ণায়ন নয়, ঝড়ের ধ্বংস লিলার পর শুধু মাত্র গৃহহারা মানুষদের ত্রান বণ্টন, নদী সমুদ্রের বাঁধ নির্মাণ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। বঙ্গোপসাগরে উদ্ভুত ঘন ঘন ঘূর্ণি ঝড় নিয়ন্ত্রনের উপায় ভাবি না। কেন বারবার ঝড় ওঠে জেনেও আমরা নির্বিকার।
ক’দিন আগেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে ধেয়ে এল ‘টাউকটে’, মহা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। প্রবল বেগে (১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার) ধেয়ে এসে গুজরাত মহারাষ্ট্রে বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল। ‘টাউকটে’র উৎপত্তি স্থল আরব সাগর। সেই ঝড়ের রেশ মিটতে না মিটতেই, বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে এল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ‘ইয়াস’। আরবি শব্দ ভাণ্ডারে যার অর্থ হতাশা। ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা চলতে পারে ‘আমফান’ ঝড়ের। বিধ্বংসী আমফানে বহু মানুষ এক বছর পরেও গৃহ হারা।
ভারতবর্ষ দেশটি ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞদের (কোপেনহেগেনের ক্লাইমেট ক্লাসিফিকেশন্স) অভিমত, দেশটি জলবায়ু বহু বৈচিত্র্যে ভরপুর। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সহ অনেকগুলো ঋতু এখানে। ‘জলবায়ু’ অনেক গুলো বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। বায়ুমণ্ডল, জলভাগ, জমে থাকা বরফ, ভূত্বক, প্রাণী, উদ্ভিদ। এছাড়াও অন্য বহু বিষয়ের সাথে (ভৌগলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতির) জড়িয়ে আছে এর সম্পর্ক।
কর্কটক্রান্তি রেখা ভারতকে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় দুই ভাবে বিভক্ত করেছে। দেশটিতে ক্রান্তীয় বর্ষা ও উপক্রান্তীয় পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রবল প্রতাপ। দেশের কোন অঞ্চলে যখন খরা, অন্য অঞ্চলে বন্যা। কোথাও তাপপ্রবাহ, অন্য কোথাও আবার শৈত্য প্রবাহ।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আয়লা, সিডার, আমফানের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন দেশবাসী। ঝড়-ঝঞ্ঝার তীব্রতা আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্কটক্রান্তি রেখার উত্তরে গড় তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি হয় মে মাসে। ফলে শুকনো ও গরম হাওয়া পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ যত কম, তার উত্তাপ তত বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ভারতে সামগ্রিকভাবেই গ্রীষ্মের উষ্ণতা ও বর্ষার গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে ক্রমাগত ঝড়-ঝঞ্ঝা ঘটেই চলেছে দেশে। অন্য কোথায়, বিশ্ব উষ্ণায়নের মারাত্মক প্রভাব দেখা যাচ্ছে দেশের সর্বত্র।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব প্রথমে দেখা যায় সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে। সুন্দরবন সহ উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, হাওড়ায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবন অঞ্চল। ঘনীভূত নিম্নচাপ সৃষ্টি করে ঘূর্ণিঝড়। তার প্রবল হওয়ায় ফুঁসে ওঠে সমুদ্র। শুরু হয় জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাসে নদী সাগরের বাঁধ ভেঙে জল ঢোকে লোকালয়ে। চাষের জমিতে। ভেসে যায় ধান, পান, ঘর, জীবন।
সমুদ্র লাগোয়া নদী গুলোর জলস্তর বৃদ্ধি প্রতি বছরই ঘটছে। গত পঁচিশ বছরে (১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত) সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়েছে ২.৯৬ ইঞ্চি বা ৭.৫ সেন্টিমিটার। একুশ শতকের মধ্যে ৬০ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে (ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর প্রতিবেদন)। তখনকার সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন সহ বহু শহর দ্বীপ সম্পূর্ণই ডুবে যাবে।
অনেক সুন্দরবন-গবেষক মনে করেন, মাটির বাঁধ নয়। সুন্দরবন বাঁচাতে দড়কার কংক্রিটের শক্ত চওড়া বাঁধ। মাটির বাঁধ হলে ভিত করতে হবে ৮০ থেকে ১০০ ফুট আর উপরের অংশ খুবই চওড়া (১৪ থেকে ২২ ফুট)। সঙ্গে দরকার কড়া নজরদারি।
সমুদ্রবাঁধ ও বাদাবনের উপর নির্ভর করে সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলের অস্তিত্ব। সমুদ্রের জলে জোয়ার-ভাটা, জলতল বৃদ্ধি, ঢেউয়ের উচ্চতা ইত্যাদি বাড়তেই থাকবে। ঘটতে থাকবে বাৎসরিক ঘূর্ণিঝড় ও প্লাবন। সমুদ্র তটে আছড়ে পড়বে উঁচু ঢেউ। বাঁধ টপকে সাগর জল প্রবেশ করলে বের হতে পারবে না। সব মিলিয়ে বিষয়টি বড়ই উদ্বেগের। বিপন্ন হয়ে উঠবে মানুষের জীবন জীবিকা, গ্রাম শহরের অস্তিত্ব।
সব মিলিয়ে বড়ই বিপন্ন মানুষ। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিশ্ব উষ্ণায়নকে রোখার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা; দীর্ঘমেয়েদি পরিকল্পনা। দিন যত এগোবে, ততই ঘন ঘন ঘটতে থাকবে বিপর্যয়। বিশ্বকে পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তুলতে হলে উষ্ণায়ন কমাতেই হবে। বিশ্বব্যাপী কিছু কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। তবে কোন রকম আশার কথা এখনও শোনা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে সংকট উত্তরনের পথ দেখানোও বাঞ্ছনীয়। তাই বলতে হয়, গাছ লাগান। বিদ্যুৎ জল অপচয় করবেন না। পেট্রোল গাড়ির পরিবর্তে ব্যাটারি চালিত যান ব্যবহার করুন।
সাবধান না হলে আগামী একশ বছরে পৃথিবী গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য।
পরিচিতিঃ ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট ও বিজ্ঞানী (প্রাক্তন), চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা, ৫ম তল; ৩৬ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি রোড, কলকাতা-২৬।
E-mail: soumitrag10@gmail.com.